এম এ রাজ্জাক-

সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে অতিবৃষ্টিপাত আর উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ডুবে যাওয়া হাওর অঞ্চলে মাছের মড়কের জন্য প্রাথমিক ভাবে চারটি কারণ শনাক্ত করেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা অধিদপ্তর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা দল। তারা শনাক্ত করেন, পানিতে অক্সিজেন কমে যাওয়া, অ্যামোনিয়া গ্যাস বেড়ে যাওয়া, অ্যাসিডিটির প্রভাব ও কীটনাশক। শুক্রবার বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা অধিদপ্তরের একটি প্রতিনিধিদল সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের পানি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে প্রথমে প্রথমটি তিনটি কারণ চিহ্নিত করেন। পরে শনিবার হাওরে মাছ ও হাঁসের মড়কের জন্য ফসলের মাঠে ব্যবহার করা কীটনাশকও অপর একটি কারণ বলে মনে  করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর একটি গবেষণা দল। তারা বলেছেন, উজান ও বৃষ্টির পানি ফসলের মাঠ ডুবিয়ে দেয়ায় এই কীটনাশক ও এসিড পানির সঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। শনিবার সকালে সুনামগঞ্জের হাওরে মাছ ও জলজপ্রাণীর অস্বাভাবিক মড়কের কারণ খতিয়ে দেখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের একটি দল তাদের কাজ শুরু করেন। এ সময় তারা ফসলের মাঠে ব্যবহার করা কীটনাশকও একটি কারণ বলে মত প্রকাশ করেন।

অতিবৃষ্টিপাত আর উজান থেকে পানি এসে সারা জেলায় গত কয়েক দিনে দেড় লাখ হেক্টর কৃষিজমির ধান নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ২৫ মেট্রিক টনের বেশি মাছ মারা গেছে। প্রতিদিনই মরে ভেসে উঠছে মাছ। ইতিমধ্যে প্রায় ৬০ লাখ টাকার মাছ মারা গেছে বলে মনে করছেন জেলা ও উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর।  শুক্রবার হাওরে মাছের মড়কের কারণ খুঁজে বের করতে মৎস্য অধিদপ্তরের তিন সদস্যের একটি গবেষকদল পানি পরীক্ষা করতে আসেন। তারা সুনামগঞ্জের খরচার হাওর, দেখার হাওর, মাটিয়ান হাওরসহ ছোটখাটো হাওরের বিভিন্ন জায়গা থেকে পানির নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করেন। তাতে অক্সিজেনের উপস্থিতি কম দেখতে পান তারা। সেই সঙ্গে অ্যামোনিয়া গ্যাস বেড়ে যাওয়া ও অ্যাসিডিটির প্রভাবে মাছ ও জলজ প্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে বলে তাদের ধারণা। তবে, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার পর প্রকৃত কারণ জানা যাবে বলে জানান গবেষক দলটি। পরীক্ষার পর প্রাথমিকভাবে গবেষকরা জানান, হাওরের পানিতে ধানের পচনে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। যেখানে থাকার কথা ৪ থেকে ৫ পয়েন্ট অক্সিজেন, সেখানে আছে মাত্র ৩.৫ পয়েন্ট। এর প্রতিকার কীভাবে করা যাবে তা আরো গবেষণার পর বলা যাবে বলে জানান তারা।

শনিবার সকালে দেকার হাওরে পানি পরীক্ষা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আজমল হোসেন ভূঁইয়া জানান, অন্যান্য এলাকা থেকেও এসিডিটি ও কীটনাশক পানির সঙ্গে আসতে পারে বলে মনে করছেন তিনি। যার ফলে মাছের মড়ক দেখা দিয়েছে। দলটির আরেক সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান খন্দকার জানান, ধানের পচা দুর্গন্ধ থেকে মানুষের শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে এটা সাময়িক। দলটি আরও জানিয়েছেন, বিশ্ব ঐতিহ্য টাঙ্গুয়ার হাওরে মাছ ও জলজ প্রাণী মারা গেলেও অন্য হাওরের তুলনায় তা কম। তবে হাওরের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার আহŸান জানিয়েছে তারা। গত তিন দিন ধরে বিভিন্ন গবেষকরা একাধিক হাওর পরিদর্শন করে জানিয়েছেন অ্যামোনিয়া গ্যাস বৃদ্ধি, অক্সিজেন, কীটনাশক ও ক্ষারের অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় মাছ মারা যাচ্ছে এবং পানি দূষিত হচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা অধিদপ্তরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন খান বলেন, পানিতে অক্সিজেনের ব্যাপক ঘাটতি আছে। মাছের শ্বাসকষ্ট হতে পারে এটা থেকে। ফলে মাছ মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাসের আধিক্য পাওয়া গেছে। এটাও মাছের মৃত্যুর একটা কারণ হতে পারে।

গবেষকদলের পরীক্ষায় পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস শনাক্তের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাসিডিটির উপস্থিতিও লক্ষ করা গেছে, যা মাছের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। তবে, যে তিন কারণের কথা বলেছেন গবেষকদল সেটিই চূড়ান্ত নয়। আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন তারা। মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘মাছের নমুনা ও পানি আমরা ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাচ্ছি। আরো বিষদভাবে পরীক্ষা করে দেখব। তখন আমরা চূড়ান্তভাবে বলতে পারব মাছ মরার সঠিক কারণটা কী।’ মৎস্য অধিদপ্তর এবং প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ এপ্রিল রাতে কালবৈশাখী ঝড় হয়। পরদিন থেকেই মাছ মরা শুরু হয়। ১৮ এপ্রিল থেকে মাছের মড়কের পাশাপাশি হাওরে পচা দুর্গন্ধ চড়িয়ে পরে। ধান গাছের পাশাপাশি মাছ পচে যাওয়ায় এই দুর্গন্ধ ক্রমেই দিন দিন বাড়ছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn