জেসমিন আরা বেগম- লন্ডন থেকে ইমানুজ্জামান মহী মামার  ম্যাসেন্জারে হঠাৎ ফোন । কি ব্যাপার ! উনার মামা আব্দুল হাই সাহেবের উপর একটা সংকলন বের করবেন লিখা চাই। আমার কর্তার । উনার ফোনে রিচ করতে পারছেন না । উনাকে ফোনটা ধরিয়ে দিতে । বল্লাম আমি লিখতে পারি কি না । বল্লেন অবশ্যই খুব শীঘ্র সংকলনটা বেরুবে লিখা দিলে খুশী হবেন । বলতে গেলে যেচেই এই লিখাটা লিখার ফরমায়েশ নিয়েছি ।

আমার ছেলেবেলার গল্প শুনা স্বপ্নপুরুষ, জ্ঞানতাপস মানবিক ব্যক্তিত্ব আব্দুল হাই নানা । রুপকথার গল্পের মতো উনার গল্প আমার ছেলেবেলাকে ঘিরে রেখেছিলো । বড় হয়ে জেনেছি গল্পগুলো রুপকথা ছিলো না ,ছিলো বাস্তব । দেখেছি তাকে বিভিন্ন রুপে । উনার যৌবনের সেই ঔজ্জল্যময় সময় আমি দেখিনি । কিন্তু শান্ত স্নিগ্ধ নির্ভেজাল , নিরহংকারী,এক জ্ঞানতাপসকে দেখেছি । যার চলনে বলনে কোন আত্মম্ভরিতা প্রকাশ পেতো না । যিনি অর্থের পিছনে দৌড়াননি । সারাজীবন শিক্ষা আর শান্তির আরাধনা করে গেছেন । সমাজকে দিতে চেয়েছেন আলোক বর্তিকা । আলোর মশাল হাতে যিনি সুনামগন্জকে আলোকিত করতে চেয়েছেন ভালবেসে সবাইকে আপন করে নিয়ে ।

সুনামগন্জের আরপিন নগরের বিখ্যাত তালুকদার বাড়ীতে তার জন্ম । সুনামগন্জ শহরের মূল বাসিন্দা তারা । আরপিন নগরের তালুকদার বাড়ীর সম্মান ও আভিজাত্য সর্বজনবিদিত । এটা আমার মায়ের মামা বাড়ী । আব্দুল হাই নানা আমার নানীর চাচাতো ভাই । সেই সুবাদে নানা । আমার মা ছোট্ট বেলা মাতৃহারা হলে নিজের বাড়ী ছাড়াও মামার বাড়ীর আদরে বড় হয়েছেন । ছোট বেলার বেশীর ভাগ সময় তার কেটেছে মামা বাড়ীতে । তার কারনও ছিলো । আমার নানা ছেলে মেয়ে দেখার জন্যে দ্বিতিয় বিবাহও করেন আমার নানীর বোন কে । আমার মায়ের ছয় খালা । আর চাচাতো মামা খালায় বাড়ী ছিলো তখন ভরপুর । আর সারা তালুকদার বাড়ীতে তখন জমজমাট অবস্থা । আমার মায়ের মামা খালুতে ছয়লাব তালুকদার বাড়ী ।  মামারা কেউ বিয়ে করেছেন কেউ পড়াশুনা করছেন কেউ বিয়ের জন্যে দিন গুনছেন । নুতন মামীরা আসছেন । এমন জমজমাট অবস্থায় হেসে খেলে আমার মা মা হারানোর দু:খ ভুলে সবার আদরে বড় হন । আর তাই মামাবাড়ীর প্রতি তার খুব টান । আমার মায়ের নানা মরহুম আব্দুল খালিক সাহেব তালুকদার বাড়ী ছেড়ে কামার খাল এর কাছে বাসা বদল করে আসেন আম্মার বিয়ের পর ,এই বাসাকে তিনি নানার বাসা বলতেন ।  মামা বাড়ী বলতে তিনি তালুকদার বাড়ীকেই জানতেন। আমরাও তাই জেনে বড় হয়েছি।

