সিলেটে ২ শতাধিক গ্রাম পানির নিচে
ওয়েছ খছরু-
আমলসীদে এসে বরাক রূপ নিয়েছে সুরমা ও কুশিয়ারায়। এর মধ্যে কুশিয়ারা প্রবাহিত বরাকের সোজাসুজি। আর বামে মোড় নিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সুরমা। সুরমার উৎসমুখ ভরাট হয়ে গেছে। পরিবেশবিদদের পক্ষ থেকে বারবার খননের দাবি তোলা হলেও উৎসমুখ খনন হয়নি। এ কারণে বরাকের ৮০ ভাগ পানিই টানতে হচ্ছে কুশিয়ারাকে। ১৫ দিন ধরে ভারতের বরাক উপত্যকায় ভারিবর্ষণ হচ্ছে। ওখানকার পাহাড়ি জনপদ মণিপুরসহ শত শত কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টি হওয়ার কারণে ফুসে উঠেছে বরাক। আর বরাকের তীব্র ঢলে সিলেটের ৬ উপজেলা তলিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে এসব উপজেলার অর্ধেকের বেশি এলাকা কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমরপানিতে নিমজ্জিত। শতাধিক গ্রাম পানির নিচে। সিলেট-বিয়ানীবাজার, সিলেট-চন্দরপুর সড়কও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জের কুশিয়ারা অববাহিকায় রীতিমত হাহাকার চলছে। ঈদের দিনও পানিবন্দি ছিল প্রায় অর্ধলাখ মানুষ। সরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ চলছে। কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত নয়। আরো ত্রাণ প্রয়োজন। অনাহারে-অর্ধাহারে থাকা মানুষ পথ চেয়ে আছে ত্রাণের আশায়। কুশিয়ারা নদীর জকিগঞ্জ থেকে ওসমানীনগর পর্যন্ত ৬ উপজেলার সব পয়েন্টে পানি বিপদসীমার এক থেকে দুই মিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু সুরমার পানি সহনীয়। তেমন বন্যা নেই। দুই জনপদের চিত্র দুই রকম। সুরমা অববাহিকায় বন্যার দেখা নেই। অথচ কুশিয়ারা অববাহিকতা ডুবে একাকার। ঈদের ৫ দিন আগেই বরাক থেকে তীব্র বেগে পানি নামতে থাকে বাংলাদেশে। সেই সঙ্গে হচ্ছে অবিরাম বৃষ্টিও। স্থানীয়ভাবে বৃষ্টির পানি ও বরাকের ঢলে ২৩শে জুন থেকে তলিয়ে যেতে শুরু করে সিলেটের জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলা। এই ৬টি উপজেলার অন্তত ৫টি স্থানে ডাইক ভেঙে গেছে। কুশিয়ারার তীর উপচে পানি ঢুকেছে গ্রামে গ্রামে। ঈদের আগে তেমনটি লক্ষ করা না গেলেও ঈদের এই কয়েকদিনে পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করেছে। ত্রাণের জন্য ইতিমধ্যে হাহাকার শুরু হয়েছে। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. রাহাত আনোয়ার ইতিমধ্যে কয়েকটি উপজেলা পরিদর্শন করেছেন। সরকারিভাবে এসব উপজেলায় ত্রাণ পৌঁছানো হচ্ছে। কিন্তু স্থানীয়রা জানান, সরকারিভাবে যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে সেটি খুব অপ্রতুল। প্রায় তিন দিন ধরে বহু এলাকায় মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিনযাপন করছেন। জকিগঞ্জ পৌরসভায় এখনো পানি ঢুকেনি। তবে কানায় কানায় ভরপুর পৌর এলাকা। দিন দিন পানি বাড়ছে। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর রিপন আহমদ জানিয়েছেন, বুধবার তারা এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ড্রেন দিয়ে বন্যার পানি কিছু কিছু ঢুকছে। এ কারণে ড্রেনগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া কেছরি-মাইঝভাগ এলাকার কুশিয়ারা ডাইকের অবস্থা নড়বড়ে। যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে বলে জানান তিনি। জকিগঞ্জের কুশিয়ারার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে গেল এক সপ্তাহ ধরে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার নিম্ন এলাকার প্রায় ১৫টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকায় লোকজন পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। জকিগঞ্জের চেয়ে বিয়ানীবাজারের অবস্থা শোচনীয়। বিয়ানীবাজারের বেশ কয়েকটি এলাকায় কুশিয়ারা ডাইক ভেঙে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে। এতে ১০টি ইউনিয়ন ও বিয়ানীবাজার পৌরসভার অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। বিশেষ করে কুশিয়ারা নদীর দুই পাশের প্রায় ২০টি গ্রামের মানুষ ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। এসব এলাকায় ত্রাণের সংকট চলছে। সিলেট-বিয়ানীবাজার সড়কে দুই ফুট উপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ছোট যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে ওই সড়কে চলাচল করছে যাত্রীবাহী বাস ও মালবাহী ট্রাক। বিয়ানীবাজারের লাউতা, মুড়িয়া, দুবাগ, শ্যাওলা, তিলপাড়া ইউনিয়নের ৭০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। গোলাপগঞ্জের কুশিয়ারা অববাহিকার মানুষ গেল এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি। হু-হু করে বাড়ছে পানি। উপজেলার বুধবারী বাজার থেকে চন্দরপুর পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকায় কুশিয়ারা ডাইক উপচে গ্রামে পানি ঢুকছে। পানি উঠেছে সিলেট-চন্দরপুর-বিয়ানীবাজার সড়কে। ওই সড়কে হাঁটুপানি ডিঙ্গিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কুশিয়ারা ডাইক উপচে পানি উঠা অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে এবার কুশিয়ারা অববাহিকতায় তারা ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছেন। উপজেলার সব পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার দেড় মিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। গতকাল কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন। তিনি বেশি দুর্গত পরিবারগুলোতে প্রাথমিকভাবে ১০ কোটি করে চাল দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। গোলাপগঞ্জের আমুরা, বুধবারবাড়ি বাজার, ঢাকা দক্ষিণ, বাদেশ্বর, উত্তর বাদেপাশা, শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের প্রায় ৭৫টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। গোলাপগঞ্জের ভাটিতে অবস্থান ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগরের। এই তিন উপজেলা সবচেয়ে বেশি প্লাবিত। এক সপ্তাহ ধরে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরে পানি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ। ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ২ মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আরো পানি বাড়লে উপজেলা সদরও তলিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। অনেক আগেই বুড়িকিয়ারী কুশিয়ারা ডাইকের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানি প্রবাহের ফলে ফেঞ্চুগঞ্জ সদর, গিলাছড়া, মাইঝগাঁও, উত্তর কুশিয়ারা ইউনিয়নের কমপক্ষে ৭০টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। ৭০ থেকে ৮০ হাজার মানুষ বানের পানিতে আটকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাকালুকি হাওর তীরবর্তী গ্রামগুলো। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হুরে জান্নাত জানিয়েছেন, সরকারিভাবে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। বালাগঞ্জ উপজেলা সদর ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় দুটোই পানি নিচে। সদর এলাকা কোমর পানির নিচে নিমজ্জিত। উপজেলার দেওয়ানবাজার, পূর্ব পৈলনপুরসহ ৬টি ইউনিয়নই পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ওসমানীনগরের পশ্চিম পৈলনপুর ও সাদিপুর ইউনিয়নের ৯০ গ্রামই পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এ দুটি উপজেলার বেশিরভাগ রাস্তায় পানি উঠে পড়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ঈদের আগে লামাতাজপুর এলাকায় কুশিয়ারা নদীর ডাইক ভেঙে পানি ঢুকেছে। এখনো প্রবল বেগে পানি ঢুকছে। ওই ডাইক নির্মাণে ঠিকাদারের গাফিলতির অভিযোগ তুলেছে স্থানীয়রা। এছাড়া উপজেলার গোয়ালাবাজার, বুরুঙ্গা, তাজপুর, দয়ামীর, ওসমানপুর ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে গেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। আরো ত্রাণ আসছে। এগুলো এলে ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছানো হবে।