ইমানুজ্জামান মহীঃ প্রস্তাবিত রেল লাইন কোন দিকে যাবে ? ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ না গোবিন্দগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ ? এই নিয়ে টানা পোড়ন চলছে জেলার একমাত্র মন্ত্রী এম,এ মান্নান ও জেলার অবশিষ্ট পাঁচ সাংসদদের মধ্যে। সাংসদরা হাটছেন সোজা পথে অপরদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রী হাটছেন ঘোরানো পথে। ইতিমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড, এম,এ মোমেন ৫ সাংসদের সাথে জোট বাধায় নাখোশ হয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী।
সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান ছাড়া জেলার ৫ সাংসদ যথাক্রমে মুহিবুর রহমান মানিক, পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, ড. জয়া সেন গুপ্তা , শামিমা শাহরিয়ার ও জেলা আওয়ামীলীগ চাচ্ছে ছাতক হয়ে সুনামগঞ্জ যাবে রেলপথ। বর্তমানে আমেরিকায় চিকিৎসারত জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ্ব মতিউর রহমান এর সাথে আলাপ কালে তিনি ৫ সাংসদের মতের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করেন।
গত ৭ জুন মন্ত্রীকে বাদ দিয়ে সুনামগঞ্জের বাকী পাঁচ সংসদ সদস্য তাদের দাবীর কথা জানিয়ে রেলপথমন্ত্রী বরাবর একটি ডিও লেটার দেন। পরিকল্পনামন্ত্রী রেলপথ কোন দিকে যাবে এ ব্যাপারে সরাসরি মত প্রকাশ না করলেও রেলমন্ত্রীর সাথে তার আলাপ হয়েছে বলে স্বীকার করেন। আলাপে তিনি রুটটি যেখান দিয়ে করলে লাভজনক হবে, পরিবেশ-প্রতিবেশের কোনো ক্ষতি হবেনা, সেদিক দিয়েই করার জন্য রেলমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছেন। রেললাইনের রুট নির্ধারণ নিয়ে তিন থেকে চারটি রুট নিয়ে আলোচনা চলছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পরিকল্পনা মন্ত্রীর সাথে এলাকার উন্নয়ন নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে জেলা আওয়ামীলীগ ও জেলার সকল সাংসদদের ঠান্ডা লড়াই চলছিলো। মন্ত্রী যে গবিন্দগঞ্জ থেকে বিকল্প পথে সুনামগঞ্জ রেলপথ নেবার পক্ষে তা তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইদানিং কালের কিছু বক্তব্যে প্রকাশ করেছেন। রেলপথ নিয়ে সাংসদরা তাই তাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। ইদানিং কালে ২০১৫ সালের সমিক্ষাকে পাশকাটিয়ে নতুন পথে রেলপথ নির্মাণে সম্ভাবনা যাচাই করতে রেলমন্ত্রনালয় উদ্যোগ নিলে মন্ত্রীর প্রতি তাদের সন্দেহ বাড়ে। মন্ত্রীর অবস্থান সাংসদদের দাবীর বিপক্ষে ধরে নিয়ে সাংসদরা মন্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে চলেন। তাদের দাবীর সাথে তাই তাকে সম্পৃক্ত করেননি।
রেলওয়ের ডিজি ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার ১২ জুন গনমাধ্যমকে বলেছেন, ছাতক-সুনামগঞ্জের রেল লাইন সম্প্রসারণের কাজ প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আমরা এই রেলপথ কোন পথে যাবে, এর একটি সমীক্ষা করেছি। সুনামগঞ্জের সংসদ সদস্যগণ তাতে দ্বিমত পোষণ করেছেন। রেলের ডিজির কথায় এটা স্পষ্ট প্রমানিত হয় ২০১৫ সালের সমিক্ষাকে পাশকাটিয়ে বিকল্প পথ ধরে তারা হাটছেন। আর এর পিছনে যে কেউ একজন কলকাটি নাড়ছেন তাও বুঝা যায়।
পরিকল্পনা মন্ত্রী এম,এ মান্নান তাকে পাশ কাটিয়ে রেলমন্ত্রীরকে ডিও দেওয়ায় জেলার সাংসদদের আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বললেন, আমি স্তম্ভিত, আমি চিন্তাও করতে পারিনি আমার সহকর্মীরা আমাকে এই বিষয়ে জড়াবেন। ছাতক-সুনামগঞ্জের রেলের এলাইনমেন্ট নিয়ে আমি রেলমন্ত্রী কিংবা রেল সচিব কারো সঙ্গে কথা বলিনি, কোন চিঠিও দেইনি। রেল মন্ত্রণালয়ে বিজ্ঞমন্ত্রী আছেন, ওখানে সচিব আছেন, অন্যান্য কর্মকর্তা আছেন. টেকনেশিয়ানরা আছেন তারা স্টাডি করবেন। পথ নির্ধারণ করবেন। সরকারের সিন্ধান্ত হবে। সরকার বা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁদের সহযোগিতা করা হবে আমার কাজ। আমি রেলমন্ত্রণালয়কে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের কথা বারবার বলেছি। কোন পথে রেল যাবে, আমি মুখে কিংবা লিখিতভাবে কাউকে বলিনি। এই বিষয়ে অযথাই আমাকে হেয় করা বা জেলাবাসীর উন্নয়ন কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করা সমীচিন নয়।
সাংসদদের যুক্তি হচ্ছে ২০১৫ সালে বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত যখন রেল মন্ত্রী তখন ছাতক সুনামগঞ্জ রেলপথ করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এই সম্ভাবনা বিবেচনায় তখন বাংলাদেশ রেলওয়ে’এর পক্ষ থেকে সুনামগঞ্জ-ছাতক রেল লাইনের সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এরপরে একাধিকবার সুনামগঞ্জ-ছাতক রেললাইনের সম্ভাব্যতা যাচাই হয়।
সাংসদদের কথা হচ্ছে, ২০১৫ সালের এলাইনমেন্ট অনুযায়ী (ছাতক বাজার-শিবপুর-হাসনগর পর্যন্ত) ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ জেলা সদর পর্যন্ত রেললাইন টানা হচ্ছে সুলভ ও সহজ পথ। ছাতক থেকে মাত্র ২৭ কিলোমিটার লাইন টানলেই রেলের সঙ্গে সহজে যুক্ত হতে পারবে সুনামগঞ্জ জেলা সদর কিন্তু কোন এক রহস্যজনক কারনে সেই সমিক্ষা কার্যক্রমকে বাতিল করে বর্তমানে গবিন্দগঞ্জ থেকে শুরু করে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত্য ঘোরানো-পেঁচানো ৫০ কিলোমিটার হাওরের দুর্গম এলাকা দিয়ে রেলপথ নির্মাণের সম্ভাবনা যাচাই করছে রেলমন্ত্রনালয়। যার ফলে নির্মাণ ব্যয় কয়েক শতগুণ বেড়ে যাবার সাথেসাথে সুনামগঞ্জ পৌছাতে যাত্রীদের সময় ও ব্যয় হবে বেশী। অপর দিকে বৃটিশকাল থেকে ছাতকের মতো শিল্পন্নিত উপজেলা শহর বঞ্চিত হবে উন্নয়নের সকল সুযোগ সুবিধা থেকে।
সুনামগঞ্জের ৫ সাংসদের এই যুক্তিক দাবীর সাথে ইদানিং যোগ দিয়েছেন সিলেট সদরের সাংসদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব এম,এ মোমেন। কিছুদিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড,এম,এ মোমেন সুনামগঞ্জ জেলার ৫ সাংসদের দেয়া ডিও লেটারের সমর্থনে রেলমন্ত্রী বরাবরে একটি ডিও লেটার দেন। তার ডিও লেটারের সূত্র ধরে কেউকেউ দুই মন্ত্রীর মাঝে দ্বন্দ্বের গন্ধ খোঁজে পান। পত্রিকায় সংবাদ হয় ‘দু’মন্ত্রীর দ্বন্দ্বের কারনে থমকে গেছে সিলেটের উন্নয়ন’। পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড,এম,এ মোমেন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এটাকে শুধুই রটনা বলে উল্লেখ করেন।
তিনি গত ১৪ জুন দেওয়া স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘মান্নান আমার বন্ধু, মান্নানের সাথে আমার সম্পর্ক ৫০ বছরের অধিক। আমি এবং মান্নান সুখে–দুঃখে সব সময়ই ছিলাম এবং আছি, ভবিষ্যতেও আমৃত্যু থাকব বলেই আশা করি। দুঃখজনক যে সিলেটের একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে দেখলাম আমার এবং মান্নানের মধ্যে নাকি দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং এই দ্বন্দ্বের কারণে নাকি সিলেটের অনেক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে! কে বা কারা এই সংবাদটি প্রচার করছেন জানি না, তবে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট।‘
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফেসবুকে স্ট্যাটাস এর উওরে মন্ত্রী এম,এ মান্নান বেশ উস্মা প্রকাশ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ডিও লেটারকে কেন্দ্রকরে ‘পরিকল্পনামন্ত্রীর দপ্তর’ ফেসবুক পেজে ২০ জুন লিখেন, ড. মোমেন সুনামগঞ্জের পাঁচজন সংসদ সদস্যের পাশে রয়েছেন উল্লেখ করে রেলমন্ত্রীর কাছে যে আধা সরকারি পত্র (ডিও) দিয়েছেন, সেটি আমাকে বিস্মিত করেছে। তিনি যে পাঁচজন এমপির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, সেখানে একজন জাতীয় পার্টির এমপিও রয়েছেন। আব্দুল মোমেন ভালো করেই জানেন, আমিও (মান্নান) সুনামগঞ্জের একজন সংসদ সদস্য। সুনামগঞ্জের সঙ্গে ছাতকের রেললাইন নির্মাণ নিয়ে তিনি যেমন অবগত, ঠিক তেমনি বিষয়টি আমিও অবগত। আমি যতটুকু জানি, তার বর্ণিল জীবনে তিনি কখনো সুনামগঞ্জে যাননি। সুনামগঞ্জে কখনো তার পা পর্যন্ত পড়েনি। অথচ তিনি রেললাইন নির্মাণ নিয়ে একটি পক্ষের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অন্য কেউ হলে এই পরিস্থিতিতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইতেন। কিন্তু আমাদের দীর্ঘ ৫০ বছরের বন্ধুত্ব একই সঙ্গে আমরা দুজনেই মন্ত্রিসভার সদস্য অথচ তিনি আমার সঙ্গে এ বিষয়ে এতটুকু যোগাযোগ করেননি। আমার সঙ্গে কথা না বলে অন্য পাঁচজন সংসদ সদস্যের পক্ষ নিয়ে রেলমন্ত্রীকে ডিও লেটার পাঠানো কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’ এই বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে চিঠি নেবারও কোন প্রয়োজন ছিল না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৪৯৭ বার