সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলায় এবার ৮৫টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে ৫৮টিতে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন, জিতেছেন ২৭টিতে। আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ নির্বাচিত হয়েছেন ৩০টিতে। ১৮টিতে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বিএনপির নেতা-কর্মী, ৩টিতে জাতীয় পার্টি, ১টিতে জামায়াত, ১টিতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং ৫টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।
দেখা গেছে, জেলার দুটি উপজেলা সুনামগঞ্জ সদর ও তাহিরপুরের সব কটি ইউপিতে নৌকার প্রার্থীরা হেরেছেন। আবার অনেক ইউপিতে দলীয় প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। ১১ জন দলীয় প্রার্থী তাদের জামানত হারিয়েছেন। এমন ইউপিও আছে, যেখানে নৌকা প্রতীকের চেয়ে ২৫ গুণ বেশি ভোট পেয়ে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বলছেন, জেলা পর্যায়ে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, নেতা ও সাংসদের বলয়, ভুল প্রার্থী মনোনয়ন, দলীয় প্রার্থী নিয়ে তৃণমূলে ক্ষোভ, এক পক্ষের প্রার্থীকে অন্য পক্ষের অসহযোগিতা, বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদদ দেওয়াসহ নানা কারণে সুনামগঞ্জে ইউপি নির্বাচনে দলের প্রার্থীরা জয়ী হতে পারেননি। নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের প্রার্থীর চেয়ে নিজের বলয়ের প্রার্থীরা নেতাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছেন বেশি। যে কারণে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর চেয়ে বিদ্রোহীরা জয়ী হয়েছেন বেশি।
তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির সুনামগঞ্জে সার্বিকভাবে ইউপি নির্বাচনের ফল দলের পক্ষে এবং ভালো হয়েছে বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া সব কটিতেই হয় নৌকা, নাহয় অন্য প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা দলের লোকজনই জয়ী হয়েছেন। এতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জয় হয়েছে।
তবে প্রার্থী মনোনয়নে ভুল এবং এতে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ থাকার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন। বলেন, ‘অনেক স্থানে জনপ্রিয়দের আমরা মনোনয়ন দিতে পারিনি। আবার স্থানীয়ভাবে দ্বন্দ্ব, সাংসদের বলয়, বিভক্তি নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে। বিদ্রোহীরা কোনো না কোনো জায়গা থেকে তো সাহস পেয়েছেন।’
নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সুনামগঞ্জে সর্বশেষ সোমবার জেলার তাহিরপুর উপজেলার সাতটি ইউপিতে ভোট হয়। এখানে একটিতেও নৌকা জয়ী হতে পারেনি। সাতটির মধ্যে চারটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এবং তিনটিতে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বিএনপির নেতারা জয়ী হয়েছেন।
নির্বাচনের পর তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন খান এক প্রতিক্রিয়ায় অযোগ্য ও অজনপ্রিয় ব্যক্তিদের নৌকা প্রতীক দেওয়ার কারণেই এই পরাজয় বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, দলের প্রার্থী মনোনয়নে তৃণমূলের মতামত প্রাধান্য পায়নি। ভুল প্রার্থী মনোনয়নই হারের মূল কারণ।
একইভাবে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার নয়টি ইউপির মধ্যে একটিতেও নৌকা জেতেনি। এই উপজেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী দুজন, বিএনপির চারজন, জাতীয় পার্টির দুজন এবং একটিতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রার্থী জয়ী হন। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার আটটি ইউপির মধ্যে মাত্র দুটিতে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এ ছাড়া তিনটিতে দলের বিদ্রোহী, দুটিতে বিএনপি এবং একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পাঁচটির মধ্যে মাত্র একটিতে নৌকার প্রার্থী জয়ী হন। বাকিগুলোর মধ্যে দুটিতে আওয়ামী লীগের দুই বিদ্রোহী প্রার্থী, একটিতে বিএনপির স্বতন্ত্র এবং একটিতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়ী হন। দিরাই উপজেলার নয়টির মধ্যে তিনটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী, চারটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এবং দুটিতে স্বতন্ত্র হিসেবে থাকা বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন জগন্নাথপুর উপজেলায় সাতটির মধ্যে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে তিনটিতে, দলের বিদ্রোহী প্রার্থী তিনটি এবং বিএনপির একজন জয়ী হয়েছেন।
ছাতক উপজেলার ১৩টি ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন ৬টিতে, দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ৪টি এবং বিএনপির প্রার্থী ২টিতে জয়ী হন। শাল্লা উপজেলায় চারটির মধ্যে একটিতে নৌকা, দুটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এবং একটিতে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। জামালগঞ্জ উপজেলার চারটির মধ্যে দুটিতে আওয়ামী লীগ, একটিতে বিএনপি ও একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। দোয়ারাবাজার উপজেলায় নয়টির মধ্যে পাঁচটিতে নৌকা, তিনটিতে দলের বিদ্রোহী এবং একটিতে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। ধর্মপাশা উপজেলায় ১০টি ইউপির মধ্যে ৪টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী, ৩টিতে বিএনপি এবং ৩টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।
তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা মনে করেন, সব জায়গাতেই নেতা-কর্মীদের ওপর সাংসদদের একটা প্রভাব আছে। আবার জেলা নেতাদের সঙ্গেও রয়েছে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের যোগাযোগ। কিন্তু তাঁদের মধ্যে বিভেদ থাকায় এর প্রভাব পড়ছে ভোটের মাঠে। সব ইউপিতেই স্থানীয় নেতা-কর্মীরা তাঁদের বলয়ের প্রার্থী খুঁজেছেন। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর ইউপির নৌকার পরাজিত প্রার্থী হজরত আলী বলেন, ‘নেত্রী নৌকা দিয়েছেন। মনে করেছিলাম, মান-অভিমান থাকলেও দলের সবাই নৌকার পক্ষেই থাকবেন। কিন্তু সেটি হয়নি। বরং এক পক্ষ নৌকা ডোবাতে বিদ্রোহী প্রার্থীকে নিয়ে মরিয়া ছিল।’
ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পরাজয়ের পেছনে ‘অযোগ্যদের মনোনয়ন দেওয়া’ ও ‘মনোনয়ন–বাণিজ্য’ দায়ী বলে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নূরুল হুদা। আগের অবস্থানে আছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, প্রার্থী মনোনয়নে তৃণমূলের মতামতকে মূল্যায়ন করা হয়নি। উপজেলার তালিকা জেলায় এসে হারিয়ে গেছে। ঢাকায় বসে বসে জেলার দুই নেতা তাঁদের পছন্দের লোকজনকে মনোনয়ন দিয়েছেন। তিনবার, চারবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা পর্যন্ত মনোনয়ন পাননি। নৌকার পরাজয়ের পেছনে জেলা আওয়ামী লীগের দুর্বল নেতৃত্বও দায়ী।’
তবে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির এ বিষয়ে আলাপকালে বলেন, মনোনয়নের বিষয়টি তাদের হাতে ছিল না। তৃণমূল ও জেলা কমিটির মতামত কেন্দ্রে প্রাধান্য পায়নি। কেন্দ্রের কাছে তাঁরা এক রকম অসহায় ছিলেন। দেখা গেছে, তৃণমূল থেকে নাম আসেনি আবার জেলা কমিটি কেন্দ্রে নাম দেয়নি, এমন অনেকেই কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন নিয়ে এসেছেন। পরে কেন্দ্রে এসব প্রার্থী পরিবর্তনের চিঠি দিয়েও লাভ হয়নি। এতে তাঁরা যেমন বিব্রত হন, মাঠের নেতা-কর্মীরা বিভ্রান্ত হয়েছেন।
সুনামগঞ্জের ইউপি নির্বাচন, নির্বাচনে দলের নেতা ও সাংসদের কী ভূমিকা ছিল—এসব সার্বিক পরিস্থিতি দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরবেন বলে জানান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক সাংসদ মতিউর রহমান। প্রবীণ এই নেতা বলেন, ‘আমরা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে এগোচ্ছি। এ নিয়ে আমরা অবশ্যই কথা বলব। এখন তো আমাদের কাছে লোকজন আসে না। যাঁদের টাকা আছে, যাঁরা এমপি-মন্ত্রী, তাঁদের কাছে যায়। বড় বড় পদে থাকবেন, ক্ষমতা দেখাবেন আর সব দায় নিতে হবে আমাদের; এটা হবে না। এই বিপর্যয়ের দায় সবাইকেই নিতে হবে।’
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
২০৩ বার