সুনামগঞ্জ  :: সুনামগঞ্জে সরকারি খাদ্যগুদামে ন্যায্যমূল্যে বোরো ধান সংগ্রহের নামে চরম দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কৃষি অফিসার, খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, উপজেলা প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিবাজসহ ফড়িয়া ও দালাল সিন্ডিকেট কৃষকের কার্ড নিয়ে নিজেরাই গুদামে ধান দিচ্ছে। লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচনের নামেও প্রহসণ করছেন সংশ্লিষ্টরা। ওই সিন্ডিকেট লটারির মাধ্যমে মৃত ব্যক্তি ও একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তিকেও নির্বাচিত করছে এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে। অন্যদিকে প্রকৃত কৃষকরা ধান দেওয়ার চেষ্টা করলেও দালাল ও ফড়িয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকায় খাদ্যগুদামে ধান দেওয়ার সুযোগ পাননি। জেলা খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে সরকার দুই দফা হাওরের কৃষকদের কাছ থেকে ১ হাজার ৪০ টাকা মন দরে ১৭ হাজার ৪০৩ মে.টন ধান বরাদ্দ দেয়। দুই দফা জেলায় প্রায় ২৫ হাজার কৃষক নির্বাচিত করা হয়। নির্বাচিত কৃষকরা ৪০০ কেজি থেকে ১ টন, কেউ কেউ দুই টন ধানও বরাদ্দ পেয়েছেন। গত ১৮ মে থেকে সুনামগঞ্জে ধানসংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। শেষ হবে ৩১ আগস্ট। তবে কৃষকের নামে ধান দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে সিন্ডিকেট নির্ধারিত দালাল ও ফড়িয়ারাই কৃষকের কার্ড জিম্মি করে তাদের নামে ধান দিয়ে লাভবান হচ্ছে। কৃষক নির্বাচনের নামে ধাপে ধাপে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে মনে করেন কৃষক নেতারা।
কৃষক আন্দোলনের নেতারা জানান, মাঠে গিয়ে উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের তালিকা সংগ্রহ করার কথা থাকলেও কৃষকদের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। তারা মওসুমে ইউপি চেয়ারম্যানদের কার্যালয়ে বসে কৃষকের তালিকা ও কৃষক বাছাই করেন। কৃষকদের মওসুমে কোন সহযোগিতা করেননা তারা। কেবল কৃষি ভর্তুকি ও ধান সংগ্রহের সময় এলেই বøক সুপার ভাইজাররা ইউপি চেয়ারম্যানদেও অফিসে গিয়ে কৃষকের তালিকা করে। মাঠে না যাওয়ায় প্রকৃত কৃষকরা বাদ পড়েন। এভাবে ধান সংগ্রহ অভিযানের সময়ও সকল কৃষককে খবর না দিয়ে ইউপি চেয়ারম্যানদের কার্যালয়ে বাছাই করায় অধিকাংশ চেয়ারম্যান তার পছন্দের লোকদেরই আমন্ত্রণ জানান। এসময় ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাও কৃষক নির্বাচনে প্রভাব খাটায়। ফলে প্রকৃত কৃষকরা ধান দেওয়ার সুযোগ পায়না। সকল কৃষকের কাছে খবর না পৌঁছানোয় তারা ইচ্ছে থাকা সত্বে¦ও সরকারকে ধান দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাছাড়া উৎপাদনের তুলনায় বরাদ্দ কম থাকার কারণেও অনেক কৃষক বঞ্চিত হচ্ছেন বলে জানা গেছে।
তাহিরপুর উপজেলায় ১ হাজার ৪১৫ মে. টন ধান বরাদ্দ পেয়েছেন কৃষক। উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে প্রায় ৩০ হাজার কৃষকের কাছ থেকে বাছাই করে এ ধান সংগ্রহ করার কথা। কিন্তু সিন্ডিকেট কৌশলে লটারি ডেকে পছন্দের কৃষক নির্বাচিতসহ ফড়িয়ারা কৃষকের সংগৃহিত কার্ড দিয়ে ধান দেওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এতে প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চিত হয়েছেন। তাহিরপুরের উত্তর বড়দল ইউপির ৫নং ওয়ার্ড সদস্য আবু তাহের জানান, তার ওয়ার্ডে একই পরিবারের তিন জনকে কার্ড প্রদান করা হয়েছে। তারা হলেন, পুরানঘাট গ্রামের আমির উদ্দিনের ছেলে আ. ছাত্তার তার ছোট ভাই আ. মোতালেবের ছেলে কাজল মিয়া ও তার ছোট ভাই আ. গফফারের স্ত্রী ছাবিনা। এভাবে সিন্ডিকেট তাদের নাম মনোনীত করে গুদামে ১০৪০ টাকা মন ধরে ধান দিতে মনোনয়ন করা হয়।
