সুনামগঞ্জে প্রবীণদের চ্যালেঞ্জ নবীনদের
মাসুম হেলাল-
সুনামগঞ্জের পাঁচটি আসনেই নিজ দলের নবীন মনোনয়নপ্রত্যাশীদের চ্যালেঞ্জ জিতে চূড়ান্ত নির্বাচনী লড়াইয়ে নামতে হবে প্রবীণদের। সংসদীয় পাঁচটি (২২৪, ২২৫, ২২৬, ২২৭ ও ২২৮) আসনে প্রবীণদের পাশাপাশি এবার মাঠে রয়েছেন শক্তিশালী অনেক নবীন মনোনয়নপ্রত্যাশী। নানা কারণে অনেক আসনেই মনোনয়ন দৌড়ে পিছিয়ে আছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলের প্রবীণরা। নির্বাচন নিয়ে এমন জটিল সমীকরণ থাকায় এবার আগাম পর্যবেক্ষণ করে সম্ভাব্য ফলাফল নির্ধারণ করা বেশ কঠিন। এ জেলায় আলোচনার শীর্ষে রয়েছে জাতীয় পার্টির আসন-খ্যাত সুনামগঞ্জ-৪ (সদর-বিশ্বম্ভরপুর) আসন। জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচনে না অংশ নিলে গত বছরের মতো এবারও মহাজোটের প্রার্থী হবেন জাতীয় পার্টির তরুণ এমপি সাবেক ছাত্রনেতা অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক হুইপ অ্যাডভোকেট ফজলুল হক আছপিয়া এবং চারবারের উপজেলা চেয়ারম্যান জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি দেওয়ান জয়নুল জাকেরীনের। বিএনপি যাকেই মনোনয়ন দিক অথবা আওয়ামী লীগ আলাদা প্রার্থী দিক, মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে জাতীয় পার্টির তরুণ এমপি পীর ফজলুর রহমান মিসবাহর সঙ্গেই।
সার্বিকভাবে জেলার পাঁচটি আসনের চারটিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। কারণ হিসেবে গত উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়জয়কারের যুগে জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে চেয়ারম্যান পদে আটটিতেই বিজয়ী হয় বিএনপি। আর সদর আসন দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পার্টির দখলে থাকায় সেটির ফলাফল নির্ধারণ করবে দলটি একক নাকি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করবে এর ওপর।
সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর-ধর্মপাশা-জামালগঞ্জ) : জেলার বৃহৎ এই আসনটিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি দুই দলেরই সর্বোচ্চ সংখ্যক সম্ভাব্য প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের বর্তমান এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি, অঢেল কালো টাকা কামানোর অভিযোগ করে নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন পাঁচ সম্ভাব্য প্রার্থী। তাদের একজন গত নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ রফিকুল ইসলাম সোহেল। অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আক্তারুজ্জামান সেলিম, সাবেক যুগ্ম-সচিব বিনয়ভূষণ তালুকদার, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক শামীমা শাহরিয়ার, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রঞ্জিত সরকার এবং জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক খন্দকার মুঞ্জুর আহমেদ। এদিকে সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাবেক এমপি নজির হোসেন সম্প্রতি বিএনপিতে ফেরায় দলের মনোনয়ন লড়াইয়ের হিসাব অনেকটা ওলটপালট হয়ে গেছে। নজির হোসেনের পাশাপাশি ভোটের মাঠে রয়েছেন ২০০৮-এর নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ড্যাবের কেন্দ্রীয় নেতা ডা. রফিক আহমদ চৌধুরী, তাহিরপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুল হক, বর্তমান চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল ও ধর্মপাশা উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব খান।
সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই, শাল্লা) : অতীতে এ আসনে নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি দ্বৈত লড়াই হতো আওয়ামী লীগের প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও বিএনপির নাছির উদ্দিন চৌধুরীর মধ্যে। সুরঞ্জিতের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী জয়া সেনগুপ্তা উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে এখন এ আসনের সংসদ সদস্য। রাজনীতিতে নবাগত ও বার্ধক্যের ভারে ন্যুব্জ জয়া সেন দলের ‘খাই খাই’ পার্টির লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কেন্দ্র যদি তা আমলে নেয় তবে আগামী নির্বাচনে বিকল্প প্রার্থী আসতে পারে এ আসনে। আর সেই শূন্যস্থান পূরণে জোরেশোরে মাঠে রয়েছেন সিলেট জজ কোর্টের অতিরিক্ত পিপি ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সম্ভাব্য এই প্রার্থীকে জয়া সেনের বিকল্প হিসেবে দেখছেন দলের বড় একটি অংশের নেতা-কর্মীরা। এই আসনে বরাবরের মতো এবারও বিএনপির একক মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক নাছির উদ্দিন চৌধুরী। আওয়ামী লীগ যাকেই প্রার্থী করুক না কেন, নির্বাচনে তাকে নাছিরের সঙ্গে কঠিন লড়াইয়ে নামতে হবে।
সুনামগঞ্জ-৩ (দক্ষিণ সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর) : গত নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী প্রয়াত জাতীয় নেতা আবদুস সামাদ আজাদপুত্র আজিজুস সামাদ ডনকে সামান্য ভোটে পরাজিত করে এ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান। আগামী নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়নের ব্যাপারে মান্নানকে ছাড় দেবেন না সামাদপুত্র ডন।
সুনামগঞ্জ-৩ আসনে ২০০৮-এর নির্বাচনে বিএনপি জোট থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের অ্যাডভোকেট মাওলানা শাহীনূর পাশা চৌধুরী। সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় বিভিন্ন ইস্যুতে শাহীনূর পাশার সঙ্গে বিএনপির চরম মতবিরোধ সৃষ্টি হওয়ায় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দিতে চাইছে বিএনপি। জেলা বিএনপির চার সহ-সভাপতি কর্নেল আনছার উদ্দিন, ফারুক আহমদ ও নূরুল ইসলাম সাজু দলের মনোনয়ন চাইবেন। তবে আওয়ামী লীগের সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক ও বিএনপির এম কয়ছর আহমদ—দল দুটির যুক্তরাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা এই দুই নেতা নির্বাচনে চমক দেখাতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
সুনামগঞ্জ-৪ (সদর-বিশ্বম্ভরপুর) : বর্তমানে এ আসনে মহাজোট মনোনীত সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। জোটবদ্ধ অথবা একক, যেভাবেই নির্বাচন হোক, দীর্ঘদিনের ঘাঁটি সদর আসনটি কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেবে না জাপা। ফলে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন জাতীয় পার্টির তরুণ এমপি পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। জেলার বিভিন্ন এমপি ও জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে পারিবারিক ব্যবসা, নিজস্ব লোক দিয়ে টেন্ডার, বালুমহাল, হাট-বাজার দখল ও বিভিন্ন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ থাকলেও পীর মিসবাহর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তার পারিবারিক কোনো ব্যবসা নেই। তিনি জেলা বারের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নির্বাচিত হলে তার পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় থাকবেন না। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তার স্ত্রী-সন্তানেরা সুনামগঞ্জেই থাকেন। সংসদ অধিবেশন ছাড়া মিসবাহ ঢাকায় অবস্থান করেন না বললেই চলে। সদর আসনে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে তিনি শক্তিশালী করেছেন জাতীয় পার্টিকে। জাতীয় পার্টির ব্যানারে গত ইউপি নির্বাচনে দুজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। সর্বোপরি এলাকায় ক্লিন ইমেজ হিসেবে পরিচিত পীর মিসবাহ। তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী নেই। এলাকার সাধারণ মানুষ ভারসাম্য পেয়েছেন। এ এলাকায় নেই কোনো রাজনৈতিক নিপীড়ন। সদর আসনে বিএনপির বিরুদ্ধে পীর মিসবাহই শক্তিশালী প্রার্থী বলে মনে করছেন ভোটাররা। এ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে লড়াই করতে বর্তমানে মাঠে আছেন দলের জেলা সভাপতি আলহাজ মতিউর রহমান, সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও জাতীয় কমিটির সদস্য আয়ুব বখত জগলুল এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম এমামুল কবির ইমন। এদিকে সদর আসনে বিএনপির শক্তিশালী সম্ভাব্য প্রার্থী চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক হুইপ অ্যাডভোকেট ফজলুল হক আছপিয়া। তিনবারের সাবেক এই এমপির বিপরীতে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন চারবারের উপজেলা চেয়ারম্যান জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি দেওয়ান জয়নুল জাকেরীন ও সহ-সভাপতি আবদুল লতিফ জেপি। যুক্তরাজ্য বিএনপির সহ-সভাপতি গোলাম রব্বানী আহমদও এ আসনে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। নির্বাচনে জাপা, আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি থেকে প্রার্থী যাকেই করা হোক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে এ আসনে।
সুনামগঞ্জ-৫ (ছাতক-দোয়ারাবাজার) : এ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের মুহিবুর রহমান মানিক। দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে নিজ দলের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। প্রতিপক্ষ মোকাবিলায় নিজ বাসায় বোমা বিস্ফোরণের পর ‘বোমা মানিক’ তকমা পেয়েছিলেন সাবেক বামপন্থি এই নেতা। মানিকের বিরুদ্ধে টানা দুই আমলে রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ নিয়ে ভোটের মাঠে এবার সরব তার পুরনো প্রতিপক্ষ ছাতক পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম চৌধুরীর ছোট ভাই ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা শামীম আহমদ চৌধুরী। সুনামগঞ্জ-৫ আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইবেন জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি শিল্পপতি ইঞ্জিনিয়ার মুনসিফ আলী। তবে এ আসনে ভোটের রাজনীতিতে জামায়াতের মোটামুটি ভালো অবস্থান থাকলেও বিগত উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে চরম বিরোধ রয়েছে দলটির। বিগত উপজেলা নির্বাচনে এ আসনের দুটি উপজেলায় জামায়াতের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে অল্প ভোটে পরাজিত হন। ভোটের পর থেকে পরাজয়ের পেছনে বিএনপির বিরোধিতাকে দায়ী করে আসছে জামায়াত। শেষ মুহূর্তে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের আপস রফা না হলে দলটি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেবে। আর এতে করে সুবিধা পাবে আওয়ামী লীগ।