স্কুল কলেজে হাজিরা কোচিংয়ে লেখাপড়া!
শিক্ষার্থীরা এখন আর শেখার জন্য বা লেখাপড়ার জন্য স্কুল কলেজে যায় না। যায় হাজিরার জন্য, শিক্ষার্থী হিসাবে তালিকায় নাম থাকার জন্য। পড়ার জন্য, শেখার জন্য বা পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য ছোটে কোচিং সেন্টারে। ব্যতিক্রম ছাড়া এ চিত্র পুরো দেশের। শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের এ ধারণার সাথে মানিয়ে নিয়েছেন। হাজিরা নিতেই সময় পার হয়ে যায় বা পার করেন। তারাও জানেন শ্রেণিকক্ষে না শেখালেও শিক্ষার্থীরা কোনো না কোনো কোচিং সেন্টারে গিয়ে পড়া শিখবে, পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাবে। তাই শ্রেণিকক্ষে শেখানোর এত তাড়া নেই। চিত্রটি এমন, কোচিংগুলোই এখন আমাদের মূল ব্যবস্থা; স্কুলগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কোচিং সেন্টার বা শিক্ষকদের সৃষ্ট প্রাইভেট হোমে প্রতিদিন সকাল-বিকাল-রাতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের স্রোত নামে। স্কুল-কলেজের সমান্তরালে শ্রেণিকক্ষের মতো আয়োজন করে এসব জায়গায় পড়ানো হচ্ছে, স্কুলের আদলে পরীক্ষা হয়, ক্লাস হয়, দেওয়া হয় হোম ওয়ার্ক। স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টারের পড়াতেই বাধ্য হন অভিভাকদের। এ কারণে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার পর বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা সন্তানকে নিয়ে ছোটেন স্কুলে এবং কোচিং সেন্টারে।
গত কয়েকদিন রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সাথে কথা বলে এসব তথ্যের প্রমাণ মিলেছে। শিক্ষার্থীরা জানায়, তাদের স্কুলের সময়টা অপচয়ই হয়। এর চেয়ে কোচিংয়ে গেলে কিছু শেখা যায়। কোচিংয়ে বিষয়গুলো প্রাকটিস করে যেতে হয়। নিয়মিত কোচিংয়ে পরীক্ষা হয়। তাই কোচিংয়ের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। এ কারণে স্কুলে কোনো হোমওয়ার্ক দেওয়া হলেও তা করা হয় না। শিক্ষকদের ম্যানেজ করে নিতে হয়। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি এবং শিক্ষকদের প্রাইভেট-কোচিংমুখীকেই দায়ী করছেন অভিভাবকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেজাল্ট ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। শেখার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হওয়া দরকার। শিক্ষার্থীরা কি শিখল এটা এখন গুরুত্ব পায় না, গুরুত্ব পায় সে কতটা ভালো ফল করেছে। আর ভালো ফলের জন্য ছুটছে এক কোচিং থেকে অন্য কোচিংয়ে। আরিফা আক্তার। রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থী। স্কুল সময় সকাল ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত। এরপরই তার বাসায় ফেরার কথা; কিন্তু সে বাসায় ফেরে বিকাল ৫টায়। স্কুল শেষেই আরিফা স্কুলের পাশেই একটি কোচিং সেন্টারে যায়। সেখানেই সময় কাটায় প্রায় ৪ ঘণ্টা। কোচিংয়ের দেওয়া হোম ওয়ার্ক, পরীক্ষা নিয়েই পুরো ব্যস্ত সময় কাটে তার। এই শিক্ষার্থীর বক্তব্য, ‘স্কুলে লেখাপড়া হয় না। স্যারেরা তেমন গুরুত্ব দিয়ে পড়ান না। তাই কোচিংয়ের বিকল্প নেই। স্কুলে গুরুত্ব দিয়ে শেখালে এবং প্রাকটিস করালে কোচিংয়ে যেতে হতো না।’
আরিফার সাথে পুরোটা সময় ব্যয় করেন তার মা। স্কুল এবং কোচিং এই দুই জায়গায় গিয়ে পড়াশোনার কারণে বিরক্তও সে; কিন্তু নিরুপায়। তার বক্তব্য, সবাই করছে। তাই আমারও এভাবে কষ্ট করতে হচ্ছে। স্কুল এবং কোচিংয়ের পেছনেই খরচ করতে হচ্ছে ৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। তারিকুল ইসলামের স্কুলের ক্লাস শুরু সাড়ে ১২টায়; কিন্তু সকাল ৮টায় সে বাসা থেকে বের হয়। সকাল আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত একজন শিক্ষকের কাছে গণিত, নয়টা থেকে ১০টা পর্যন্ত আরেকজন শিক্ষকের কাছে পদার্থ। দুপুর ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত এক কোচিংয়ে গিয়ে পড়ছে রসায়ন। এর পর বাসা থেকে টিফিন বক্সে আনা খাবার খেয়ে হাজির হয় স্কুলে। ক্লান্ত শরীরে কোনো রকম ক্লাসগুলো পার করে। ভয় একটাই, স্কুলে হাজির না হলে আবার স্কুলে খাতা থেকে নাম কাটা যাবে। আমিরুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক জানিয়েছেন, শিক্ষাব্যবস্থা দিন দিন কোচিং সেন্টার নির্ভর হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানের স্কুল থেকে শুরু করে নগরের নামিদামি স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টারে নিয়ে ভর্তি করাচ্ছেন অভিভাবকরা। আর এসব কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে সন্তানদের ব্যয় মেটাতে রীতিমতো হিমশিম। অভিভাবকরা বলছেন, স্কুলগুলোতে মানসম্পন্ন পড়াশোনা না হওয়ায় অপারগ হয়েই তাদের কোচিং সেন্টারমুখী হতে হচ্ছে। কোচিং প্রাইভেট বাণিজ্য বন্ধে সরকার ২০১২ সালে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা জারি করে। ওই নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষকদের নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগ নেই। অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড়জোর ১০ জন শিক্ষার্থীকে পড়ানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এ নীতিমালা কাগুজেই বন্দি। আলোর মুখ দেখে না।
শিক্ষামন্ত্রীও শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষকদের প্রতি। তিনি বলেন, শিক্ষকরা প্রাইভেট টিউশনির মাধ্যমে শিক্ষক সমাজকে কলুষিত করছে। প্রাইভেট টিউশনি কোচিং বন্ধে আইন প্রণয়ন করার কথাও বলেন তিনি। মফস্বলের স্কুলগুলোতে পঞ্চম, অষ্টম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। অনুপস্থিত শিক্ষার্থীরা স্কুল বাদ দিয়ে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার ও টিউটোরিয়াল হোমে ভিড় করে। তবে রাজধানীর ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, একটি শ্রেণিকক্ষে ৮০ থেকে একশ’র বেশি শিক্ষার্থীকে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিটে কি শেখানো যাবে। হাজিরা নিতেই তো সময় চলে যায়। এছাড়া শিক্ষার্থীরা যা জানতে চায় তা সময়ের অভাবে জানতে পারছে না। শেখানো যাচ্ছে না। তাই তারা বাধ্য হয়েই কোচিং সেন্টারমুখী হচ্ছে। তিনি এ কারণে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটিকে দায়ী করেন। তবে শুধু শিক্ষকরাই নয় ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে কোচিং বাণিজ্যের ব্যবসাও এখন জমজমাট। স্কুলে কোচিং বাণিজ্য বন্ধের সুযোগ নিতে চাইছে এই চক্র। স্কুলের আশপাশ ঘিরে এসব কোচিং সেন্টার যেন এক একটি স্কুল।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবুল বাশার হাওলাদার বলেন, স্কুলে শিক্ষা ব্যবস্থা ততটা ভালো নয়। প্রতি শ্রেণিকক্ষে ৬০ থেকে ৮০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। যত ভাল পড়ানো হোক না কেন তেমন ফিডব্যাক পাওয়া যায় না। এই সুযোগে কোচিং সেন্টারে বিশেষ পদ্ধতিতে পাঠদান করায়। প্যাকেজ প্রোগ্রাম করে। শিক্ষার্থী কম। প্রায় প্রতিদিনই পরীক্ষা নেয়। এ কারণে ভালো হোক মন্দ হোক শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারের দিকে ঝুঁকছে। ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ নুর আলম বলেন, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক অনুপাত বেশি হওয়ায় এই সমস্যা হচ্ছে। স্কুলে লেখাপড়া একেবারে হয় না, এমন তথ্য ঠিক নয়। তবে সময় কম থাকায় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শেখার চাহিদা মেটানো যায় না। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (পরিচালক) অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান বলেন, অভিভাবকরা শেখার চেয়ে নম্বর বেশি পাওয়ার দিকে নজর দিচ্ছে। এ কারণেই ছুটছে কোচিং সেন্টারের দিকে। তিনি বলেন, এখনো এমন শিক্ষক রয়েছে যাদের ক্লাস করার জন্য শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকে। তবে এ সংখ্যা বেশি নয়। শিক্ষার মান উন্নয়নে শ্রেণিকক্ষের মান উন্নয়নে শিক্ষকদের নজর দিতে হবে।