সুনামগঞ্জে সুরমার পেটে ঘরবাড়ি-ফসলি জমি
শহীদনূর আহমেদ :: দিন দিন সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর ভাঙ্গন তীব্রতর থেকে তীব্র হচ্ছে। অব্যাহত ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে জেলার বিভিন্ন উপজেলার বসতবাড়ি, ফসলি জমি, স্কুল কলেজ, মসজিদ মাদরাসাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এতে বদলে যাচ্ছে জেলার মানচিত্র। নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনের কারণে অনেক পরিবার ইতোমধ্যে সব হারিয়ে নি:স্ব হয়েছে। ভাঙ্গনের শিকার এসব মানুষ কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। নদী ভাঙ্গন রোধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানিয়েছেন সুরমাপাড়ের মানুষজন।
সরেজমিনে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার রঙ্গারচর ইউনিয়নের হরিনাপাটি গ্রামে গেলে স্থানীয়রা জানান, সেই পাক আমল থেকে শুরু হওয়া সুরমা নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে ঐতিহ্যবাহী হরিনাপাটি গ্রামের মানচিত্র এখন পাল্টে গেছে। কত কত ঘরবাড়ি, দোকানপাট, গাছ-গাছালী জমি-জমা নদীর বুকে বিলীন হয়ে গেছে তার কোন হিসেব-নিকেশ নেই। ঘরবাড়ি হারা মানুষের আর্তনাদ আজো স্থানীয়দের কানে বেজে উঠে। যুগ যুগ ধরে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে নদী ভাঙ্গন এখন গ্রামের মূল ভূ-খন্ডে এসে আঘাত করছে। হরিনাপাটি বাজারটি কতবার ভাঙ্গন লীলা-খেলায় ধ্বস নেমেছে তার কোন হদিস নেই। একদিকে দোকানপাট নদীতে বিলীন হয় অন্যদিকে বাজার সরিয়ে নেয়া হয়। এভাবে কতবার যে বাজারটিকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে তা স্থানীয়দের জানা নেই। বাজারের সামনের খেলার মাঠটি এখন নদীর ওপাড়ের ধানি জমি হয়েছে। ভাঙ্গন লীলা-খেলার চিত্র দেখে ঘরবাড়ি হারা মানুষের আহাজারী আর কান্না থামছে না। মানুষের কান্নার সাথে থেমে নেই নদী ভাঙ্গন। প্রতিনিয়ত ভাঙ্গছে। গ্রামের বাজার হাটির এখন আর অস্থিত্ব নেই। পূর্ব হাটির অস্থিত্ব প্রায় বিলীন হওয়ার পথে।
স্থানীয় লোকজন জানান, তাদের বাপ-দাদার ঐতিহ্য ঘেরা গ্রামের নকশা (মানচিত্র) এখন পাল্টে গেছে। ১০/১২ বছর আগের নির্মাণাধীন এলজিইডি সড়কটি এখন নদীর বুকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ছোট ছোট যানবাহন এখন আর চলাচল করতে পারছে না। পূর্ব-পশ্চিমমুখী গ্রামটির ঘরবাড়ি সারিবদ্ধভাবে নির্মিত। তাদের পূর্ব পুরুষদের নির্মাণাধীন বাড়িগুলো ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে নদী যেন গ্রামের উত্তর দিক দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার হুমকি দিচ্ছে। নদীর বাঁক ক্রমশ বড় হচ্ছে। ক’বছর যাবত গ্রামের অসহায় লোকজন জেলা প্রশাসনের দ্বারপ্রান্তে দৌঁড়েও ভাঙ্গন প্রতিরোধের কোন উপায় তারা পাচ্ছেন না। এবারে স্থানীয় সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বরাবর একখানা আবেদন নিবেদন করে ভাঙ্গন প্রতিরোধের উপায় খুঁজছেন ভোক্তভোগীরা। গ্রামের শতবছরের প্রাচীনতম বড় মসজিদসহ অনেক স্থাপনা এখন হুমকিরমুখে। কোটি কোটি টাকার সম্পদ নদীর বুকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
গ্রামবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ণ বোর্ড (পাউবো) সুনামগঞ্জ থেকে সার্ভেটিম পৌছে দুদফা সার্ভে করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর রিপোর্ট দেয়া প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ ব্যাপারে গ্রামের মসজিদ মোতওয়াল্লী এম এ রউফ বলেন, নদী ভাঙ্গনের লীলা খেলার সাখে এখন আমাদের জীবনের লীলা খেলা শুরু হয়ে গেছে। শত বছর আগে আমাদের বাপ-দাদাদের নির্মিত মসজিদটি এখন ভাঙ্গনের হুমকিমুখে পড়েছে। আমাদের বাজারটি কতবার যে সরিয়ে নেয়া হয়েছে তার কোন হিসেব নেই। আমরা চাই আমাদের ঐতিহ্য আমাদের প্রাচীনতম স্থাপনা মসজিদ বাড়িঘর রক্ষায় ভাঙ্গন প্রতিরোধে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেয়া হউক।৩নং ওয়ার্ড সদস্য মো. শরকত আলী বলেন, ভাঙ্গন লীলা খেলার সাথে আমাদের জীবনের লীলা-খেলা এখন একাকার হয়ে আছে। আমার ওয়ার্ডের পূর্ব সীমানার অপূরনীয় ক্ষতি হচ্ছে। যা কখনও পূরণ হবার নয়। ভাঙ্গন প্রতিরোধে আমি প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার আব্দুল খালিক বলেন, নদীগর্ভে আমাদের ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাওয়ায় গ্রামের মানুষ আমরা খুবই অসহায়। ভাঙ্গন প্রতিরোধের কোন উপায় আমরা পাচ্ছি না। আমি স্থানীয় এমপি মহোদয় সহ সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি ও জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করছি। ঘরবাড়ি হারা জয়মালা বেগম বলেন, নদী আমার বুক খালি করে নদীর বুক ভরেছে। আমি এখন স্বামী হারা হয়ে ছেলে মেয়ে নিয়ে ভাসমান হয়েছি। আমার মতো আরো কতজনের বুক খালি হয়েছে কে রাখে কার খবর। আমাদের গ্রামের নমুনা এখন বদলে গেছে। আগের মানুষও নেই ঘরবাড়িও নেই। যা আছে তা রক্ষারও কোন উদ্যোগ নেই। এই ভাঙ্গন প্রতিরোধে আমি এমপি সাহেবের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ণ বোর্ড (পাউবো) সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.সাবিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সোয়া ৪ কিলোমিটার দুরত্বের সুরমা নদীর ভাঙ্গন নিয়ে একটি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে দেয়া আছে। একনেকের বৈঠকে প্রকল্পটি পাশ হয়ে আসলে প্রতিরোধ কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে। এ ব্যাপাওে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, সুরমা নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধে সংসদে অনেকবার কথা বলেছি। ভাঙ্গন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে প্রকল্প গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়েছে। আশা করছি দ্রুতই প্রকল্পের অনুমোদন হবে।