স্বাধীনতার ৪৭ বছরে ও ভাতা পায়নি বিরঙ্গনা ভানু বিবি
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের ইজ্জত বিষর্জন দিয়ে দেশ স্বাধীন করে বিরঙ্গ গোসাইরহাটের ভানু বিবি স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও বিরঙ্গনা ভাতা পায়নি । গেজেটভুক্ত হতে পারেনি সে। ৪টি সন্তানদের নিয়ে ঠাই হয়েছে ঢাকার একটি বস্তিতে । অসহায় জীবন যাপন করছেন তিনি। স্থানীয় প্রশাসন বলছে গেজেটে তার অর্ন্তরভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে । গেজেটভুক্ত হলেই ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। গোসাইরহাট উপজেলার মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডর ইকবাল হোসেন বাচ্চু ছৈয়াল জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে গোসাইরহাট উপজেলার ছৈয়াল পাড়া গ্রাম সহ পাকহানাদার বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতার দোষর রাজাকার আলবদর আলসামদের সহযোগিতায় জেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে মুক্তিসেনাদের খুজে বেড়াতো। স্বাধীনতাকামী মুক্তিসেনাদের বাড়ি ঘর সহ স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনদের বাড়ি ঘর দোকান পাট লুটপাট করেছে। জ্বালিয়ে দিয়েছে ঐ সকল মুক্তিসেনাদের বাড়ি ঘর সহায় সম্বল। ১৯৭১ সালের ৫ অক্টোবর গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুর ইউনিয়নের ছৈয়াল পাড়া গ্রামে ঢুকে পড়ে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোষর রাজাকার আল বদর আলসামরা। খবর পেয়ে গ্রামের নারী পুরুষ তরুন যুবক যুবতীরা শিশু সহ দিকবেদিক ছুটোছুটি করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সেদিন ছৈয়ালপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা রোস্তম আলী বেপারীর স্ত্রী ভানু বিবি পাকহানাদার বাহিনীর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে নিজের সম্ভ্রম বাচাতে ঘর থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যেতে দৌড় দিলে রাজাকার আল বদর আলসামদের সহায়তায় তাকে ধরে ফেলে। পাকহানাদার বাহিনীর নরপশুরা কয়েকজনে এক সাথে তাকে পার্শ্ববতী ধানক্ষেতে নিয়ে উপর্যুপরি পার্শ্ববিক নির্যাতন করে কাদার মধ্যে ফেলে যায় । পাকহানাদার বাহিনী এলাকা থেকে সরে যাওয়ার পরে স্থানীয় লোকজন এসে ভানু বিবিকে অসুস্থ্য অবস্থায় উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। ঐ দিন আরো দুইজন নারী পাকহানাদার বাহিনী পার্শ্ববিক নির্যাতনের শিকার হয়। লোকলজ্জায় ঐ দুই নারী ইজ্জত হারানোর কথা স্বীকার করেননি। এ ঘটনার পরে ভানু বিবির স্বামী মুক্তিযোদ্ধা রোস্তম আলী বেপারী বাড়ি এসে ভানু বিবিকে পরিত্যাগ করার জন্য উদ্যত হয়। এ সময় অসহায় ভানু বিবি একমাত্র কন্যা সন্তান বানেসা কে নিয়ে নিরুপায় হয়ে পড়ে। সংবাদ পেয়ে গোসাইরহাট ও ডামুড্যা উপজেলার যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডর ইকবাল হোসেন বাচ্চু ছৈয়াল মুক্তিযোদ্ধা রোস্তম আলীকে ডেকে এনে বুঝিয়ে বলে ভানু বিবি নিজের ইচ্ছায়তো আর এ ঘটনা ঘটায়নি। পাকহানাদার বাহিনী জোর পূর্বক ধরে নিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। শুধু ভানু বিবি কেন এ দেশের হাজার হাজার নারী পাকহানাদার বাহিনীর কাছে তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছে। এ নারীকে তালাক দেয়া যাবেনা। তখন লোক লজ্জার ভয়ে মুক্তিযোদ্ধা রোস্তম আলী ও তার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে একই উপজেলার কুচাইপট্রি ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডর ইকবাল হোসেন বাচ্চু ছৈয়াল তাদের নিজেদের একটি বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে বিরঙ্গনা ভানু বিবিকে স্বামীর সংসারে সন্তান নিয়ে ঠাই দেয়। দীর্ঘদিন সেখানে থাকার পরে দেশ স্বাধীন হয়। এরপর তার এলাকায় ফিরে এসে পুনরায় কোদালপুর ছৈয়ালপাড়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডর ইকবাল হোসেন বাচ্চু ছৈয়ালদের বাড়িতে একটি টিনের ঘর তুলে বসবাস করে। এরপর তাদের সংসারে আরো ৩টি পুত্র সন্তান শামীম, ওয়াসিম, ও রাজ্জাক এর জন্ম হয়। দীর্ঘদিন মুক্তিযোদ্ধা রোস্তম আলীকে নিয়ে ভানৃু বিবি জীবন সংগ্রামে যুদ্ধ করে স্বামী সন্তানদের নিয়ে দিনমজুরী করে খেয়ে পরে বেচে থাকে। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা রোস্তম আলী বেপারী মারা যায়। অসহায় হয়ে পড়ে বিরঙ্গনা ভানু বিবি ৪টি সন্তান নিয়ে খেয়ে পড়ে বেচে থাকা তার জন্য খুবই কষ্ট হয়ে পড়ে। বেশ কিছুদিন সে এলাকায় ভিক্ষে করে সন্তানদের নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। এক পর্যায়ে সে কোন উপায়ান্ত না পেয়ে ছেলে মেয়েদের কে নিয়ে ঢাকা চলে যায়। সেখানে গিয়ে মিপুর ১নং সেকশনে একটি বস্তিতে ঠাই নেয়। এরপর সে বাসায় বাসায় ঝিয়ের কাজ করে। একদিন ধানমন্ডির এক বাড়িওয়ালার স্ত্রী ভানু বিবির পরিচয় জানতে চাইলে সে একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী বলে পরিচয় দেয়। এ সময় সে ঐ বাড়িওয়ালার স্ত্রী কাছে নিজেকে অপরাধী বলে নিজের ইজ্জত হারানোর ঘটনা খুলে বলে। ভানু বিবির এ কথা শুনে ঐ বাড়িওয়ালী তার স্বামীর কাছে বিষয়টি জানায়। এরপর বাড়িওয়ালা ভানু বিবিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দপ্তরে নিয়ে যায়। সেখানে ভানু বিবি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার সব ঘটনা খুলে বলে। প্রধানমন্ত্রী তাকে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দেন। প্রধানমন্ত্রী ভানু বিবিকে নগদ ১ হাজার টাকা ও একটি শাড়ি কাপড় দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী তাকে গেজেটভুক্ত করার জন্য সার্বিক ব্যবস্থা করতে গোসাইরহাটের যুদ্ধাকালীন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডকে নির্দেশ দেন। এরপর থেকে বিরঙ্গনা ভানু বিবিকে গেজেট ভুক্ত করার ব্যবস্থা করতে বিভিন্ন দপ্তর ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ে কাগজপত্র জমা করা হয়। এখনো তার নামটি গেজেটভুক্ত করা হয়নি। বুধবার ও তিনি মন্ত্রনালয়ে গিয়েছিলেন। এখনো তার নামটি গেজেটভুক্ত করা হয়নি তাকে ভাতা ও দেয়া হয়নি। ইতোমধ্যে ভানু বিবির স্বামী রোস্তম আলীর নামে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বরাদ্ধ হয়। বর্তমানে সে স্বামীর ভাতা পায়। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে ও সে তার ইজ্জত বিষর্জন দেয়া বিরঙ্গনা ভাতা পায়নি। বস্তিতে ঠাই নেয়ে সে তিন পূত্র সন্তানদের সাথে নিয়ে অসহায় দিন যাপন করছেন। তার বড় ছেলে শামীম রাজমিস্ত্রি কাজ করে। দ্বিতীয় ছেলে ওয়াসিম ভেনগাড়ি চালায় এবং ছোট ছেলে রাজ্জাক গ্রিলের দোকানে কাজ করে। এ ভাবে চলছে তার জীবন জীবিকা। এ ব্যাপারে উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের হস্তক্ষেপ খুবই জরুরী বলে মনে করেন শরীয়তপুরের মুক্তিযোদ্ধাগন।
বিরঙ্গনা ভানু বিবির ছেলে শামীম বলেন, আমার মা আর আমরা তিন ভাই খুবই অসহায় দিন কাটাচ্ছি। দিন মজুরী করি ভেনগাড়ি, রাজমিস্ত্রি ও গ্রিলের দোকানে কাজ করে যা কিছু পাই তাই নিয়ে এবং আমার বাবার ভাতা দিয়ে খেয়ে পরে বেচে আছি। বিরঙ্গনা ভানু বিবি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ পাকহানাদার বাহিনী আমার সবকিছু নষ্ট করে দিয়ে গেছে। নিজের ইজ্জত বিষর্জন দিয়ে ও স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে ও আমাকে গেজেট ভুক্ত করেনি। আমি আমার বিরঙ্গা ভাতা পাইনি। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হয়ে আমার সন্তানদের নিয়ে ঠাই হয়েছে বস্তিতে। আমি আমার সঠিক সম্মান ও স¤œানী ভাতা পেতে চাই। আমি সমাজে একজন স্বাভাবিক মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেচে থাকতে চাই। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোঃ মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, আমরা ভানু বিবির পারিবারিক ও মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রয়োজনীয় সকল তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রালয়ে পাঠিয়েছ্ ি। এখনো তার নামটি গেজেটভুক্ত হয়নি। তাকে গেজেট ভুক্ত করা হলে তার নামে ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।