তবে আব্দুল হাই নানা সম্বন্ধীয় রুপকথার গল্প গুলো আমি আমার মায়ের কাছে যত না শুনেছি তার চেয়ে ঢের বেশী শুনেছি আমার নানী ফজিলুতুন্নেছা বেগম চন্দন এর কাছে।

আমার নানী চন্দন জনাব আব্দুল হাই সাহেবের চাচাতো বোন ।উনি উনার ভাই গোলাপ ভাইসাবের গৌরবগাঁথা বড় তৃপ্তির সঙ্গে বলতেন । নানীকে আমরা নানা ডাকতাম । নানাকে নানাভাই । নানারকাজ ছিলো পাকের ঘরে আয়েশ করে পাক করা ,আর নিজের বাপের বাড়ীর গৌরবগাঁথা ,আভিজাত্যের বর্ননা করা । আর একটা কাজ তিনি নিয়মিত করতেন , দুপুরে খাওয়ার পর গল্পের বই এক নি{শ্বাসে শেষ করতেন । এই বিষয়ে কেউ কোন বাধা দিলে ,( বিশেষ করে আমার নানা ) তিনি তার ভাইয়েরা কে কত পন্ডিত তার ফিরিস্তি দিতে শুরু করতেন । আর এই ফিরিস্তির মাঝে অবশ্যই তার গোলাপ ভাইসাব এর জেলে থেকে পাশ করা থেকে সারা দেশের মাঝে এমন শিক্ষিত নাই তা প্রমান করে ছাড়তেন । নানাভাই রনে ভঙ্গ দিয়ে চলে যেতেন । কাজেই শিশুকাল থেকে আমার নানীর গোলাপ ভাইসাব আর আমার মায়ের গোলাপ মামার অসাধারন কীর্তি কাহিনী শুনে আমাদের বড় হওয়া।

আমার নানী তার বাপের বাড়ীর আভিজাত্যের ঐতিহ্যের হৃদয়গ্রাহী বর্ননা করতেন । তাদের শৌর্য্য বীর্যের ধনদৌলতের গল্প ও আমরা কম শুনি নি। যেমন তার ভাই রইছ চৌধুরী ও তার বাবা পলাশের কত বড় জমিদার ছিলেন, বই লিখেছেন , তার তারা ভাইসাবের ছেলেরা কত পড়াশুনা করেছে । পারুল খালাম্মার আব্বা কত বড় পালোয়ান ছিলেন । তার বোনদের কত বড় বড় বাড়ীতে বিয়ে হয়েছে। আপন বোন চাচাতো বোন সবার গল্প উনার বদৌলতে আমাদের মুখস্ত হয়ে গেছিলো । সব গল্প ছাপিয়ে তার গোলাপ ভাইসাবের গৌরব বর্ননায়  শেষ হতো । । কিভাবে তার ভাই পাকিস্তান আন্দোলনে অগ্রযত্রী ছিলেন, ভাষা আন্দোলন করেছেন জেলে গেছেন , জেলে থেকে সবচেয়ে বেশী নং পেয়ে বি এ পাশ করে সারা দেশকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন । কিভাবে তার ভাই এর অসাধারন বক্তৃতা শুনে কোন এক নামকরা তালুকদার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে  আর তার কন্যাসম্প্রদানের জন্য ব্যতিব্যস্ত হন । কিভাবে লঙ্গর খুলে মানুষের সেবা করতে গিয়ে তার ভাইয়ের উকিল হওয়া হলো না । এসব গল্প বলতেন আর শেষ করতেন আফসোস দিয়ে । এতো পড়তে গিয়ে তার ভাই রোজগারের দিকে নজর দিতে পারলেন না । অন্য ভাইদের চেয়ে গরীবই থেকে গেলেন । তার এই নিরীহ পন্ডিত ভাই এর জন্যে তার যেমন গরিমা ছিলো তেমনি ছিলো আফসোস । এতো পড়াশুনা করেও ধনী না হতে পারার আফসোস ।

কাজেই শিশু বয়সেই জনাব আব্দুল হাই সাহেব যে পন্ডিত ব্যাক্তি ছিলেন সে সম্বন্ধে আমি ওয়াকিফহাল হয়ে যাই । শিশুবয়স থেকে পড়াশুনার প্রতি আমার আকর্ষন বেশী ছিলো । এজন্যে এই নিরীহ শ্যামল শান্ত আব্দুল হাই নানা আমার মননে বড় গুরুত্ববহ ছিলেন যা তিনি নিজেও জানতেন না।

ছেলেবেলায় মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে ও পরে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত আমি হাফপ্যান্ট পরে সুনামগন্জ চক্কর দিতাম  ।আবদুল হাই নানা বসতেন জালালাবাদ হোটেল আর গুলবাগ হোটেলের মাঝে একটা প্রেস করে । প্রেস টার নাম ছিলো মুর্শিদীয়া প্রেস । মেটালের অক্ষর বসিয়ে পা দিয়ে পেডেল মেরে প্রেস চলতো । আমি মাঝে মাঝে উনার সামনের চেয়ারে গিয়ে বসতাম । দেখলেই বলতেন –’কি তা খবর?’ আমি তখন শিশুসুলভ প্রশ্নই করতাম । ’আপনি নাকি বেশী পড়া জানেন পন্ডিত’ জোরে হাসতেন না , গম্ভীর হাসি মুখেই বলতেন ’কেটায় কয় ? ’আমি উত্তর দিতাম আপনার বইন আমার নানা । ’ও: চন্দন ! ’ দূর ওরা জানে না আমি পন্ডিত না । আমার ঔৎসুক্য শেষ হতো না । লোকটা পন্ডিত তা আমি বিশ্বাস করতাম ।

৬৯কি ৭০ সালে সুনামগন্জের বালুর মাঠে অনেকদিন মেলা হয় । মেলা বা যাত্রা হলে আমার নানা মরহুম মতছিন আলী আমাদের সঙ্গে নিয়ে মেলাতে যেতেন সেই মেলার প্রানপুরুষ ছিলেন আব্দুল হাই নানা । উনি খুব ব্যস্ত । সব বিষয়েই উনার ডাক পড়ছে । উনি নাকি এই অনুষ্ঠান আয়োজনের কর্তা । খুব অহংকার আমাদের মাঝে কাজ করে । এক নানার সংগে অনুষ্ঠানে যাওয়া যিনি নিজেও সবার পরিচিত আলাদা সম্মান দেখাচ্ছে সবাই, আর মূল মেলার মালিকইতো আমাদের আরেক নানা । নানা ময় পৃথিবী । সেই মেলায় দূরবীন শাহ কে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার । তখন বুঝিনি এখন জানি সুনামগন্জের কত বড় বাউলকে সেদিন দেখেছিলাম । এসেছিলেন শিল্পী আব্দুল জব্বার । তখন সালাম সালাম হাজার সালাম গান সহ অনেক গানের জন্য তিনি বিখ্যাত । রাত জেগে বাউল গান , উজির মিয়ার হাসন রাজার গান, মালজোড়া গন ঐ মেলয় ই দেখি ।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আব্দুল হাই নানা ফ্যামেলী সহ বালাট চলে যান । মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসাবে কাজ করেন । মুক্তিযুদ্ধে আমার পিতা শহীদ হন । যুদ্ধশেষে ১৯৭২ এ তিনি আমাদের বাসায় আসেন, আমার আম্মাকে কিভবে আমাদের পড়াশুনা করিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে তার উপদেশ দেন । যে কোন সমস্যায় তাকে ডাকার জন্যে বলেন । তার সেই বুঝানোর ভঙ্গিটা এখনও চোখে ভাসে।

আমার ছোটবেলা থেকে এই মানুষটা সম্বন্ধে কৌতুহল কাজ করতো আমার নানীর সেই হৃদয়গ্রাহী বর্ননা থেকে । ৭২সালে তিনি যখন গুলবাগ হোটেলের কাছে সূর্যের দেশ পত্রিকা বের করেন তখনও আমি তার প্রেসে গেছি । গিয়ে সামনের চেয়ারে বসে উনার প্রেসের কাজ কিভাবে করে তা দেখতাম । এই সময় আমার ভাই গোলাম রব্বানী সম্পাদিত বিন্দু বিন্দু রক্তে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো সেটা মূলত চালাতেন আব্দুল হাই নানার ভাস্তে আবু আলী সাজ্জাদ হোসেন । আমরা তাকে আলা মামা বলতাম । ওখানেও আমি হানা দিতাম । তবে প্রেসের কাজ ধাতুর হরফ দিয়ে শব্দ তৈরীর কাজ আমি উনার প্রেসে বসে দেখতাম আর নানা প্রস্নে উনাকে ব্যাতিব্যস্ত করতাম । অনেক সময় রাগ করে বলতেন “এই বান্দী যা ! প্রেস চালানোর কাজ তোর করা লাগতো না । “ আসলে আমি আমার গল্পে শুনা পান্ডিত্যের বিষয়টি অনুধাবনের চেষ্টা করাতাম ।

১৯৭২ সালে আমার বড় মামা প্রফেসার বদিউর রহমানের ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন হয় । তখনকার যুগে বিয়েতে উপহার ছাপনোর রেওয়াজ ছিলো । মামার বিয়েতে একটিই উপহার হবে , যেখানে মতিউর মামা সুহেল মামা খালাদের নাম ও থাকতে হবে আবার আমাদের নাম ও থাকতে হবে । নানাভাই একটা উপহার ছাপানোর টাকা দেবেন । কঠিন সমস্যা আবু আলী মামাকে বলা হলে তিনি বুদ্ধি দেন । আব্দুল হাই নানার কাছে যেতে । আমার সাথে খাতির আছে তাই আমাকেই পাঠানো হয় । আমি যথারিতী উনার সামনের চেয়ারে বসি । উনিও স্বভাব সুলভ গাম্ভীর্য নিযে প্রশ্ন করেন, “কিতা খবর?”  আমি বলি বড়মামার বিয়ের উপহার ছাপানোর বিষয়টা । উনি একটুও বিরক্ত না হয়ে বলেন “বদিউরের বিয়া দাড়া ” – নিজে উপহার পছন্দ করেন, অর্ধেক অংশ ভাই বোন অর্ধেকে আমরা ভাগ্নাভাগ্নীর নামদিয়ে উপহার প্রস্তুত করেন । নির্দিষ্ট তারিখে আনতে বলেন । এই উপহারের জন্য আমার নানার বাজেট ছিলো সেটা আমাদের সমজিয়ে দেয়া হয়েছিলো । আমি সেজন্যে বলি ’নানাভাই  টাকাটা ,’- ওরে বাবারে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আমারে মারতে আসেন । ’তুই টাকা সাধস আমারে অতো বড় সাহস !’ আমার উত্তর ছিলো নানাভাই তো এজন্যে আমাদের টাকা দিয়েছেণ । তিনি রাগে আমাকে সামনে ডাকেন বলেন ’কার বিয়া ?’ বলি বড়মামার । ’আমি তার কে ?’ বলি মামা

’আমার ভাগ্নার বিয়ার টাকা তুই আমারে সাধস ? ভাগ বান্দী ।’ 

হ্যা ভেগেই বাসায় আসি উনার রুদ্রমূর্তি সেদিন বড় ভয় পেয়েছিলাম । এই প্রেস উনার আয়ের একটা পথ ছিলো , সারা শহরে উনার অগনিত আত্মীয় স্বজন ছিলো , সবাইকে যদি এভাবে ফ্রি সার্ভিস দেন তাহলে উনি টাকার মালিক হবেন কেমন করে ? আজ মনে হয় মনের ধনে উনি ধনী ছিলেন,তাই টাকার ধনে ধনী হতে পারেন নাই । ১৯৭৩ সালে উনি এইচ এম পি স্কুলের চাকুরী ছেড়ে ইলেকশনে দাড়িয়ে যান । সম্ভবত পৌরসভা চেয়ারম্যান পদে । মার্কা ছিলো হারিকেন । উনার সেই লেন্টনের মিছিলে আমি গেছি স্বল্প পরিসরে ।আরপিন নগড় থেকে বের হয়ে আমাদের বাসার সামনে দিয়েই উনাদের যাতায়ত করতে হতো বলে আসা যাওয়ার পথেই সকলের সাথে দেখো হয়ে যেতো । এদের বেশীর ভাগ নানাই আমাদের বান্দী সম্বোধন করতেন কিন্তু আমাদের প্রেস্টিজে লাগতো না । কারন আমরা জানতাম এটা স্নেহের ডাক । আব্দুল হাই নানার সেই বান্দী ডাক আমার এখনও কানে বাজে ।

১৯৪৮সালে যিনি পুথম বিভাগে প্রবেশিকা পাশ করেন । ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহনের জন্যে যিনি এম সি কলেজ থেকে বিতারিত হন, আবার পরীক্ষা দেয়ার পূর্বক্ষনে রাজনীতির কারনে যাকে জেলে যেতে হয় সেই তিনি জেলে বসে বি এ পরীক্ষায় ডিস্টিংসন মার্ক নিয়ে পাশ করে নিজের মেধার প্রমান দেন । সেই তিনিই নিজের আখের গোছানোর দিকে নজর না দিয়ে আইন পরীক্ষা রেখে দু:খী মানুষের মেবার জন্যে লঙ্গর খুলে মানব সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেন । ছাত্র ইউনিয়ন ,ছাত্রলীগ আওয়ামীলীগ সকল সংগঠনের মূখ্য ভুমিকায় থেকেও কোন অহংকার তাকে ছুঁতে পারেনি । মানুষ গড়ার কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন, পরবর্তী প্রজন্মকে স্বপ্ন বুননে সাহায্য করেছেন । সাহিত্য, সংস্কৃতি,সমাজ , শিক্ষাঙ্গন সব জায়গায় নিজের দায়িত্বটুকু পালন করেছেন বিনিময়ে চাননি কিছু ।মনীষরি জীবন যাপন করে গেছেন এই মানুষ । 

তিন মেয়ে এক ছেলে নিয়ে সুখের সংসার ছিলো উনার । অতিশয় ভদ্র মায়াবী মহিলা ছিলেন উনার স্ত্রী । আর উনার বড় মেয়ে দীপা খালা মায়ার ভান্ডার ছিলেন বাপের পড়ার বাতিক পেয়েছিলেন । আমার ছোট বোন শাম্মীর সনে পড়তেন এ জন্যে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় আসতেন । আমার চাইতে ৪/৫ বছরের ছোট কিন্তু কথা বলতেন মুরব্বীর মতো উনি যে খালা সে বিষয়ে টনটনে জ্ঞান ছিলো। এতো সুন্দর গুছিয়ে কথা বলা হয়তো বাপের থেকে ইনহেরিট করেছিলেন ।  ছোট দৃই মেয়ে নীপা ও অনুপা । তিন মেয়ে ও এক  ছেলে  নিয়ে এক সময়ের ডাকসাইটে ছাত্রনেতা ,রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব, সাহিত্যিক আব্দুল হাই নানার জীবন আরও কুসুমাস্তীর্ণ হতে পারতো । কিন্তু ১৯৭৬ কি ৭৭ সালে উনার জীবনে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় নেমে আসে । উনার একমাত্র পুত্র গালিব কঠিন এক অসুখে আক্রান্ত হন । আর চিকিৎসাধীন আবস্থায় মারা যান । সেই তুখোড় ছাত্র নেতা , সেই জনমানুষের সেবা প্রদানকারী মানবিক মানুষ , শিল্পসাহিত্যের অভিভাবক হঠাৎ করেই মৌন হয়ে যান । ম্রিয়মান হয়ে যান । জীবন যুদ্ধে পরাজিত সৈনিক হয়ে যান ।

আমাদের আব্বা মারা যাওয়ার পর আম্মা আমাদের অভিভাবক হন ।  আমাদের পড়াশুনার মনন তৈরীতে তালুকদার বাড়ীর একজনের অবদান আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারব না তিনি হলেন আব্দুল হাই নানার ভাতিজা  আবু আলী সাজ্জাদ হোসোইন । জনাব আব্দুল হাই নানার মনন তিনি ধারন করতেন । দুজন দুজনকে ভালবাসতেন একই এরিনায় বিচরনের জন্যে । আজ বলতে দ্বিধা নেই যতটুকুই পড়ালেখা করতে পেরেছি তার পিছনে আলা মামার অবদান ছিলো অনেকটাই । তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখতে উন্নত মনন তৈরীতে গুরুত্ব পূর্ন ভূমিকা পালন করেছেন । হাতে কলমে পড়িয়েছেন,প্রতি সন্ধ্যায় বড় বড় মানুষের জীবনের গল্প বলে ঐসব জীবন ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন জাগিয়েছেন । উনার কাছেই বড় হয়ে আব্দুল হাই নানার গল্প শুনে নুতন কল্পে উনাকে চিনি । ছোটবেলা আমার নানীর ভ্রাতৃ অহংকারের গল্পগুলো যে গাল গল্প নয় সত্যিকারের গল্প তা হৃদয়ঙ্গম করি ।

মুক্তিযুদ্ধের পূর্বেই উনার হাছন পছন্দ নামের বইটি দেখেছি । নিজের নাম না দিয়ে হাছনপছন্দ নাম নেয়টা আমার তখন পছন্দ হয় নাই । তবে হাছন পছন্দ বলতে সুনামগন্জের মানুষ উনাকেই চিনে ।  পরবর্তীতে উনার অন্য বইগুলোও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আবু আলী মামার সৌজন্যে । মূলত: এগুলো গানের বই । তিনি সুনামগন্জ আর্টকাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা । যা আজ শিল্পকলা একাডেমী নামে প্রসিদ্ধ। সুনামগন্জের শিল্প সংস্কৃতির ঐ সময়ের পুরোধা এই জ্ঞানতাপস নির্লোভ রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব অর্থ উপার্জনে কখনই মনোনিবেশ করেননি । তার ঘর ভর্তি বইয়ের সমারোহ সারা তালুকদার বাড়ীতে তাকে আলাদা দ্বীপের বাসিন্দা করে রেখেছিলো । নিরবে নিভৃতে সবার আফসোস বাক্য শুনে নির্লিপ্ত অথচ দৃঢ় ব্যক্তিত্ব নিয়ে তিনি জীবন অতিবাহিত করেছেন । তার সুনাম সবাই ব্যবহার করেছেন কিন্তু কাছে গিয়ে তার দু:খী মনের হাতটি শক্ত করে কেহ ধরেছে বলে মনে হয় না ।

শেষ জীবনে তিনি নজরুলের মতো আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধ বিধুর ধুপের মতে মিতবাসী হয়ে যান । পুত্র শোক আর জাগতিক সমস্যা তাকে অসুস্থ করে   তুলে । মৌনমুখে একা একা কখনও সাইকেলে করে কখনো  হেটে তিনি বেরুতেন ।  পরিবার, সমাজ ,রাষ্ট্র সংগঠন কারও কাছে তার কিছু চাওয়ার ছিলো না । উনার এই বৈরাগ্য উদাসী রুপ দেখে আমার মা ,নানী বড় কষ্ট পেতেন । এ সময় হঠাৎ একদিন আমাদের বাসায় আসেন স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আম্মাকে ডেকে কুশল জিজ্ঞেস করেন । আমি তখন বি এ ক্লাসে সবে ভর্তি হয়েছি । পড়াশুনার বিষয় জিজ্ঞেস করে আমার পড়ার টবিলে আসেন আয় তোর পড়া দেখি । ইংলিশ গ্রামার নিয়ে বসেন ,Synonyms and Antonyms ’ মুখস্ত কতগুলো করেছি  জানতে চান । ফ্রেইজ জ্ঞান কেমন পরীক্ষা করেন । গ্রামার বই ধরে এগুলো মুখস্ত করা দরকার বলে একটুক্ষন বসে পরে এসে পড়া নিবেন জানিয়ে আপন মনে চলে যান । আমি উনার দেয়া সবগুলো পড়া মুখস্ত করে রাখি । কিন্তু না মৌনমুখ সেই জ্ঞানতাপস আর আসেন না ।

 আবু আলী মামা উনাকে অত্যধিক ভালবাসতেন ,শ্রদ্ধা করতেন । উনি যে কত কিছু করার ক্ষমতা রাখেন সেই বর্ননা দিতেন । নানান সমস্যায় তিনি তার মেধার সবটুকু বিকাশ করতে পারলেন না এজন্যে আফসোস করতেন ।এ ধরনের মেধাকে পরিচর্যা করতে হয় যা করার কেউ ছিলো না ।

আজ এ সময়ে এ লিখা লিখার সময় আমিও স্বীকার করি এ ধরনের শিল্পী জ্ঞানতাপসকে পরিচর্যা করতে হয় । উৎসাহ দিয়ে সাহস দিয়ে প্রসংশা বাক্য উচ্চারন করে যা তিনি পাননি । আর ভাগ্য ও তাকে সুযোগ দেয় নি পুরো মননকে প্রকাশিত করার । পুত্রের মৃত্যুর পর স্বাভাবিক আব্দুল হাই আর তিনি ছিলেন না । মৌনমুখ , আপনার মনে পুড়ে আপনাতেই বিলীন হয়েছিলেন ।

১৯৮৩ সালের ২৫ শে মার্চ আমার নানা মতছিন আলী সাহেব ইন্তেকাল করেন । আমাদের জন্য এই দু:খ ছিলো পাহাড় সমান । সম্ভবত: ২৭শে মার্চ বিকালে তিনি আমার নানার মধ্য বাজারের বাসায় যান । তার বোন চন্দন বেগম আর আমার আম্মাকে ডেকে বারান্দায বেন্চে বসেন । খুব ধীরে ধীরে জীবনের অনিত্যতা বুঝান । আমি সামনে ছিলাম । কারন আগেই বলেছি এই পন্ডিত ব্যাক্তির প্রতি আমার আগ্রহ ছিলো প্রচুর । তার শেষ বাক্য ছিলো ’ আজ শান্তির বাপ গেছেন কাল আমি যাব পৃথিবীর এই নিয়ম জীবন অনিত্য পৃথিবী অনিত্য চলে যাওয়াটা হলো সত্য এর জন্য দু:খ করার কিছু নেই ।’। 

আমার নানার ত্রিশদিনের শিন্নি উনাদের লক্ষন ছিরির বাড়ীতে উনার ভাইয়েরা করেন  । দুপুরে ‍শিন্নি থেকে বাসায় ফিরছি আমরা সবাই । বারী মন্জিলের কাছে যখন আসি দেখি সাইকেল করে আব্দুল হাই নানা আরপিন নগড়ের গলি থেকে বেরিযে যাচ্ছেন । সেই সাইকেল চালিয়ে যাওয়টা এখনও চোখে ভাসে । আমরা বাসায় ঢুকতে পারি নাই গুলবাগ হোটেলের সামনে থেকে গোলযোগ শুনা য়ায় । আম্মা আব্দুর নূরকে পাঠান সে এসে বলে কে একজন সাইকেল থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে ।মানুষ বলতেছে মরে গেছেন কে সে দেখতে পারে নাই। আম্মা চিৎকার দিযে উঠেন ‘আমার মামা না তো ’ দৌড়ে আম্মা সহ যাই । হ্যা একটু আগে সাইকেল চালিয়ে সুস্থ্য সবল যে মানুষটি যাচ্ছিলেন ,মিনিট দু /একের মধ্যেই তিনি লাশ হয়ে যান । হ্যা পৃথিবী এতোটাই অনিত্য । আমার কানে শুধু মাসখানেক আগের তার অনিত্য পৃথিবীর বক্তব্য বাজতে থাকে ।   

১৯৮৩ সালের ২৫ এপ্রিল  সুনামগন্জের এক মানবিক জ্ঞানতাপস কালের গর্ভে অনিত্য পৃথিবী থেকে হারিয়ে যান । চলে যান তার নিত্য পৃথিবীতে । সেখানে যেনো তিনি ভালো থাকেন ,তার নির্লোভতা , তার মহানুভবতা,তার দেশপ্রেম  তার মানবপ্রেম ,যেনো ঐ জগতে তাকে আল্লাহর রহমতের ছায়ায় নিয়ে যায় তাই হউক আমাদের প্রর্থনা ।

লেখক-জেসমিন আরা বেগম, সাবেক বিচারপতি জেলা জজকোর্ট। সদস্য জাতীয় মানবধিকার কমিশন বাংলাদেশ।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn