ওয়েছ খছরু-হাওর এলাকা সুনামগঞ্জের আওয়ামী রাজনীতি সব সময়ই উর্বর। কে কোথায় কোন ঘাটে তরী ভেড়ান তা বলা মুশকিল। এক সময় সুনামগঞ্জের আওয়ামী রাজনীতিতে ছিল কেন্দ্রীয় দুই প্রয়াত নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দাপট। তাদের ঘিরেই আবর্তিত হতো সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের রাজনীতি। আর এর রেশ ছিল দলটির কেন্দ্র পর্যন্ত। তাদের রাজনৈতিক দর্শনের ভেতরে এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে সুনামগঞ্জের আওয়ামী রাজনীতি। চির শত্রুতে পরিণত হওয়া নেতারা হঠাৎ করেই দেখান রাজনীতির সে দর্শন। এতে গোটা সিলেটজুড়েই দেখা দেয় জল্পনাও।

মুখ দেখাদেখিতেও বন্ধ থাকা সুনামগঞ্জের সন্তান পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বৃহস্পতিবার বিপরীত বলয়ের শীর্ষ নেতা ও সুনামগঞ্জ-৫ আসনের এমপি মুহিবুর রহমান মানিকের পিতা-মাতার মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে গিয়ে হাজির। এতে দুই জনের হলো মুখ দেখাদেখি। কথা হলো আন্তরিক ভাবে। অথচ এই দুইজনের দ্বন্দ্বের কারণে এতদিন সুনামগঞ্জের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোও মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিলো। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুস সামাদ আজাদের মৃত্যুর পর সুনামগঞ্জের রাজনীতিতে অভিষেক ঘটেছিলো পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের। সামাদ আজাদের আসনেই তাকে মনোনয়ন দিয়েছিলো আওয়ামী লীগ। সে সময় সামাদ আজাদের বড় পুত্র আজিজুস সামাদ ডন ও সুনামগঞ্জের সামাদ বলয়ের নেতারা পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানকে গ্রহণ করেননি। এমএ মান্নানের প্রতিপক্ষ হয়ে সুনামগঞ্জে সরব হয়েছিলেন আজিজুস সামাদ ডনও। সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও পরবর্তীতে তিনি নীরব হয়ে পড়েন।

জীবিত থাকা অবস্থায় ওই সময় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহযোগিতা পেয়েছিলেন এমএ মান্নান। সুরঞ্জিত বলয়ের শীর্ষ নেতা ও সুনামগঞ্জ-৫ আসনের এমপি মুহিবুর রহমান মানিকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রীর। ফলে সুরঞ্জিত বলয়ের কাছে রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন সাবেক সামাদ আজাদ বলয়ের নেতারা। এদিকে প্রায় বছর দেড়েক আগে সুনামগঞ্জের উন্নয়ন রাজনীতি নিয়ে ফের আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি এবং মন্ত্রী ও এমপিদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। সুনামগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে স্থান নির্ধারণ ও রেললাইনের গতিপথ নিয়ে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছিল। হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জে উন্নয়নের রূপকার বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। প্রভাবশালী মন্ত্রী হওয়ার কারণে তিনি সুনামগঞ্জকে আলোকিত করতে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসছেন। অতীতে কখনো এমনটি ঘটেনি সুনামগঞ্জে।

তবে মন্ত্রীর সব চাওয়া তার নিজ উপজেলা শান্তিগঞ্জকেন্দ্রিক। শান্তিগঞ্জে মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, শান্তিগঞ্জ দিয়ে রেললাইন স্থাপন সহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের জায়গা নির্ধারণ সহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে এমপিদের সঙ্গে তার বিরোধ বাধে। আর এতে এমপিদের পক্ষে নেতৃত্বে ছিলেন মুহিবুর রহমান মানিক এমপি। এ ছাড়া, নিজের নির্বাচনী এলাকার পাশাপাশি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী জয়া সেনের আসন সুনামগঞ্জ-২ আসনের দেখভালের দায়িত্ব তার ওপর। কারণ কয়েক মাস ধরে গুরুতর অসুস্থ জয়া সেন। এ কারণে ওই আসনটির প্রতি নজর রাখতে হচ্ছে তাকে। পরিকল্পনামন্ত্রী চেয়েছিলেন; রেললাইন যাবে ছাতকের গোবিন্দগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জে। পথে থাকবে শান্তিগঞ্জ উপজেলা। আর এমপি মানিক সহ অপর এমপিদের মত ছিল ছাতক শহর হয়ে সুনামগঞ্জে যাবে। বৃটিশ আমল থেকে ছাতক পর্যন্ত রেললাইন বিদ্যমান রয়েছে। এই বিতর্কের কারণে এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জ রেললাইন আলোর মুখ দেখেনি।

বিতর্কের পর থেকে বিরোধ চরমে পৌঁছে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান ও এমপি মুহিবুর রহমান মানিকের। উন্নয়নের বিরোধের জের ধরে সুনামগঞ্জের আওয়ামী রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ দেখা দেয়। এতে সুনামগঞ্জের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুট, ছাতক পৌরসভার চেয়ারম্যান আবুল কালাম চৌধুরীসহ অনেক প্রভাবশালী নেতারা মন্ত্রীর পক্ষে অবস্থান নেন। প্রতিপক্ষ হন মুহিবুর রহমান মানিক এমপি, জয়া সেন এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমনও। ফলে গত দেড় বছর ধরে এই ধারায় সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছিলো। প্রতিটি উপজেলা পর্যন্ত রয়েছে এই বিভক্তির বিস্তৃতি। সুনামগঞ্জে ‘বিভক্ত’ আওয়ামী লীগে বৃহস্পতিবার লেগেছে নতুন হাওয়া। নিজের এলাকায় পিতা-মাতার রুহের মাগফেরাত কামনা করে মিলাদ ও শিরনি বিতরণের আয়োজন করেছিলেন মুহিবুর রহমান মানিক এমপি। এতে তিনি দাওয়াত দিয়েছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানকে। বৃহস্পতিবার এই আয়োজনে উপস্থিত হন পরিকল্পনামন্ত্রী। এতে চমকে উঠেন সবাই। এমন ঘটনা সচরাচর সুনামগঞ্জের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দেখা যায়নি। এ কারণে মন্ত্রীর উপস্থিতি নতুন বার্তা দিয়েছে সুনামগঞ্জের আওয়ামী রাজনীতিতে। এতে উপস্থিত হয়ে মন্ত্রী এম এ মান্নান মুহিবুর রহমান মানিককে উদ্দেশ্য করে বলেন- ‘মামু-ভাগ্নের সম্পর্ক এত ঠুনকো নয় যে, এত তাড়াতাড়ি ভেঙে যাবে, এই সম্পর্ক সবসময় অটুট থাকবে।’ তার কথায় হেসে সায় দেন মানিকও।

মূলত এর মধ্য দিয়ে উভয়ের দীর্ঘদিনের শীতল সম্পর্কের অবসান ঘটলো বলে মনে করছেন সবাই। এতে যোগদান করে মন্ত্রী মুহিবুর রহমান মানিকের পিতা-মাতার কবরও জিয়ারত করেন। এই ঘটনায় হাওর জনপদ সুনামগঞ্জের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হয়েছে বলে মনে করছেন সবাই। আর তাই যদি হয়; এতে একা হয়ে যেতে পারেন সুনামগঞ্জের আওয়ামী রাজনীতির একাংশের নিয়ন্ত্রক ও প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হুদা মুকুট। খুব শিগগিরই শেষ হচ্ছে জেলা পরিষদের মেয়াদ। এতে প্রশাসক বসানো নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রশাসক হতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও। আর এতে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে ছাতকের মেয়র কালাম চৌধুরীর রাজনীতিও। দীর্ঘদিন ধরে ছাতকে এমপি ও মেয়র গ্রুপের দ্বন্দ্ব চলছে। এই দ্বন্দ্বের কারণে ছাতকেও রয়েছে বিভক্তি।

কেন্দ্রীয় সদস্য হওয়ার পর সুনামগঞ্জের রাজনীতি নিয়ে নীরবতা পালন করছেন আব্দুস সামাদ আজাদের ছেলে আজিজুস সামাদ ডন। স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে প্রথমে আগ্রহী থাকলেও পরবর্তীতে তিনি নীরব হয়ে যান। তার এই ‘নীরবতা’ আরও রহস্যের জন্ম দিচ্ছে বলে মনে করেন সুনামগঞ্জের সামাদ বলয়ের নেতারা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn