আল-হেলাল,সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি: ৫ জুন শনিবার সুনামগঞ্জ জেলা বাউল কল্যাণ সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত মত বিনিময় সভায় বক্তারা করোনাকালীন দূর্যোগে পঞ্চরত্ন বাউলের দেশ সুনামগঞ্জের বাউল শিল্পীদের পূণর্বাসনে এগিয়ে আসার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তারা বলেছেন,এবার দূর্যোগের মধ্যেও সুনামগঞ্জ জেলায় বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাউল শিল্পীদের নিজস্ব কোন কৃষিজমি নেই। নেই থাকার জন্য ভিটেবাড়ী। এহেন অমানবিক অবস্থায় গত দুটি বছর আমরা করোনা উপসর্গের মধ্যে কোথায়ও গান গাইতে পারিনি। আমাদের রুটিরুজি বলতে কিছুই নেই। তাই আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাবী জানাই আশ্রায়ন প্রকল্প ও দুর্যোগ সহনীয় বাড়ি তৈরীর প্রকল্পের আওতায় আমাদেরকে মাথাগুজার ঠাই দিন। পাশাপাশি করোনাকালীন আর্থিক অনুদানের আওতায় সুনামগঞ্জের বাউল শিল্পী ও যন্ত্রশিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখুন। শনিবার জেলা শিল্পকলা একাডেমীর মুহাম্মদ আব্দুল হাই মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই সভায় জেলার ২০০ জন প্রবীণ ও নবীন বাউল শিল্পীদের মিলন মেলায় এসব দাবী জানানো হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা গীতিকার নুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সভাপতি বাউল শাহজাহান সিরাজ। প্রধান বক্তার বক্তব্য রাখেন বাউল কামাল পাশা সংস্কৃতি সংসদ সুনামগঞ্জ এর আহবায়ক ও বাউল কল্যাণ সমিতির সাধারন সম্পাদক সাংবাদিক বাউল আল-হেলাল। অন্যান্যর মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাউল মনির উদ্দিন,বাউল তছকীর আলী,বাউল মছলন্দর আলী,অন্ধ বাউল রিয়াজ উদ্দিন,বাউল উদাসী মুজিব,গীতিকার আসাদ আলী,বাউল মনির উদ্দিন নুরী,বাউল দিলাল উদ্দিন,বাউল কবির উদ্দিন আমিরী,বাউল আলতাব আলী,বাউল সমর উদ্দিন,বাউল আনোয়ারুল হক শ্যাম,বাউল শফিকুন নূর,বাউল হীরামোহন দাস, বাউল রসিদ উদ্দিন,বাউল যোবায়ের বখত সেবুল,গীতিকার নির্মল কর জনি,বাউল সৈয়দুর রহমান, ফারজানা আক্তার আশা,হানিফ মিয়া,ফারজানা আক্তার আশা,লেচু সরকার,বাউল আক্কল আলী,বাউল শুকুর আলী,বাউল আলতু মিয়া, বাউল সমসন নুর, বাউল রফিক মিয়া,বাউল হাফিজ উদ্দিন,বাউল সাজিদ মিয়া,বাউল সিরাজ উদ্দিন, বাউল লেচু বেগম, বাউল ফিরিজ আলী, বাউল ডলি আক্তার, বাউল জমিলা বেগম,বিরহী রিপা, বাউল হ্যাপী আক্তার,বাউল শাফলা সরকার, বাউল সিরাজ মিয়া,বাউল সফর আলী, বাউল শিল্পী আব্দুল কাহার,তারা মিয়া মাস্টার,গীতিকার শফিকুল ইসলাম শফিক, গীতিকার হেলাল তালুকদার,স্বাধীনা আক্তার,আশিক ভান্ডারী,কবির উদ্দিন,সোহরাব আলী,শুক্কুর আলী,হারুন সরকার,বাউল সোনিয়া পলাশী,বাউল সেলিম সরকার,বাউল পূর্নিমা আক্তার ও বাউল ফারজানা আক্তার প্রমুখ। 

সভায় আগামী ১৮ ও ১৯ শে জুন আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সুনামগঞ্জে ২ দিনব্যাপী বাউল উৎসব এর আয়োজন এর সিদ্ধান্ত হয়। এতে সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত বাউল শিল্পীদের মধ্যে প্রদান করা হবে পরিচয় পত্র। সতর্ক করে দেয়া হয়,কোন মেয়ে শিল্পী বা পুরুষ শিল্পী গুণীজনের গানে অন্য কোন ব্যক্তির নাম ব্যবহার করতে পারবেনা। বাউল গান পরিবেশন করার সময় নৃত্য বা অম্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয় মহিলা শিল্পীদেরকে। অভিভাবক ছাড়া কোন অনুষ্ঠানে যেতে এবং সংগঠনের অনুমতি ছাড়া কোন ক্লাবে গান পরিবেশন করা থেকে বিরত থাকার জন্য মেয়ে শিল্পীদের নির্দেশ দেয়া হয়। সর্বোপরী সুনামগঞ্জের শিল্পীদেরকে নকল বা রেকর্ডিং এর গানের পরিবর্তে জেলার গুনী সাধক মহাজনদের গান পরিবেশনে উৎসাহিত করা হয়।

সভায় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার অন্ধ বাউল শিল্পী রিয়াজ উদ্দিন তার কষ্টের কথা উল্লেখ করে বলেন,করোনা ভাইরাসের আগে আমি আদালত পাড়ায় খোলা আকাশের নীচে গান গেয়ে সংসার চালাতাম। করোনা আসার পর দীর্ঘ দুই বছর যাবত গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছিনা। পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে আমার দিন কাটছে। আমি কোন সরকারি সাহায্য পাইনি। এগুলো শুধু তার কথা নয় জেলার এক হাজার বাউল শিল্পীর কথা। শনিবার বিকেলে তিনি জেলা বাউল কল্যান সমিতির মতবিনিময় সভায় এসে তার দিনযাপনের গ্লানির কথা বলছিলেন। বাউল শিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বলেন, বাউলদের কোন জায়গা জমি নেই। গান গাওয়া ছাড়া বিকল্প কোন কাজ জানেন না তারা। প্রতি বছর শীত এলে একতারা, দোতারা, ঢোল, বেহালা, সারিন্দা নিয়ে গানের আসরে গান গেয়ে অর্থ উপার্জন করেন। করোনার জন্য তাদের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বাউলদের জন্য বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ না করলে বাউল গান ও বাউল শিল্পীদের জীবন হুমকির মুখে পড়বে। প্রবীণ অসুস্থ বাউল শিল্পী তছকির আলী বলেন, বাউল শিল্পীরা গানের উপর নির্ভরশীল। এখন গান নেই আসর নেই কোথাও গানের আসর বসে না কোথাও যাওয়া যায়না। বাউলরা বর্তমানে অসহায়ের মতো জীবন যাপন করছেন। সরকার যে শিল্পী ভাতা দেয় তা দিয়ে কিছুই হয় না। খুব কম সংখ্যক শিল্পী সরকারি ভাতা পান বেশির ভাগ শিল্পী ভাতার বাইরে রয়ে গেছেন। বাউল শিল্পী উদাসী মুজিব বলেন, গান ছাড়া আমাদের চলার কোন পথ নেই আমাদের কোন ক্ষেত কৃষি নেই ব্যবসা বাণিজ্য নেই। গানের আসর ওরস মাহফিল যেখানে হয় সেখানেই আমাদের রিজিক থাকে। সব বাউলের একই কথা গান আর গান। বাউলরা গান ভিন্ন আর কিছু জানেন না। তাই বাউলের প্রতি সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। বাউল বিরহী রিপা বলেন, জেলায় ৭০ থেকে ৮০ জন মহিলা বাউল শিল্পী রয়েছেন। পুরুষ বাউল শিল্পীদের পাশাপাশি তারাও আসরে ওরসে গান পরিবেশন করে সংসার চালাতেন তাদের আয়-রোজগার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। বাউল শিল্পী লেচু আক্তার বলেন, সরকার শুনছি করোনার সময়ে কতজনরে কতভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেন কিন্তু জেলার বেশির ভাগ বাউল শিল্পী এখনও মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বাউল শফিকুন নূর বলেন,২০২০ সাল থেকে তাদের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও কোন ওরস হয় না হয়না বাউল গানের আসর। শীত এলে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় শতশত বাউল শিল্পী বিভিন্ন আসরে গান গেয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু পরপর দুটি শীতকাল চলে গেছে আমাদের আয় রোজগারের কোন ব্যবস্থা হয়নি। তাই অনেক কষ্টে দিন কাটছে আমাদের।

সহ সভাপতি গীতিকার মোঃ আসাদ আলী আল মাইজভান্ডারী বলেন, সুনামগঞ্জ বাউলের জেলা এ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ,মরমী কবি হাছনরাজা,গানের সম্রাট  বাউল কামাল পাশা,বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম,জ্ঞানের সাগর দূবীণ শাহসহ অনেক খ্যাতিমান শিল্পী। তাই অনেকটা উত্তরাধিকার সুত্রে সুনামগঞ্জে বাউল গানের চর্চা বেশি হয়। এ জেলার বাউল সংস্কৃতি রক্ষা করতে সরকারি বেসরকারি ভাবে বাউলদের পৃষ্টপোষকতা করতে হবে। সংগঠনের সাধারন সম্পাদক সাংবাদিক বাউল আল হেলাল বলেন, এবার সুনামগঞ্জে বাম্পার ফলন হয়েছে সত্য। এক কেদার বোরো ধানের ক্ষেতে ২৪ মনের জায়গায় ৩০ মন ধানের ফলন হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাউলদের ফসলি জমি নেই, ঘরে নেই খাবার। অনেক বাউলদের মাথা গুজার ঠাই নেই। আবার অনেকের ঘর তৈরির জায়গা নেই। তারা অন্যের বাড়িতে ঘর তৈরি করে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করেন মানবেতরভাবে। সরকারের দূর্যোগ সহনীয় বাড়ি ও আশ্রায়ন প্রকল্পের আওতায় এ জেলায় হাজার হাজার মানুষকে ঘরবাড়ী তৈরী করে দেয়া হয়েছে অথচ আমাদের কোন বাউলরা একটি ঘর পর্যন্ত পাননি। মুজিববর্ষে সুনামগঞ্জের বাউলদের জন্য সরকারিভাবে ঘর প্রদানের দাবি জানান তিনি।

মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহনকারী বাউল শিল্পীদের দাবি আগামী শীতকালে যেন জেলার বাউল শিল্পীরা স্বাস্থ্য বিধি মেনে গানের আসর করতে পারেন এবং শিল্পীদের করোনা কালীন ভাতার পরিমান ও সংখ্যা আরও বাড়ানোর দাবি করেন সরকারের কাছে। সুনামগঞ্জ জেলা বাউল কল্যান সমিতির সভাপতি বাউল শাহজাহান সিরাজ বলেন, সারা জেলায় এক হাজার হতদরিদ্র বাউল শিল্পী রয়েছেন তাদের মধ্যে সরকারি সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছেন মাত্র দেড়শত জন। বেশির ভাগ শিল্পী সরকারি ভাতা পান না। করোনাকালে গানবাজনা বন্ধ থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে আমরা অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। বাউল শিল্পীদের  পূণর্বাসনের জন্য সরকারের বিশেষ প্রকল্প গ্রহণের দাবি করেন তিনি। শনিবার বিকেলে শহরের কালীবাড়ি এলাকায় পুরাতন শিল্পকলা একাডেমীর আব্দুল হাই মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত মত বিনিময় সভায় ভাতা বঞ্চিত বাউলরা ভাতা ও সরকারি ঘর প্রদানের দাবি করেন। মতবিনিময় সভায় সদর,দিরাই,দক্ষিণ সুনামগঞ্জ তাহিরপুর ও জামালগঞ্জসহ ১১ টি উপজেলার ২ শতাধিক বাউল শিল্পী অংশগ্রহন করেন। জেলার ১১ টি উপজেলায় একহাজার বাউল শিল্পী রয়েছেন। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে দুই বৎসর যাবত কোন গানের আসর না হওয়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ভাইরাসের সংক্রমনের কারণে তাদের পালাগান, আসর গান ও ওরস গান সহ সব ধরনের গান আসর বন্ধ রয়েছে। বাউল শিল্পীরা জানান, জেলার এক হাজার বাউল শিল্পীর মধ্যে মাত্র ৫৬ জন শিল্পী অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবী ভাতা পান। এর মধ্যে ২৮ জন হচ্ছেন বাউল শিল্পী। ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা হারে করোনাকালীন অনুদান পেয়েছেন ১০০ জন শিল্পী। এর মধ্যে বাউল শিল্পী হচ্ছেন মাত্র ৩০ জন।  সর্বশেষ ৫শত টাকা ও ১০ কেজি চাল পেয়েছেন শহরতলীর প্রায় ৪০ জন বাউল শিল্পী। কিন্তু ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন চেয়ারম্যানও কোন বাউল শিল্পীকে সরকারের দেয়া ৫শত টাকা বা ১০ কেজি চাল প্রদান করেননি। উপজেলা পর্যায়ে শিল্পকলা একাডেমী বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের মাধ্যমে কোন বাউল শিল্পীদের সহায়তা প্রদান করা হয়না। সরকারী অনুষ্ঠানগুলোতে বাউল শিল্পীদের ডাক পড়েনা। এমনকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ১০১ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সুনামগঞ্জে জেলা আওয়ামীলীগ আয়োজিত সমাবেশে স্থানীয় কোন বাউল শিল্পীদেরকে ঢাকা হয়নি। অথচ ঢাকা থেকে শিল্পী এনে যে টাকা প্রদান করা হয়েছে সেই টাকায় সুনামগঞ্জের ২০০ জন বাউল শিল্পীকে সহায়তা দেয়া সম্ভব হতো। সরকারী তালিকা প্রণয়নের বেলায় ব্যক্তিবিশেষের সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটালেও বাউল শিল্পীদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়না। এমনকি সরকারী অনুষ্ঠানগুলোতেও বাউল শিল্পীরা উপেক্ষিত থাকেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানগুলিতে সুনামগঞ্জের মুলধারার বাউল শিল্পীদের রচিত মৌলিক গানগুলো পরিবেশনের কোন সুযোগ দেয়া হয়নি বাউল শিল্পীদেরকে। 

জেলা কালচারাল অফিসার আহমেদ মঞ্জুরুল হক চৌধুরী  পাভেল বলেন, বাউল শিল্পীদের জন্য বিশেষ কোন প্রকল্প নেই। এ পর্যন্ত ১৮৭ জন শিল্পীকে ভাতা ও করোনাকালীন অনুদান প্রদান করা হয়েছে। সরকার যদি বাউল শিল্পীদের জন্য আলাদা কোন প্রকল্প গ্রহণ করেন তাহলে অবশ্যই তারা সহযোগিতা পাবেন।

 

 

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn