রাজধানীর ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস অব বাংলাদেশের (ইউল্যাব) শিক্ষার্থী ফারাহ মাধুরী

বার্তা ডেক্সঃঃরাজধানীর ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস অব বাংলাদেশের (ইউল্যাব) শিক্ষার্থী ফারাহ মাধুরীকে (২২) ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় নিহত তরুণীর বান্ধবী নেহাকে গ্রেফতারের জন্য খুঁজছে পুলিশ। সে বর্তমানে সুস্থ কিংবা জীবিত আছে কি-না, এ বিষয়ে জানতে ইতোমধ্যে অভিযান শুরু হয়েছে। এছাড়াও ওই তরুণীর নিহত বন্ধু আরাফাতের দাফন সম্পন্ন করেছে পরিবার। তার মরদেহ কবর থেকে তোলারও আবেদন করা হবে।

সূত্রের তথ্যে জানা গেছে, ঘটনার দিন রাজধানীর উত্তরার ব্যাম্বু সুট রেস্টুরেন্টে মোট ৫ জন ছিলেন। যাদের মধ্যে ওই তরুণীসহ আরাফাত নামের একজন মারা গেছে। আরাফাত রাজধানীর সিটি জেনারেল হাসপাতালে মারা গেছে। চিকিৎসক মৃত্যুর কারণ হিসেবে অতিরিক্ত মদ্যপান উল্লেখ করেছে। মৃত্যুর পরপরই বিষয়টি পুলিশকে না জানিয়ে তার মরদেহ দাফন করে দেয়া হয়। ইতিমধ্যে এই ঘটনার রহস্য জানতে আরাফাতের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে পুলিশ। মামলার আসামি হিসেবে প্রয়োজনে কবর থেকে তার মরদেহ উত্তোলনের আবেদন করা হতে পারে।

গ্রেপ্তার মর্তুজা রাহয়ান চৌধুরী ও নুহাত আলম তাফসিরকে জিজ্ঞাসাবাদ ও পুলিশি তদন্তে ঘটনার একটি প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে। তাদের তথ্যমতে, নিহত তরুণী ও রায়হান আগে থেকেই প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক ছিল। তারা আগে থেকেই ২৮ তারিখ বিকালে দেখা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এদিন বিকেলে তারা হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজার সামনে একত্রীত হন। সেখানে তাদের সঙ্গে দেখা হয় তাদের বন্ধু আরাফাতের। সেখানে আরাফাত তাদেরকে গুলশানে একটি রেস্টুরেন্টে দাওয়াত আছে বলে নিমন্ত্রণ দেন। সেই দাওয়াতে যাওয়ার জন্য তারা প্রথমে আরাফাতের বাসায় (লালমাটিয়া) যান। সেখান থেকে একযোগে উবার নেন। শেষ মুহূর্তে আরাফাত তাদের জানায়, রেস্টুরেন্টের লোকেশন একটু বদল হয়েছে, উত্তরায় যাচ্ছি আমরা। তখন তারা উবার নিয়ে উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ব্যাম্বু সুট রেস্টুরেন্টে যান।

রেস্টুরেন্টে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন ওই তরুণীর বন্ধু নেহা ও তার আরেক ছেলে বন্ধু। রেস্টুরেন্টে তারা ৫ জন একত্রীত হয়ে মদ্যপান শুরু করেন। মদ সরবরাহ করে নেহার ছেলে বন্ধু (অজ্ঞাত)। সন্ধ্যায় পরপরই তারা একসঙ্গে মদ খাচ্ছিল। একপর্যায়ে প্রথমে নেহা অসুস্থতা বোধ করলে তার বন্ধুসহ চলে যায়। রেস্টুরেন্টে আরাফাত, রায়হান ও ওই তরুণী মদ্যপান করতেই থাকে। একপর্যায়ে নিহত তরুণী টয়লেটে গিয়ে বমি করে। সেই অবস্থা দেখে রায়হান ও আরাফাত ওই তরুণীকে নিয়ে একসাথে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে উবার নেয়। উবারে ওই তরুণী ও রায়হানকে গুলশান-২ এ নামিয়ে দেয় আরাফাত।

গুলশান-২ এ নেমে ওই তরুণী বলে যে, সে বাসায় যাবে না, তাকে তার বান্ধবী তাফসিরের বাসায় নিয়ে যেতে বলে। তখন তারা দুইজন মিলে মোহাম্মদপুরের মোহাম্মাদকীয়া হোমস লিমিটেডের ৯ নম্বর ফ্ল্যাটের বাসায় যায়। সেই বাসায় তাফসির তার মার সঙ্গে থাকতো। তবে সেদিন তাফসির একা ছিল। ২৮ তারিখ রাতে তারা তাফসিরের বাসায় ঢুকে। এর পরপরই ওই তরুণী বমি করে। সেই বমি পরিষ্কার করে তাফসির ও রায়হান। এরপর রায়হান ও ভিক্টিম তরুণীকে এক রুমে রেখে অন্য রুমে চলে যায় তাফসির।

রাতে রায়হানের সঙ্গে একাধিকবার ওই তরুণীর শারীরিক সম্পর্ক হয়। এরপর ২৯ তারিখ ভোরেই ভিক্টিমকে তাফসিরের বাসায় রেখে নিজের বাসায় চলে যায় রায়হান। সকাল থেকে দুর্বল বোধ করছিলেন ভিক্টিম তরুণী। দুপুরে তাফসিরের বাসায় এসে আবার খোঁজ-খবর নিয়ে যায় রায়হান। শুক্রবার মধ্যরাতে রায়হান তার বন্ধু কোকোকে ফোন দিয়ে ভিক্টিমের শারীরিক অসুস্থতার কথা জানায়। তখন কোকো এসে তাকে প্রথমে ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে যায়।

তবে হাসপাতালে পর্যাপ্ত আইসিইউ সুবিধা না থাকায় ৪০ মিনিট পর তাকে ধানমণ্ডির আনোয়ার খান মডার্ণ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে আইসিইউতে রাখা হয় ভিক্টিম তরুণীকে। তখন রায়হান ভিক্টিমের বাবাকে ফোন করে এ বিষয়ে জানায়। ভিক্টিমের বাসা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। পরদিন ৩০ তারিখ মধ্যরাতে নেহার মৃত্যুর আগেই তার বাবা মোহাম্মদপুর থানায় এসে একটি মামলা করে। পরদিন ৩১ তারিখে তার মেয়ের মৃত্যু হয়।

এ ঘটনায় রায়হান এবং তাফসিরকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে এনেছে পুলিশ। এছাড়াও তাফসিরের বাসার, ব্যাম্বু সুটসহ বেশ কয়েকটি স্থানের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করছে পুলিশ। এছাড়াও তরুণীকে উদ্ধার করা বন্ধু কোকোসহ নিহত ও আসামিদের পরিবারের পরিবারের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মামলার আসামি ও ধর্ষণের সহায়তাকারী নেহাকে গ্রেফতারে ইতিমধ্যে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ।

এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল লতিফ বলেন, রায়হানের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি ইতিমধ্যে চেক করা হয়েছে। সেটি দেখে আমাদের মনে হয়েছে যে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত ছিল এবং এ বিষয়ে দুইজনই অবগত ছিলেন। বাকীদের মোবাইল ফোনগুলো সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। সেগুলো পেলেও প্রযুক্তিগত পরীক্ষা করা হবে। এটি মূলত একটি ড্রিংক্স পার্টি ছিল (মদ্যপানের)।

ওসি আরও বলেন, মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। বাকি আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ও ডিএনএ টেস্টের প্রতিবেদন পেলে বিস্তারিত জানা যাবে। পুলিশের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) রওশানুল হক সৈকত বলেন, আমরা গ্রেপ্তার দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাদের দেয়া তথ্য ও আমাদের অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছি। এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে। এছাড়াও আরাফাতের দাফনের বিষয়ে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। তার বিষয়েও খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হারুন-অর-রশিদ বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে শুনেছি নেহার এক বন্ধু বিমানবন্দর থেকে মদ এনে উত্তরার ব্যাম্বু সুট রেস্টুরেন্টে খেয়েছে। আমরা সেই ছেলের নাম-পরিচয় এখনো পাইনি। তাকে খোঁজা হচ্ছে। সেই মদপানের কারনেই কিছু হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এছাড়া মদপান করার কারণে বিষক্রিয়া হয়েছে কি-না তা আমরা তদন্ত করছি। এছাড়াও উত্তরার যে রেস্টুরেন্ট থেকে এই মদ্যপান করা হয়েছিল, তাদের লাইসেন্স আছে কি-না তাও তদন্ত করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, নিহত তরুণীর ভিসেরা নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পাশাপাশি গ্রেফতার দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্তে প্রাথমিকভাবে আমাদের মনে হয়েছে, অতিরিক্ত মদ্যপান, মদে বিষক্রিয়া অথবা বেশি মদ পান করিয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে পারে। সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আ ম সেলিম রেজা বলেন, ‘মেয়েটির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে কি না, তা জানতে নিহতের ভিসেরা আলামত নেয়া হয়েছে। এছাড়াও তার যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথ থেকে আলামত সংগ্রহ করে ডিএনএ টেস্টের জন্য পাঠানো হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নিহতের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এছাড়াও দেহের সংবেদনশীল অংশগুলোতেও জোরপূর্বক সঙ্গমের আলামত পাওয়া যায়নি।ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টে মৃত্যুর প্রকৃত কারন জানা যাবে।’ উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তপন চন্দ্র সাহা বলেছেন, রাজধানীর উত্তরায় ব্যাম্বু সুট নামে যে রেস্টুরেন্টটিতে মদ্যপান করেছিল সেই রেস্টুরেন্টটিতে মদ বিক্রি কিংবা পান করার কোনও অনুমতি ছিল না। তিনি বলেন, উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে ব্যাম্বু সুট রেস্টুরেন্টটি অবস্থিত। তারা সাধারণ খাবার বিক্রি করত। তাদের মদ্যপান বা মদ বিক্রি করার কোনো অনুমতি ছিল না। ভিকটিমসহ ৫ জন যখন ওই রেস্টুরেন্টে অবৈধভাবে মদ পান করচিল তখন তারা আমাদের কিছু জানায়নি। যেহেতু তাদের অনুমতি নেই তারা আমাদের জানানো উচিৎ ছিল।

ওসি বলেন, রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আমি ইতোমধ্যে ব্যাম্বু সুটে গিয়ে তদন্ত করে এসেছি। ভিক্টিমের বাবার নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় ৫ আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ওই তরুণীর বন্ধু মর্তুজা রায়হান চৌধুরীকে (২১) ধর্ষণকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অন্য চার আসামির মধ্যে তিন জন- নুহাত আলম তাফসির (২১), আরাফাত (২৮) ও নেহা (২৫)। আরেকজনের নাম জানা যায়নি। মামলায় অজ্ঞাত হিসেবে তাকে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, গত ২৮ জানুয়ারি বিকেল ৪ টায় মর্তুজা রায়হান ওই তরুণীকে মিরপুর থেকে আসামি আরাফাতের বাসায় যায়। আরাফাতের বাসায় স্কুটার রেখে আরাফাত, ওই তরুণী ও রায়হান একসাথে উবারে করে তারা উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ব্যাম্বুসুট রেস্টুরেন্টে যায়। সেখানে আগে থেকেই আরেক আসামি নেহাসহ ও আরও একজন সহপাঠী (তরুণ) আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। সেখানে আসামীরা ওই তরুণীকে জোর করে অধিক মাত্রায় মদপান করায়।

এজাহারে বলা হয়েছে, মদ্যপানের একপর্যায়ে ওই ভিক্টিম অসুস্থ বোধ করলে রায়হান তাকে মোহাম্মদপুরে তার এক বান্ধবীর বাসায় পৌঁছে দেয়ার কথা বলে নুহাতের বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে ওই তরুণীকে একটি রুমে নিয়ে তারা সবাই একসাথে ছিল, এবং তাদের চোখের সামনে রায়হান তাকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর রাতে ওই তরুণী অসুস্থ বোধ করে ও বমি করলে অসিম খান কোকো নামে তার আরেক বন্ধুকে ফোন দেয়। সেই বন্ধু পরদিন এসে ওই তরুণীকে প্রথমে ইবনে সিনা ও পড়ে আনোয়ার খান মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করে। ২ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর রবিবার সে মারা যায়।

এজাহারে ধর্ষক হিসেবে মর্তুজা রায়হান চৌধুরীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বাকীদের ভূমিকা জোর করে মদ পান করিয়ে ধর্ষণের সহযোগিতা উল্লেখ করা হয়েছে। রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় ভেজাল মদের কারখানায় অভিযান চালিয়ে মূলহোতাসহ হাতেনাতে ছয় জনকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এ সময় তারা স্পিরিট, চিনি, রং ও পানি মিশিয়ে বিদেশি বোতলে ভরে মদ তৈরি করছিল। সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) রাত ১০টার দিকে ভাটারা থানার খিলবাড়ীর টেক মুক্তি পল্লী ইউনিয়ন পরিষদ রোডের বেস্ট ফিউচার স্কুলের কাছে একটি ভেজাল মদের কারখানায় এই অভিযান শুরু হয়। অভিযানের নেতৃত্ব দেন ডিএমপি গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার কে এম হাফিজ আক্তার।

তিনি বলেন, গত কয়েকদিনে বিদেশি মদপান করে ঢাকার বেশ কয়েকজন অসুস্থ হয়ে মারা যায়। কিন্তু বিদেশি মদপানে এমন হওয়ার কথা না। তখনই আমরা ধারণা করি ভেজাল মদে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আমরা তদন্ত শুরু করি। এরই ধারাবাহিকতায় রাত ১০টার দিকে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে একটি ভেজাল মদের কারখানায় অভিযান চালায় ডিবি গুলশান টিম ও সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ।-পূর্বপশ্চিমবিডি

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn