সোনালী ব্যাংকে’র ৬১৫ কোটি টাকা নিয়ে উধাও ৫৮ প্রতিষ্ঠান
হলমার্কের মতো সোনালী ব্যাংকের আরও একটি বড় ঋণ কেলেঙ্কারি ধরা পড়েছে। শুধু নারায়ণগঞ্জের বৈদেশিক বাণিজ্য শাখায় ৬১৫ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি করা হয়। তথ্যানুন্ধানে দেখা যায়, ব্যাংকের এ শাখাটির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ৫৮টি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাক টু ব্যাক এলসি (ঋণপত্র) খুলে একটি চক্র বিপুল অংকের টাকা আত্মসাৎ করেছে। এক্ষেত্রে এসব টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। প্রায় এক যুগ আগে দেয়া এ ঋণের একটি কানাকড়িও আদায় হয়নি। এমনকি ব্যাংকের এ শাখাটির শতভাগ ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত, যা সোনালী ব্যাংকের জন্য অশনি সংকেত। আর এ জালিয়াতির সঙ্গে ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা জড়িত তাদের কেউ কেউ এখনও বহাল তবিয়তে আছেন। চুনোপুঁটিদের ছিটেফোঁটা শাস্তি হলেও রাঘববোয়ালদের কিছুই হয়নি।
এদিকে সূত্র জানায়, উল্লিখিত ঋণ জালিয়াতির দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জের এ শাখাটি ইতিমধ্যে তা অবলোপনও করেছে। অথচ অবলোপন বা মূল খাতা থেকে বাদ দেয়া এ ঋণ এখন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হিসেবে দেখানো হবে। একপর্যায়ে দেখা যাবে, সরকার ভর্তুকি হিসেবে টাকার জোগান দিয়ে এ ক্ষতি পুষিয়েও দেবে। সূত্র বলছে, এ বছরও সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকার ৩শ’ কোটি টাকা দিয়েছে। যার পুরোটাই জনগণের করের টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের মতো সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে প্রভাবশালী চক্র এভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা নিজেদের দখলে নিয়ে নিচ্ছে। এসব কারণে সুইস ব্যাংকসহ বিদেশে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকার অংক শুধু বেড়েই চলেছে। বাস্তবতা হল- জড়িতদের শাস্তি না হওয়ায় ব্যাংক লুটপাট বন্ধ করা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, আসলে বলতে গেলে সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ বৈদেশিক বাণিজ্য শাখায় কোনো ঋণ বিতরণই করা হয়নি। কারণ ঋণ কখনও এভাবে খেলাপি হয় না। শাখাটিতে এখন শতভাগ খেলাপি। এটি ভাবা যায়! তিনি বলেন, এ শাখা দুর্নীতির দুর্গে পরিণত হয়েছে। এভাবে সরকারি ব্যাংকে লালবাতি জ্বালাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। আবার জনগণের করের টাকায় মূলধন জোগান দেয়া হচ্ছে। বিশিষ্ট ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, বিচারহীনতার কারণে বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। শাস্তি হলেও শাখা পর্যায়ে হয়। কিন্তু পরিচালক বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জড়িত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না।
সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তৈরি পোশাক বিদেশে রফতানি করার কথা বলে কাঁচামাল আমদানির নামে ৫৮টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বিভিন্ন তারিখে বিপুল পরিমাণ ব্যাক টু ব্যাক এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়। কিন্তু এলসির পণ্য বিদেশে রফতানি করা হয়নি। আবার গ্রাহক প্রতিষ্ঠানও কোনো দায় পরিশোধ করেনি। ফলে ৬১৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকার ফোর্সড লোন (বাধ্যতামূলক ঋণ) সৃষ্টি করে তা সংশ্লিষ্ট শাখা পরিশোধ করেছে। নিয়মানুযায়ী ফোর্স লোনের বিপরীতে দ্বিগুণ জামানত রাখতে হয়। কিন্তু বিপুল পরিমাণ এ ঋণের জন্য কোনো জামানত ছিল না। এটি রহস্যজনক এবং এতেই প্রমাণ হয় যে, ব্যাংকের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা জেনেশুনে এত বড় অপরাধ করেছেন। আর এর মাশুল দিতে গিয়ে ঘাটতি জামানতের অর্থ প্রধান কার্যালয় (হিসাব ডেবিট করে) থেকে কেটে নিয়ে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়েছে। ঊল্লিখিত টাকা আদায় না হওয়ায় সবই এখন কু-ঋণে পরিণত হয়েছে।
শাখা সূত্র জানায়, গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করেন তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক মো. আবদুস সামাদ এবং সিনিয়র অফিসার মো. সিরাজুল হক। তারা পণ্য রফতানি না হওয়ার পরও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে একাধিক এলসি খোলেন। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সীমার চেয়ে বেশি (পেমেন্ট) ঋণ প্রদান করেন। যার সবই এখন বড় দায় দেনায় পরিণত হয়ে ব্যাংকের কাঁধে চেপে বসেছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা এখন এও মনে করছেন, কাঁচামাল এনে গার্মেন্টের পণ্য তৈরি করে তা রফতানি করা তো দূরের কথা ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে আদৌ কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে কিনা সেখানেও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কেননা, কাঁচামাল আমদানি করা হলে পণ্য তৈরি করে তা অবশ্যই রফতানি করা হতো। যেহেতু রফতানি করা হয়নি সেহেতু এ রকম সন্দেহ মোটেই অমূলক নয়। আর তাই যদি হয় তাহলে এখানে অর্থ পাচারের মতো আরও বড় একটি অপরাধ অবশ্যই সংঘটিত হয়েছে। এ বিষয়টি তদন্ত করলে দেখা যাবে, ভুয়া জাহাজিকরণের কাগজপত্র জমা দিয়ে ব্যাংকের ঋণের টাকা তুলে নিয়ে বিদেশে রাখা হয়েছে।
এদিকে জানা গেছে, বর্তমানে অভিযুক্ত ৫৮টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। এ ঘটনায় আবদুস সামাদকে চাকরিচ্যুত এবং সিরাজুল হকের পদোন্নতি ৩ বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। বর্তমানে সিরাজুল হক নারায়ণগঞ্জের প্রিন্সিপাল অফিসে কর্মরত রয়েছেন। প্রশ্ন হল, এত বড় ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় এমন শাস্তি হাস্যকর ছাড়া কিছু হতে পারে না। এমনটি বলছেন ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বিশ্লেষক।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ইতিমধ্যে ৫৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা মন্দ খেলাপি ঋণ ৫০১ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য মেসার্স কারুজ ফেব্রিক্সের প্রায় ৪৫ কোটি টাকা, মেসার্স প্রিমিয়াম নিটওয়্যারের ৪০ কোটি টাকা, মেসার্স এঞ্জেল অ্যাপারেলসের প্রায় ২৮ কোটি টাকা, মেসার্স কটন ফেয়ারের প্রায় ২৭ কোটি টাকা, মেসার্স এসএস নিটের সাড়ে ২৬ কোটি টাকা, মেসার্স এএস নিটওয়্যারের ২৫ কোটি টাকা, মেসার্স জিহাদ গার্মেন্টের প্রায় ২৫ কোটি টাকা, মেসার্স শুভ ফ্যাশনের প্রায় ২৫ কোটি টাকা, মেসার্স দাইয়ান ফ্যাশনের প্রায় ২১ কোটি টাকা, মেসার্স মিলিনিয়াম নিটের সাড়ে ২০ কোটি টাকা, মেসার্স মাসটেক্স ডিজাইনের সাড়ে ১৯ কোটি টাকা এবং মেসার্স রবি অ্যাপারেলের ১৭ কোটি টাকা। সূত্র বলছে, বাকি ১৮টি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা টাকাও অবলোপন করতে হবে। এর বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। কারণ তারাও লাপাত্তা। আর জামানত বলেও কিছু নেই।
সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ বৈদেশিক বাণিজ্য শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক আমিনুল ইসলাম বলেন, ৫০০ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এছাড়া ১১৫ কোটি টাকার মধ্যে ৯২ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে বলে জানান তিনি। সোনালী ব্যাংকের বর্তমান এমডি ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, এসব ঘটনা পুরানো। হলমার্ক কাণ্ডের চক্র এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তার মতে, চক্রটি ঢাকার আশপাশে ঋণ অনিয়ম করে হাত পাকা করার পর হলমার্ক কাণ্ড ঘটায়। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ বৈদেশিক বাণিজ্য শাখায় এ পর্যন্ত বড় অংকের ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। তিনি জানান, ইতিমধ্যে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এছাড়া শাখাটিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আরও বিশদ তদন্ত করছে।
এসব হরিলুটের ঘটনা ঘটে ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত। কেউ কেউ এ ঘটনাকে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর দ্বিতীয় বড় ধরনের ঋণ জালিয়াতি হিসেবে দেখছেন। হলমার্কের ঘটনায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে একটি প্রভাবশালী চক্র। সে সময় সোনালী ব্যাংকে শেরাটন শাখা থেকেই নিয়ে যায় ২৬শ’ কোটি টাকা।