একই ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড সদস্য নোয়াজ আলী জানান, তার ওয়ার্ডে একই পরিবারের মাহারাম গ্রামের আলাল উদ্দিনের ছেলে বিল্লাল মিয়া ও তার ভাই গণি মিয়ার ছেলে জমসেদ মিয়া নির্বাচিত হয়েছেন। একই ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড সদস্য স¤্রাট মিয়া জানান, এই ওয়ার্ডের রাজাই গ্রামের ১৭১নং কার্ডের গবীন্দ্র হাজং এক বছর আগেই মারা গেছেন। তার নামেও কার্ড ইস্যু করেছে সিন্ডিকেট। মূলত ওই কার্ডটি সংগ্রহ করে সিন্ডিকেট নিজেরাই ধান দিচ্ছে বলে জানান তিনি। একই ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড সদস্য মোহাম্মদ আলী জানান, এই ওয়ার্ডের ব্রাক্ষণগাঁও গ্রামের ০৪৯৫ নং কৃষি কার্ডধারী আ. মালেক তিন বছর আগে মারা গেছেন। তার কার্ড সংগ্রহ করেও তার নামে ধান দিচ্ছে সিন্ডিকেট। এভাবে অসচেতন কৃষকদের নাম দিয়ে নিজেরাই গুদামে ধান দিয়ে কৃষকদের বঞ্চিত করে লাভবান হচ্ছে ফড়িয়ারা। এই সুযোগ করে দিচ্ছে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা, উপজেলা প্রশাসনের লোক, উপজেলা কৃষি অফিস ও খাদ্য অধিদপ্তরের কতিপয় দুর্নীতিবাজ।
জামালগঞ্জ উপজেলায়ও কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা সিন্ডিকেট করে গুদামে ধান দিচ্ছেন এমন অভিযোগ আছে। এ কারণে কিছুদিন ধানসংগ্রহ স্থগিত ছিল। এভাবে ১১ উপজেলায়ই ফড়িয়াড়া কৌশলে কৃষকের কৃষি কার্ড জব্দ করে গুদামে ধান দিচ্ছে। গুদামে ধান ডুকানো বাবত খাদ্য বিভাগ প্রতি টনে ২ হাজার টাকা নেয় বলে অভিযোগ আছে। জামালগঞ্জের ফেনারবাক ইউপির নাজিম নগর গ্রামের কৃষক আবদুল মজিদ বলেন, আমাদের ৭ নং ওয়ার্ডে খবরই দেওয়া হয়নি। আমরা খবর পেয়ে নিজ থেকে ধান দেওয়ার চেষ্টা করলে আমাদের কার্ড গ্রহণ করা হয়নি। একই এলাকার উদয়পুর গ্রামের কৃষক আজিজুর রহমানও জানালেন কার্ড থাকা সত্বেও তিনি ধান দিতে পারেননি। তাদেরকে লটারিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে কৃষকের নামে তাদের কার্ড এনে ধান দেওয়া হলেও লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্তভোগীরা। তারা কৃষকের নাম দিয়ে নিজেরাই গুদামে ধান দিচ্ছে প্রতিদিন। কৃষক কার্ড দেওয়ায় তাকে ১ হাজার ২ হাজার টাকা বখশিশ দিচ্ছে ফড়িয়া। গুদাম ও ব্যাংকে কৃষকদের উপস্থিত করতে হয় বলেই এই দুটি জায়গায় তাদের উপস্থিত নিশ্চিত করে ফড়িয়া। তারপর কার্ড রেখে তাদের বিদায় করে দেয়।
বৃহষ্পতিবার (৮ আগস্ট) দুপুরে সদর উপজেলা খাদ্য গুদামের ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায় ধান শুকাচ্ছেন কৃষক। ধানে আদ্রতা কম থাকায় শুকানোর জন্য নির্দেশনা দিয়েছে খাদ্য বিভাগ। এসময় দেখা যায় দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের ব্যবসায়ী শফিকুলের ধান নাড়ছেন এক ব্যক্তি। তিনি জানান, শফিকুল বিভিন্ন কৃষকের কার্ড এনে তাদের নামে তিনিই ধান দিচ্ছেন। তারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। একই সময় দেখা গেল একই উপজেলার পিঠাপই গ্রামের মধ্যস্বত্তভোগী নজরুল ইসলাম গুদামে ধান দিতে ট্রাক ভরে ধান নিয়ে এসেছেন। তিনি কয়েকজন শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছেন ধান শুকিয়ে গোদামে দেবার জন্য। একজন শ্রমিক জানালেন, নজরুল বিভিন্ন এলাকার কৃষকের কার্ড এনে তাদের নামে ধান দেন। জেলা খাদ্য অফিসার জাকারিয়া মোস্তফা বলেন, কৃষকের তালিকা করেছে কৃষি বিভাগ। আমরা তাদের কাছ থেকে তালিকা নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিলে বাছাই করেছি। মধ্যস্বত্তভোগীরা কিভাবে ধান দিচ্ছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মধ্যসত্ত¡ভোগী বা কৃষক কে তা আমরা যাছাই করতে পারিনা। আমরা যার কাছে কৃষি কার্ড আছে তাদের কার্ড দেখেই নির্বাচিতদের মধ্য থেকেই ধান নিচ্ছি। আমাদের কেউ দুর্নীতিতে জড়িত নই।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn