প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী বিদেশি শক্তির মদতে স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্রান্ত এখনো অব্যাহত আছে। তিনি এ ব্যাপারে জাতিকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। গতকাল শোকের মাস আগস্টের শেষ দিনে ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি একথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর খামারবাড়ির বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে (কেআইবি) অনুষ্ঠিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, এখনো যুদ্ধাপরাধী, পরাজিত শক্তি এবং ১৫ই আগস্টের খুনি, ফাঁসি যাদের হয়েছে তাদের ছেলেপেলে, যুদ্ধাপরাধীদের দোসর এবং বংশধর তারা কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এই বাংলাদেশে ১৫ই আগস্টের যে হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে এবং এরপর ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, আমার জীবনের ওপর বহুবার হামলা, ’৭৪ সালে কামালের (শেখ কামাল) ওপর হামলা হলো। তাকেও গুলি করে হত্যার চেষ্টা হলো যখন দেখলো সে বেঁচে গেছে। তার নামে মিথ্যা অপবাদ ছড়ানো হলো।

অর্থাৎ পরাজিত শক্তি সব সময়ই এক্ষেত্রে সক্রিয় ছিল। অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতির পিতা, বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব এবং ১৫ই আগস্টের শহীদদের স্মরণে সকলে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মৃতিচারণমূলক বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং আব্দুর রহমান এমপি। ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের সভাপতিত্বে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের বাৎসরিক প্রকাশনা ‘জন্মভূমি’ এবং ‘জয় বাংলা- ম্যাগাজিনের (২য় সংস্করণ) মোড়ক উন্মোচন করেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্রদের ভূমিকা রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে বাংলাদেশের প্রতিটি অর্জন সেই মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন বা যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সব সময় ছাত্ররাই করেছে। তারাই সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। জাতির পিতার অমোঘ বাণী ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ছাত্রলীগের ইতিহাস’ উল্লেখ করে তিনি তা সকলকে মনে রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এ ধরনের বাধাবিঘ্ন আসতেই থাকবে। কিন্তু সৎ পথে থাকলে এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং আদর্শ নিয়ে যদি চলা যায় তাহলে যেকোনো কঠিন পথ পাড়ি দিয়েও অবশ্যই সাফল্য অর্জন করা যায়। তবে, এটাও ঠিক সত্যের পথ সব সময় কঠিন হয়। আর সেই কঠিন পথকে যারা ভালোবেসে গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে পারে তারাই সাফল্য আনতে পারে। তিনি বলেন, জাতির পিতার নামটা মুছে ফেলতে চাইলেও আজকে ৭ই মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য দলিলে স্থান পেয়েছে। তেমনি বঙ্গবন্ধুর নামও সারাবিশ্ব জানে। আর কারো পক্ষে এটা মুছে ফেলা সম্ভব না।  সেটা সম্ভব হয়েছে কারণ, আমরা তার (জাতির পিতার) আদর্শ নিয়ে চলেছি, লক্ষ্য স্থির করে চলেছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে কিছু লোক থাকে সব সময় ক্ষমতাসীনদের পদলেহনকারী। এই চাটুকারের দল সব সময় নিজের দেশের এবং নিজের মানুষের ভাগ্য নিয়েও ছিনিমিনি খেলেছে। সব সময় আঁতাত করে আমাদের দেশের সর্বনাশ করেছে। যে জন্যই ’৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন গণহত্যা শুরু করে তখন স্থানীয় দালাল চক্র এবং পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা কোনোদিন চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। আর তারপর যখন বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করলো এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজিত হলো তখন সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই তারা ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড করেছিল। আর এর পরই বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামটা চিরতরে মুছে ফেলার অপচেষ্টা হয়েছিল। একটা মাত্র টিভি চ্যানেল ও রেডিওতে এবং স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে বিকৃত ইতিহাস প্রচার শুরু হলো। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং চেতনাসহ সবকিছু ধ্বংস করা হয়েছিল। ভাবখানা এমন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি আবার পাকিস্তানের একটি প্রদেশে পরিণত হয়েছিল এবং সেসব পাকিস্তানিরা আবার আমাদের ওপর এসে খবরদারি করবে- এটাই যেন আকাঙ্ক্ষা ছিল, বলেন তিনি। শেখ হাসিনা জাতির পিতাকে হত্যার নেপথ্য ক্রীড়নকসহ এদেশে হত্যা ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির গোড়াপত্তনকারী হিসেবে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানকে পুনরায় অভিযুক্ত করেন। তিনি বলেন, ’৭৫ এর পর যারা অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের মধ্যদিয়ে ক্ষমতা দখল করে সেখানে তার দলেরও যেমন বেঈমান, মোনাফেক, মীরজাফর ছিল- খন্দকার মোস্তাক গং আর তাদের শক্তিটা ছিল জিয়াউর রহমান।

প্রধানমন্ত্রী জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার করার কথা উল্লেখ করে বলেন, খালেদ মোশাররফ আহত হয়ে গেল এবং জিয়াকে সেক্টর কমান্ডার করা হয়েছিল। কিন্তু সে কখনো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গুলি চালিয়েছে এরকম কিন্তু কোনো নজির নেই। এরকম কোনো নজির কেউ দেখাতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক-রশিদের দম্ভভরে বিবিসিতে প্রদত্ত স্বেচ্ছায় ইন্টারভিউ প্রদানের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, কর্নেল ফারুক-রশিদ বিবিসিতে যে ইন্টারভিউ দিয়েছিল সে ইন্টারভিউতেও তারা স্বীকার করেছে, শুধু তাই নয় অনেক পত্র-পত্রিকাতেও তাদের বক্তব্য এসেছে- জিয়াউর রহমান এই খুনিদের সঙ্গে সবসময় ছিল। জিয়াউর রহমানই ছিল মূল শক্তির উৎস এবং সেই বেঈমানিটা করেছিল। অথচ এই জিয়াকে মেজর থেকে জাতির পিতাই মেজর জেনারেল করেছিলেন। শেখ হাসিনা বলেন, মেধাবী ছাত্রদের অস্ত্র, মাদক ও অর্থ তুলে দিয়ে বিপথে নিয়ে গেছে জিয়াউর রহমান। তার স্ত্রী খালেদা জিয়াও ক্ষমতায় এসে হুমকি দিয়েছিল, আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে তার ছাত্রদলই যথেষ্ট। তিনিও ছাত্রদলের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা কোনো কাজ অধরা রেখে যাননি। সব কাজের ভিত্তি তিনি প্রস্তুত করে গেছেন। যখনই এই পরাজিত শক্তি দেখলো আর বাংলাদেশকে বাধা দিয়ে রাখা যাবে না তখনই কিন্তু ১৫ই আগস্টের ঘটনা ঘটিয়েছিল তারা। তিনি বলেন, সেই কথা মনে রেখেই কিন্তু আমাদের পথ চলতে হবে যে আমাদের পায়ে পায়ে শত্রু আছে, পদে পদে বাধা আছে, আমাদের চলার পথ মসৃণ না, কন্টকাকীর্ণ। আমাদের চড়াই-উৎরাই পার হয়ে এগিয়ে যেতে হবে এবং আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। মাত্র ১২ বছরের মধ্যে আজকে বাংলাদেশ উঠে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী, আমার দেখা নয়া চীন ও গোয়েন্দা ডায়েরী ৭ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকেই বাংলাদেশের ইতিহাস এবং অনেক সত্য বেরিয়ে আসে। সরকারপ্রধান বলেন, ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন, বাংলাদেশ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ সিরিজের বইগুলো সম্ভবত পৃথিবীতে প্রথম প্রকাশিত এমন একটি গ্রন্থ যা কারো বিরুদ্ধে করা গোয়েন্দা রিপোর্ট নিয়ে, জাতির পিতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের রিপোর্ট নিয়ে প্রকাশিত। ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতা-কর্মীকে তিনি বইগুলো পড়ার আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গমাতার অবদানের কথাও আলোচনায় তুলে আনেন।

জাতির পিতার কন্যা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গিয়েছেন। আর তার পাশে থেকে সব সময় প্রেরণা দিয়েছেন, শক্তি দিয়েছেন আমার মা’ বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব। মায়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি আরও বলেন, আমার মা ছাত্রলীগ সংগঠনকে গড়ে তোলায় দিকনির্দেশনা দিতেন। আর্থিক সংকট দেখা দিলে নিজের হাতের গয়না বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে দিয়েছেন। সব সময় আমাদের পরিবারের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি ছিল। আমার মা এত সূক্ষ্মভাবে কাজগুলো করতেন, গোয়েন্দারা টেরই পায়নি।

প্রধানমন্ত্রী পড়াশোনার পাশাপাশি দেশ ও জনগণের কাজে ছাত্রলীগকে মনোনিবেশ করার নির্দেশ দেন এবং করোনাভাইরাসের সময় দেশের জনগণের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ায় ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতা-কর্মীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। লাশের দাফন-কাফন থেকে শুরু করে অসুস্থদের জন্য অক্সিজেন, ক্ষুধার্ত জনগণের জন্য খাদ্য সরবরাহ এমনকি কৃষকদের গোলায় ধান তুলে দেয়ার মাধ্যমে কোনো কাজই যে ছোট নয় তারা তা প্রমাণ করেছে এবং এভাবেই মানবসেবার মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা তারা অর্জন করবেন বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। জাতির পিতার যে ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের যে আত্মত্যাগ তা কখনো বৃথা যেতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ দেশকে গড়ে তোলার জন্য তোমাদের (ছাত্রলীগ) নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে হবে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn