কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার অপহরণ মামলায় অর্চনা নামে এক নারী গতকাল মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদারের আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। অপহরণ ঘটনার দিন কয়েকদফা ওই নারীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় ফরহাদ মজহারের। জবানবন্দিতে অর্চনা বলেন, তার বাড়ি মঠবাড়িয়ায়। বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে ২০০৫ সালের শেষ দিকে বাড়ি ছেড়ে পিরোজপুরে মামার বাড়িতে চলে যান। ২০০৬-০৭ সালের মাঝামাঝিতে ফরহাদ মজহারের এনজিও উবিনীগে চাকরি নেন। এরপর ১৫ দিনের ট্রেনিংয়ের জন্য টাঙ্গাইলে উবিনীগের কার্যালয়ে যান। সেখানে ট্রেনিংয়ের পর কক্সবাজারে উবিনীগে তার কর্মস্থল ঠিক হয়। কক্সবাজারে তার সঙ্গে অর্চনার পরিচয় হয়। এরপর থেকে ফরহাদ মজহারের ভক্ত অর্চনা। তাকে ‘গুরুবাবা’ বলে ডাকেন। ঈশ্বরদীতে থাকাকালে গুরুবাবার সঙ্গে তার প্রথম দৈহিক সম্পর্ক হয়। এরপর টাঙ্গাইলে বদলি হন। সেখানে তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন ফরহাদ মজহার। এক পর্যায়ে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি স্ত্রী ফরিদা আখতার জেনে যান। তিনি অর্চনাকে চাকরি থেকে বের করে দেন। তবে ফরহাদ মজহারের সঙ্গে তার যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। প্রায়ই ফোনে কথা হতো। বর্তমানে তার বাসা ঢাকার নুরের চালায়। সেখানে প্রায়ই আসতেন ফরহাদ মজহার। বছর দুয়েক আগে অর্চনা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। এরপর ফরহাদ মজহারের নির্দেশে মালিবাগের একটি ক্লিনিকে গর্ভপাত ঘটানো হয়। প্রয়োজন মোতাবেক ফরহাদ মজহার অর্চনাকে ১০-১২ হাজার টাকা খরচ দিতেন। বর্তমানে অর্চনা ভাটারা এলাকায় টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত-তরকারি সরবরাহ করে জীবন নির্বাহ করছেন বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন।

অর্চনা আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আরও উল্লেখ করেন, চলতি বছরের এপ্রিলে আবার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে ফরহাদ মজহারের কাছে টাকা চান। তার কাছে টাকা না থাকায় তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। ৩ জুলাই সকাল ৬টা ২০ মিনিটে ফরহাদ মজহার তাকে ফোনে জানান, তোমার টাকার জন্য বের হয়েছি। এরপর বেলা ১১টার দিকে ফরহাদ মজহারকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, তিনি অপহরণ হয়েছেন কিনা। তিনি বলেন, ভালো আছেন। এরপর সন্ধ্যা ৭টার দিকে ফোন করে টাকা পাঠানোর জন্য একটি অ্যাকাউন্ট নম্বর চান। এরপর দুটি নম্বরে ১৫ হাজার টাকা পাঠান অর্চনার কাছে। ৯ জুলাই ডিবি রাঙ্গুনিয়া থানা পুলিশের সহায়তায় অর্চনাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় বলেও জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন।

এর আগে ফরহাদ মজহার পুলিশের কাছে ১৬১ ধারা ও আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে বলেন, চোখের ওষুধ কিনতে গত সোমবার ভোরে রাজধানীর শ্যামলীর রিং রোডের বাসা থেকে তিনি বের হন। এরপর শ্যামলীর কাছ থেকে তিনজন অপরিচিত লোক জোর করে তাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। তার চোখ বেঁধে গাড়ির সিটে বসানো হয়। তিনি নিজেই অপহরণকারীদের টাকা দিয়ে মুক্তি পেতে চান। এর কিছুক্ষণ পরই তিনি স্ত্রীর মোবাইলে ফোন দিয়ে নিজের অপহরণ হওয়ার কথা জানান। তাকে মেরে ফেলা হবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন। পরে তিনি কয়েক দফায় ফোন দিয়ে মুক্তি পেতে ৩৫ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলেন।

হানিফ কাউন্টারের ম্যানেজার ঢাকায় এসে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে বলেন, ‘গফুর’ পরিচয়ে এক ব্যক্তি বাসের টিকিট কাটেন। পরে টেলিভিশন দেখে জানতে পারেন, ওই গফুরই ফরহাদ মজহার। পুলিশের দাবি ফরহাদ মজহারের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে অনেক নতুন তথ্য উঠে আসছে। প্রযুক্তিনির্ভর তদন্তে এমন কয়েকটি বিষয় পাওয়া যাচ্ছে, যার কারণে পুরো ঘটনাটি নিয়ে রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে। প্রথম থেকে ফরহাদ মজহার বলে আসছেন ‘অপহরণের’ পর একটি মোবাইল নম্বর থেকে (০১৮৮-৩০৮৬৪৮০) কল থেকে তার স্ত্রীকে তিনি ঘটনাটি জানান। তবে পুলিশ বলছে তদন্তে তারা দেখেছে, ঘটনার দিন তিনি আরও একটি মোবাইল নম্বর (০১৭২৫-৭২৫৬৯৩) ব্যবহার করেছেন। গ্রামীণ ফোনের ওই নম্বর থেকে গত সোমবার অপহরণের পর ফরহাদ মজহার মোট ৬ বার ওই নারীর সঙ্গে কথা বলেন। এই নারীই হলেন অর্চনা।

গত রোববার রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘এখনো ফরহাদ মজহারকে অপহরণের তথ্য পাওয়া যায়নি। ঘটনার তদন্ত চলছে। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে চূড়ান্ত ঘটনা বলতে পারব।’ এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ফরহাদ মজহার পুলিশ ও আদালতের কাছে যে জবানবন্দি দিয়েছেন তার সঙ্গে পরে প্রযুক্তিগত তদন্তে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের অনেক গরমিল রয়েছে। ফরহাদ মজহার সুস্থ হলে এসব বিষয়ের ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাইবেন তদন্ত কর্মকর্তা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn