রুদ্র মিজান- তিনি একজন নারী। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হিসেবে পরিচিত তিনি। রহস্যময় এই নারী কখনো বীণা আহমেদ, কখনো বীণা রানী দাস, বীণা খাতুন কখনো দীপ্তি কৃষ্ণ দাস, কখনো জান্নাতুল ফেরদৌস নামে পরিচিত। শারীরিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে নানা কৌশলে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। একের পর এক বিয়ে করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। বিয়ে করেন কুমারী সেজে। অথচ তিনি এ পর্যন্ত তিন সন্তানের জননী। রয়েছে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন থেকে শুরু করে মরণনেশা মাদক বাণিজ্যের অভিযোগও।
প্রতারণার এখানেই শেষ নয়। তিনি একটি ভয়ঙ্কর চক্রের সদস্য। ইউটিউবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আবেগঘন বক্তব্যের মাধ্যমে প্রবাসীদের অর্থ সহযোগিতা নেন এই নারী। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে মামলা হলেও অপরাধ জগতে বিচরণ অব্যাহত তার। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত প্রতারণার একটি মামলা তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
ভোলা, গাজীপুর ও নরসিংদীর ঠিকানা অনুসারে তার একাধিক জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন পাওয়া গেছে। একটি এনআইডিতে তার নাম মিসেস বীণা আহমেদ, পিতার নাম আব্দুল বাছেত তালুকদার ও মায়ের নাম লাভলী বেগম উল্লেখ রয়েছে। গাজীপুরের ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের একটি জন্মসনদে তার নাম শ্রী দীপ্তি রানী দাস, পিতার নাম প্রদীপ কৃষ্ণ দাস, মাতার নাম লিজা রানী দাস ও ঠিকানা ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের বেগমপুর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি নেয়া হয়েছে ২০১৭ সালের ১৭ই মে। বীণা রানী দাস নামে ভোলার লালমোহনের ধলীগৌর নগরের ২০১৭ সালের ১৪ই আগস্টের একটি জন্মসনদ রয়েছে তার। রয়েছে ভারতের আধার কার্ড। দীপ্তি রানী দাস নামে ওই আধার কার্ডে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব চব্বিশ পরগনার শিমুলপুর। আবার বাংলাদেশি পাসপোর্টে তার নাম বীণা আহমেদ।
রহস্যময় এই নারী ২০১৭ সালের ১২ই জুন নরসিংদীর মোসলেম ভূঁইয়ার পুত্র জোবায়ের হোসেনকে বিয়ে করেন। বিয়ের কাবিননামায় তার নাম বীণা আক্তার লিমা বলে উল্লেখ করা হয়। জোবায়ের ও বীণার আট বছরের সংসারে ২০০৯ ও ২০১১ সালে দুটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। জোবায়েরের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, তার কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে পাঁচ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নেন বীণা। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে চলচ্চিত্রের নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করেন এফডিসিতে। ওই সময়ে পরিচয় গড়ে উঠে চলচ্চিত্র জগতের অনেকের সঙ্গে। এই পরিচয়কেও কাজে লাগান তিনি। এরমধ্যেই জোবায়েরকে ডিভোর্স না দিয়ে হাত রাখেন অন্যের হাতে।
এবার বীণার প্রেমের ফাঁদে পা দেন লালমোহনের ব্যবসায়ী কালিপদ দাসের ছেলে শ্রী উজ্জ্বল চন্দ্র দাস। তাদের পরিচয় হয় গাজীপুরে। নিজেকে দীপ্তি রানী দাস হিসেবে হিন্দু ধর্মাবলম্বী পরিচয় দিয়ে ২০১৭ সালের ১২ই মার্চ বিয়ে করেন উজ্জ্বল দাসকে। প্রিয়ন্তি দাস নামে এই দম্পতির এক কন্যা সন্তান রয়েছে। কয়েক বছর না যেতেই অশান্তি নেমে আসে তাদের সংসারে। গাজীপুরের জয়দেবপুর থানায় জিডি করেন উজ্জ্বল চন্দ্র দাস। এতে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর হুমকি-ধমকির অভিযোগ করেন তিনি। বীণা চলে যান উজ্জ্বলের লালমোহনের বাড়িতে। লোকজন নিয়ে আন্দোলনও করেন। সালিশ বসিয়ে উজ্জ্বলের বাবার কাছ থেকে আদায় করেন ১২ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে ২০১৯ সালের ৩রা মার্চ বিচ্ছেদ ঘটে উজ্জ্বল ও বীণার। এ বিষয়ে ২০১৯ সালের ১০ই মার্চ তাদের মধ্যে একটি আপোষনামা হয়। এর সাতদিন পূর্বে প্রথম স্বামী জুবায়েরকে ডিভোর্স লেটার পাঠান। সেই অনুসারে ২০১৯ সালের ৩রা এপ্রিল বিচ্ছেদ হয় প্রথম স্বামীর সঙ্গে। পরবর্তীতে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী দীপু নামে এক ছেলের সঙ্গে বন্ধুতা হলে তা বিয়ে পর্যন্ত পৌঁছায়নি। পরবর্তীতে মাগুরার শ্রীপুরের দেলোয়ার হোসেন নামে এক ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিকে বিয়ে করেন। কাফরুলের ৮৭৫ পূর্ব শেওড়াপাড়ায় বাসা নেয় দেলোয়ার ও বীণা। বিয়ের পর বীণার পূর্বের বিয়েসহ নানা অপকর্মের বিষয় জানতে পারেন দেলোয়ার। এরপর শুরু হয় কলহ। একপর্যায়ে বিচ্ছেদ ঘটে এই দম্পতির।
সর্বশেষ এই নারীর শিকার হন একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্মচারী ও ঢাকা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ছাত্র মিরপুরের রেডিও কলোনির বাসিন্দা মৃত হারুন অর রশিদের পুত্র মো. রবিউল আওয়াল। ২০২০ সালের মে মাসে বীণার সঙ্গে এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয়। নিজেকে তখন এতিম, অসহায় ও নব মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেন বীণা। এক পর্যায়ে রবিউলের সঙ্গে বন্ধুতা গড়ে উঠে। বন্ধুতা থেকে প্রেম। তবে রবিউল দাবি করেছেন, নানুর থেরাপি ও ব্যায়ামের কথা বলে তাকে বাসায় ডেকে নেন বীণা। সেখানে খাবারের সঙ্গে কিছু একটা খাওয়ালে সংজ্ঞা হারান রবিউল। ২৫শে মে ভোরে নিজেকে আবিষ্কার করেন বীণার পাশে বস্ত্রহীন অবস্থায়। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে ফাঁসানোর হুমকি দেয় বীণা। জানিয়ে দেয় নগ্ন ছবি, ভিডিও রয়েছে তার কাছে। কয়েকদিন পর কর্মস্থলে গিয়ে জনসম্মুখে রবিউলকে লাঞ্ছিত করে বীণা। হুমকি দিয়ে বাসায় নিয়ে যায়। বাসায় নিয়ে তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় বীণা। অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দেয়া হয়।
গত বছরের ১২ই জুন বীণাকে বিয়ে করেন রবিউল। কাবিনে নিজেকে কুমারী হিসেবে উল্লেখ করেন। বিয়ে বাবদ রবিউলের কাছ থেকে নেন প্রায় ১ লাখ টাকা। বিয়ের কয়েকদিন পরই মিরপুরের বাসায় অন্য এক যুবকের সঙ্গে বীণাকে দেখতে পান রবিউল। পরবর্তীতে বীণার ফোনে তাদের অন্তরঙ্গ ছবি দেখতে পান। এ নিয়ে কলহ হলে রবিউলের ফোন ভেঙে ফেলেন বীণা। পরবর্তীতে রবিউলকে ব্যবসা করতে অনুপ্রেরণা দিয়ে টাকা সংগ্রহ করতে বলে। রবিউলের জমানো ২ লাখ ও তার মায়ের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নেয় বীণা। এবার শুরু হয় রবিউলের অন্য জীবন। চাকরি ছেড়ে ব্যবসার পরিবর্তে ঘর পরিষ্কার, কাপড় ধোয়া, রান্না-বান্নার কাজ করতে হয় তাকে। বিকালে বাসা থেকে বের হয়ে রাত ১২টার পর বাসায় ফিরতো বীণা। কোনো কোনো রাতে বাইরে থাকতেন বলে জানান রবিউল। ব্যবসার নামে আনা রবিউলের টাকা দিয়ে জমি ক্রয় করেছে জানিয়ে আরও ২ লাখ টাকা চায় বীণা। এবার বড় বোনের কাছ থেকে টাকা এনে দিলে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে স্কুটি কিনে বীণা। এ নিয়ে কলহ হলে মারধর করা হয় রবিউলকে। হুমকি দেয়া হয় মামলার।
এরমধ্যে গত ১৭ই মে একটি সন্তানের জন্ম হয় বীণার। ওই সময়ে বীণার মা লাভলী বেগমের কাছে বীণার বিরুদ্ধে নালিশ করলে বিপদ নেমে আসে রবিউলের। মারধর করে তাকে। একপর্যায়ে বাসা থেকে তাকে চলে যেতে বলা হয়। পরবর্তীতে বীণাকে ডিভোর্স দেন রবিউল। এবার রবিউলের বাসা, গ্রামের বাড়ি এমনকি তার বোনের বাড়িতেও হানা দেয় বীণা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় নানা অপবাদ। বাধ্য হয়ে ঢাকার সিএমএম আদালতে প্রতারণার অভিযোগে মামলা করেন রবিউল। মামলাটি তদন্ত করছে পিবিআই। পিবিআই’র বিশেষ পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আদালতের নির্দেশ অনুসারে মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তবে মামলার আসামি বীণা আহমেদের একাধিক ফোন নম্বরে বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১৬৩ বার