সিলেট আওয়ামী লীগে ‘অনুপ্রবেশ’ ভীতি
সজল ছত্রী:দলে মনোমালিন্য, শৃঙ্খলাহীনতা; সহযোগী সংগঠনগুলোও কমিটিহীন। তবু সিলেটের ছয়টি আসনের পাঁচটিতে প্রার্থী দিয়ে পাঁচটিতেই সহজ জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। নিরঙ্কুশ এ জয়ের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন নিয়ে চলছে নানা ধরনের কানাঘুষা। দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, স্থানীয়ভাবে দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে না আনলে ভবিষ্যতে তার খেসারত দিতে হতে পারে। তাদের ভাষ্য, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও ক্ষমতাসীন দলের সুবিধা পাওয়ার আশায় জামায়াত-বিএনপি থেকে দলে দলে নেতারা ভিড় করছেন আওয়ামী লীগের পতাকাতলে। এরই মধ্যে দলে অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা অগণন উল্লেখ করে দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, ছোটখাটো অঘটন তো আছেই, সঙ্গে মূল নেতাকর্মীদের পেছনে ফেলে ভুল মানুষের হাতে উঠতে পারে আগামীর নেতৃত্বভার। বিরোধী দলগুলোর লন্ডন কানেকশন এবং সিলেটের জনগণের লন্ডন কানেকশন মিলিয়ে নানা ধরনের আশঙ্কাও করছেন দলটির ত্যাগী নেতাকর্মীরা।
সর্বশেষে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর থেকেই সিলেটের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মনকষাকষি অনেকটা প্রকাশ্য। চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ায় ক্রমেই বেড়েছে গ্রুপিং। সিলেট সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির পর গ্রুপিং নিরসন করে দল গোছানোর তাগিদ দেখা গেলেও জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তা স্থগিত করা হয়। উপজেলা ও অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে দল গোছানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা। ২০১১ সালে তিন বছর মেয়াদে গঠিত সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের পরবর্তী সম্মেলন হয়নি আট বছরেও। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দিয়ে চালানো হচ্ছে জেলা আওয়ামী লীগ। এক বছরের বেশি সময় ধরে কমিটি নেই জেলা ছাত্রলীগের। তিন বছর ধরে দু-তিনজন নেতার দাপটে চলা মহানগর ছাত্রলীগও এখন বিলুপ্ত। মহানগর যুবলীগের তিন মাসের আহ্বায়ক কমিটি ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে পাঁচ বছর ধরে। আর জেলা যুবলীগ ‘ভারপ্রাপ্ত’ দিয়ে চলছে এক যুগেরও বেশি সময়। গুটিকয়েক নেতার হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকায় ক্যাডারভিত্তিক গ্রুপিংয়ে বিপর্যস্ত সংগঠনগুলো। একমাত্র ব্যতিক্রম স্বেচ্ছাসেবক লীগ। আফতাব হোসেন ও দেবাংশু দাস মিঠুর নেতৃত্বে মহানগর এবং আফসর আজিজ ও জালাল উদ্দিন আহমদ কয়েসের নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে চলা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মীরা রাজনীতির মাঠে তৎপর। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কর্মসূচিগুলোয় রাজপথ দখলে রাখছেন তারা। এদিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সুবিধা পেতে দলে দলে বিএনপি নেতারা যোগ দিচ্ছেন টানা তিন মেয়াদের ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগে। সাম্প্রতিক সময়ে জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ও কুচাই ইউনিয়ন পরিষদের টানা চারবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান আবুল কালাম, বরইকান্দি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিব হোসেন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে আলোচনার জন্ম দেন।
এর আগে সিলেট-১ আসনে বিএনপির প্রার্থীর তালিকায় থাকা চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমদ চৌধুরী আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এবং সিলেট-৩ আসনের বিএনপির পরাজিত প্রার্থী শফি আহমদ চৌধুরীকে নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয়। সম্প্রতি তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের এমপি একে আবদুল মোমেনের বাসায় ফুল নিয়ে হাজির হন। তবে এটিকে সৌজন্য সাক্ষাৎ উল্লেখ করে বিএনপি ছাড়ছেন না বলে দাবি করেছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটে বিএনপির আরও বেশ কয়েকজন উপজেলা ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার লক্ষ্যেই তারা দল বদল করছেন বলে জানা গেছে।
দল পাল্টানো নেতাদের আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে স্বাগত জানানো হলেও বিএনপি তাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আর বিশিষ্টজনরা মনে করেন, ‘হালুয়া-রুটির ভাগ’ পেতেই সরকারি দলে ভিড়ছেন জনপ্রতিনিধিরা। সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদের মতে, যারা দল বদল করে, তারা জনগণের বিশ্বাস নিয়ে খেলা করছে। তবে ক্ষমতাসীন দলের মামলা ও হয়রানি থেকে নিস্তার পেতেও অনেকে দলবদল করতে পারে বলে মনে করছেন তিনি। এই দলবদলকে ‘হালুয়া-রুটির আশা’ হিসেবে দেখছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যেভাবে দল বদল করছেন, তা আগামী স্থানীয় নির্বাচনে নিজের অবস্থান ধরে রাখার লোভেই করছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের দপ্তর সম্পাদক কামরুল আই রাসেল বলেন, আওয়ামী লীগের সংগঠন গোছানোর সঙ্গে সঙ্গে অনুপ্রবেশের বিষয়টিতে নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন চলে আদর্শের ভিত্তিতে। সুবিধাবাদী ও সন্ত্রাসীরা অনুপ্রবেশ করে আদর্শের বিপক্ষে কাজ করতে পারে। লন্ডন থেকে বিএনপিকে চালানো হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, লন্ডন-সিলেট কানেকশনের মাধ্যমে অনুপ্রবেশকারীকে দিয়ে ভয়ানক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা হতে পারে।
মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এটিএম হাসান জেবুলও মনে করেন, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর দৌরাত্ম্য বেড়েছে সুবিধান্বেষী মহলের। ত্যাগী নেতাদের প্রাধান্য দিয়ে দ্রুত সংগঠনগুলোকে গুছিয়ে তোলা উচিত দাবি করে তিনি বলেন, তা না হলে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী দাবি করেন, জাতীয় নির্বাচনের কারণেই আটকে ছিল দল গোছানো। দ্রুত দল গোছানোর ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের মতে, স্বার্থান্বেষী মহল তৎপর হয়েছে। সুসময়ের এই অনুপ্রবেশ ভালো কোনো লক্ষণ নয়। কোনো নেতার হাত ধরে আওয়ামী লীগে আসতে চাইলেই তাকে স্থান দেওয়া উচিত নয়। দলীয় সভানেত্রীরও এ ব্যাপারে নির্দেশনা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্মতি সাপেক্ষেই কেবল কাউকে দলে জায়গা দেওয়া যেতে পারে।-সূত্র:আমাদেরসময়