সেবন্তী ভট্টাচার্য্য- নাম-পরিচয় গোপন রেখে অর্থ জমা রাখার জন্য ধনীদের আকর্ষণীয় গন্তব্য হলো সুইজারল্যান্ড। সুইস ব্যাংকে থাকা এই অর্থের একটি অংশ পাচার হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়। নাম-পরিচয় গোপন থাকায় সুইস ব্যাংকগুলোতে সারা বিশ্ব থেকেই বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ রাখা হয়। সুইজারল্যান্ডের সংবিধান এবং ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী সেখানে ব্যাংক গ্রাহকদের গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষা করা হয়। তবে ২০০২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচার রোধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ব্যাপকভাবে কার্যকর হওয়ার পর বার্ষিক ভিত্তিতে জমা টাকার হিসাব দিচ্ছে সুইজারল্যান্ড। বছর ভিত্তিতে কোন দেশের কত টাকা জমা আছে, সে তথ্য তারা প্রকাশ করছে। তবে কারো ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করা হয় না। দেখা গেছে, গত ১৩ বছরের মধ্যে মধ্যে সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের অর্থের পরিমাণ বেড়েছে রেকর্ড হারে।

জানা গিয়েছে, সুইস ব্যাংকে ২০২০ সালে ভারতীয়দের নগদের পরিমাণ বেড়েছে ২০ হাজার ৭০০ কোটি টাকারও বেশি। তবে তা সুরক্ষা ও নির্দিষ্ট খাতে অর্থের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। ২০১৮ সালের শেষে সুইস ব্যাংকে ভারতীয় ক্লায়েন্টদের মোট তহবিলের বৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় ৬ হাজার ৬২৫ কোটি। পরের দু’বছর সেই বৃদ্ধি কমে বেশ কিছুটা। এরপর ২০২০ সালে রেকর্ড বৃদ্ধি। বিভিন্ন ট্রাস্ট, বন্ড, সিকিউরিটি মানি বাবদ প্রচুর মোটা অঙ্কের অর্থ জমা পড়েছে সেখানে। অন্যান্য দেশের থেকে ভারতীয়দের থেকেই বেশি অর্থ এসেছে সুইস ব্যাংকে। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড়। ২০২০ সালে এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্র্যাংক। স্থানীয় মুদ্রায় যা ৫ হাজার ২৯১ কোটি টাকা (প্রতি সুইস ফ্র্যাংক ৯৪ টাকা হিসাবে)। এ পরিমাণ টাকা কমপক্ষে দেশের ১২টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সমান।  আগের বছরের চেয়ে এ আমানত ৩৭৬ কোটি টাকা কমেছে। অর্থাৎ ২০১৯ সালে যা ছিল ৫ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঁজি পাচার হচ্ছে। আমানত রাখার ক্ষেত্রে এ বছরও বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য। তবে কোন বাংলাদেশি তার নাগরিকত্ব গোপন রেখে টাকা জমা করলেন, তার তথ্য সুইস ব্যাঙ্কের প্রতিবেদনে নেই। বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, এ টাকার পুরোটা পাচার নয়। এর মধ্যে সুইজারল্যান্ডে যারা কাজ করছেন তাদের আমানত রয়েছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা থাকতে পারে। তবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে কাউকে টাকা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিভিন্ন চেষ্টা চলছে। এটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার।  এর আগেও ২০১৩ সালে আমরা একবার সুইস ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তারা আমানতের প্রতিটি খাত আলাদাভাবে খতিয়ে দেখতে বলেছে।

বাংলাদেশিদের আমানত: ২০২০ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানতের স্থিতি ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ডলার। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে যা ছিল ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্র্যাংক।

২০১৮ সালে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্র্যাংক
২০১৭ সালে ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ ফ্র্যাংক
২০১৬ সালে ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ফ্র্যাংক
২০১৫ সালে ৫৫ কোটি ০৮ লাখ ফ্র্যাংক
২০১৪ সালে যা ছিল ৫০ কোটি ৬০ লাখ ফ্র্যাংক
২০১৩ সালে ৩৭ কোটি ২০ লাখ ফ্র্যাংক
২০১২ সালে ছিল ২২ কোটি ৯০ লাখ ফ্র্যাংক
২০১১ সালে ছিল ১৫ কোটি ২০ ফ্র্যাংক

স্বর্ণালঙ্কার, শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র জমা রাখলে তার আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে আমানতে যোগ হয় না।  ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে ৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। জিএফআইর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪টি প্রক্রিয়ায় এ অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসা। এছাড়াও টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২০ শতাংশই কোনো না কোনো ভাবেই পাচার হচ্ছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn