সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগে নতুন মেরুকরণঃ স্থায়িত্ব কতদিন?-(২)
সুজাত মনসুর-
(গতকালের পর)
বাস্তবতা কিন্তু তা বলে না। একটা অসম্ভব রাজনৈতিক শর্তে, নেতায় নেতায় ঐক্য হলেই কি বছরের পর বছর ধরে তৃণমূল পর্যায়ে যে বিভেদ-ভাঙন সৃষ্টি করা হয়েছে, তা কি এত সহজেই নিরসন করা সম্ভব? উত্তর একটাই । না। কেননা, ঐক্য প্রক্রিয়ার প্রথমদিনেই আনন্দ-উৎসবের মঞ্চেই জেলা কমিটির সম্পাদক ও পৌর মেয়র যে নিরানন্দ কর্মীদের উপহার দিলেন, তা আমাদেরকে লজ্জিত করেছে এবং সুনামগঞ্জের আওয়ামী রাজনীতিতে মতিউর-মুকুট-ইমন জোটের বিপরীতে আরেকটি মেরুকরনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এছাড়া ঐদিনের ঘটনায় জেলা প্রশাসকের মধ্যস্থতা আমাদের মাথা হেট করেছে। জগলুকে চাইলেই সুনামগঞ্জের রাজনীতি থেকে মাইনাস করা যাবে না। কেননা, তিনি আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে যুক্ত এবং দ্বিতীয়বারের মত পৌর মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন। সুতরাং জগলু ও অন্যান্যদের বাদ দিয়ে এবং তৃণমুলের বিভাজন দুর না করে এই ঐক্য প্রক্রিয়া কি সফল হবে? শুভঙ্করের ফাঁকি থেকেই যায়।
সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এই মেরুকরণ প্রক্রিয়া নতুন নয়। আর সব মেরুকরণ হয়েছে নেতাদের নিজস্ব স্বার্থ বিবেচনায়। তৃণমূল কর্মীদের চাওয়া-পাওয়াকে কখনোই গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। যদি নেওয়া হত তাহলে নেতাদের ঐক্যের আগে তৃণমুলের ঐক্যের দিকে জোড় দেয়া হত। আজকে প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর যাবত প্রতিটি উপজেলায়, ইউনিয়নে এমনকি গ্রামেও বিভক্তি-বিভাজন বিরাজমান। নিজেদের মধ্যে প্রায়ই কামড়াকামড়ি হয়, মারামারি হয়। আর এই বিভক্তির হোতা মূলতঃ জেলা পর্যায়ের নেতারা। তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল ও নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখার জন্য এই বিভেদ জিইয়ে রেখেছেন। তৃণমুল নেতাকর্মীদের নিয়ে খেলছেন।
আমরা যদি কয়েকটি উপজেলা কিংবা নির্বাচনী আসন ভিত্তিক বিভক্ত রাজনীতির চিত্র পর্যালোচনা করি তাহলে বিভক্তির নগ্নরূপ দিবালোকের মত ভেসে উঠে। ঐক্য প্রক্রিয়ার ভিত্তি হিসেবে তারা বলেছেন, আগামী নির্বাচনে সুনামগঞ্জের পাঁচটি আসনই জননেত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে চান, তাই এই মেরুকরণ এবং জেলার বর্ষিয়ান নেতা, প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান দেশে ফিরলেই উনার সাথে আলাপ করে কর্ম-কৌশল নির্ধারণ করবেন। সুনামগঞ্জের পাঁচটি আসনই কিন্তু এখন সরকারি দল আওয়ামী লীগের। ঐতিহ্যগতভাবে ও গত এক দশকে যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে সেখানে প্রতিটি আসনেই আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জেতার কথা। কিন্তু নেতাদের কথা থেকেই বলা যায় তা নিশ্চিত নয় আর তার কারণ তাদের বিভক্তি, তাই ঐক্য চান। কিন্তু ঐক্য করতে হলেও তো সবাইকে নিয়ে করতে হবে। শুধু পক্ষ পরিবর্তন করে কি ঐক্য গড়া সম্ভব। একদিকে ঐক্য হচ্ছে আবার অন্যদিকে অনৈক্যের সুর ধ্বণিত হচ্ছে।
মেরুকরনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, নির্বাচনে জয়লাভ। সুন্দর কথা, ভাল কথা, আশা সঞ্চারিনী বক্তব্য। কিন্তু বাস্তবতা কি বলে? জগন্নাথ-দক্ষিন সুনামগঞ্জ, অর্থাৎ সুনামগঞ্জ-৩ আসনের কথাই যদি ধরি তাহলে কি চিত্র ফুটে উঠে। সেখানে মনোনয়ন প্রত্যাশি হচ্ছেন চারজন। বর্তমান সাংসদ ও প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, আব্দুস সামাদ আজাদের বড় ছেলে আজিজুস সামাদ আজাদ ডন, এক সময়ের ছাত্রলীগের নেতা ও বর্তমানে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক এবং দক্ষিন সুনামগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান হাজী আবুল কালাম। মেরুকরণ প্রক্রিয়ার নেতারা বলেছেন, মান্নান সাহেবেব সাথে কথা বলে ঐক্য প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এতদিন মান্নান সাহেব মতিউর রহমান ও নুরুল হুদা মুকুটের চক্ষুশুল ছিলেন। মান্নান সাহেব মতিউর রহমানকে বহিরাগত ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল করতেও দ্বিধা করেননি। মতিউর রহমান ও মুকুট দুজনেই মান্নান সাহেবকে নিকট অতীতে অনেক কটুবাক্যে আক্রমণ করে কথা বলেছেন। এমনকি কিছুদিন আগেও সম্ভবতঃ জগন্নাথপুরে নুরুল হুদা মুকুটকে ডন সমর্থিত জগন্নাথপুর আওয়ামী লীগের একাংশের দেয়া সংবর্ধনায় মুকুট প্রকাশ্যেই আজিজুস সামাদ আজাদ ডনকে মনোনয়ন দেয়ার জন্য দাবি জানিয়েছেন। ডনকে নিয়ে বিভিন্ন সভাসমাবেশ করেছেন। দক্ষিন সুনামগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান কালাম সাহেব বিশেষ করে অতিথি করে সুনামগঞ্জে আরেকটি সংবর্ধনা হচ্ছে। যেখানে ইমন উপস্থিত থাকছেন কিন্তু মান্নান সাহেবসহ অন্যান্য সাংসদরা অনুপস্থিত। এখন তাদের কথা অনুযায়ী যদি, নতুন মেরুকরণকে জেলার সর্বক্ষেত্রে কার্যকর করতে চান তাহলে, প্রতিটি এলাকায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে একটা নুন্যতম শর্তে ঐক্যের প্রয়োজন। আর তাহলো যেই প্রার্থী হন্না কেন আমরা নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবো। কিন্তু তা কি আদৌ সম্ভব? কর্মীরা মানা দুরে থাক, সম্ভাব্য প্রার্থীরা মেনে নেবেন কি? বাস্তবতা কি সেই রকম? এখন মান্নান সাহেব যদি মুকুট সাহেবকে বলেন, ডনের পক্ষে দেয়া তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে, উনার প্রার্থীতার পক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য তখন কি মুকুট পাল্টি খাবেন? যদি তাই করেন তাহলে, উপজেলা চেয়ারম্যান কালাম সাহেবকেই বা কি উত্তর তিনি দেবেন? ইমন না হয় জেলা কমিটিকে সংগঠিত করার জন্য সভাপতির সাথে একাট্টা হয়েছেন, কিন্তু মান্নান সাহেবসহ অন্যান্যরা কি সবকিছু বাদ দিয়ে এই মেরুকরণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবেন?
এখানে প্রকাশিত সব মতামত লেখকের ব্যক্তিগত, সুনামগঞ্জ বার্তা ডটকম’র সম্পাদকীয় নীতির আওতাভুক্ত নয়।
(চলবে। আগামীকাল সুনামগঞ্জ-৫ ও সুনামগঞ্জ-২ আসন প্রসঙ্গ)