হজযাত্রীদের প্রশিক্ষণের কোটি টাকা কার পকেটে?
হাসান হামিদ
আমি এ বছর হজ ক্যাম্পে গিয়েছিলাম ১৭ আগস্ট। সেখানে দেখলাম ভীড় আর গরমে হজযাত্রীদের অনেকেই দম ফেলার শান্তিটুকু পাচ্ছিলেন না, তার উপর রয়েছে ভয় আর উৎকণ্ঠা। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের দরুণ বেশির ভাগ মানুষই প্রায় শেষ বয়সে হজে যান। সেইসব সম্মানিত মানুষদের অসহায় করে দেয় যারা, তাদের বিরুদ্ধে খুব কড়া পদক্ষেপ বিগত বছরে নেওয়া হয়নি বলেই প্রতি বছর একই ঘটনা ঘটছে।টাকা নিয়ে তাদের যাবার ব্যবস্থা করা হয় না। বিষয়টা এমন, সময় পার হয়ে গেলে কর্তৃপক্ষের আর দায় থাকে না। আর ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রশিক্ষণের নামে হজযাত্রীদের কাছ থেকে (প্রতিজন ৩শ টাকা) ৩ কোটি ৮১ লাখ ৫৯ হাজার ৪শ টাকা গ্রহণ করেছে বলে পত্রিকার খবরে পড়েছি। কিন্তু বিনিময়ে কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি জেনে খুব কষ্ট লেগেছে। এতে হজযাত্রীদের অধিকার ক্ষুণ হয়েছে শুধু নয়, যদি এর লাগাম এখনই টেনে ধরা না হয়; তবে ভবিষ্যতে আরো হীন কিছু ঘটবে।
গত ১০ আগস্ট বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলেমদের এক কর্মশালায় ধর্মমন্ত্রী ঘোষণা দেন, একজন হজযাত্রীকে বাকি রেখেও তিনি হজে যাবেন না। কিন্তু এরপরও ফ্লাইট বিপর্যয় অব্যাহত থাকে। সর্বশেষ ভিসা থাকার পরও এজেন্সির প্রতারণায় বিমানের টিকেট না থাকায় হজে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চতায় থাকা হজযাত্রীরা আশকোনা হজ ক্যাম্পে বিক্ষোভ করেছেন, তাতে লাভ হয়নি। শেষমেষ ৩৬৭ জন হজযাত্রী রেখে মন্ত্রী মহোদয় চলে গেছেন। তিনি যাবেন সেটা স্বাভাবিক; কিন্তু যারা অসহায় হয়ে অপেক্ষায় ছিলেন, তাদের দুই কথা বলে যেতে পারতেন তিনি। জানা গেছে, কয়েকদিন ধরে এই হজযাত্রীরা হজক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। তারা আশা করছিলেন শেষ মূহুর্তে তারা যেতে পারবেন। কিন্তু তাদের সব আশা শেষ হয়ে যাওয়ায় চোখের পানিতে শেষ পর্যন্ত হজক্যাম্প ছেড়েছেন। আমি জানি না তারা কী কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
বেসরকারি এজেন্সি মালিকদের সংগঠন হাব এ বছর হজ কার্যক্রমে চরম অব্যবস্থাপনার জন্য সরকারকে দায়ী করেছে। প্রাক-নিবন্ধন থেকে শুরু করে প্রতিটি পদে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে। একের পর এক ফ্লাইট বাতিলে চলতি বছর হজের শিডিউল বিপর্যয় ঘটে। চলতি বছর হজ ফ্লাইট শুরুর পর থেকেই শুরু হয়েছিল হজযাত্রীদের ভোগান্তি। আর সেই ভোগান্তি শেষ দিকে এসে চরমে পৌঁছেছিল। ভুক্তভোগী হজযাত্রীদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছিল রাজধানীর আশকোনায় হজ ক্যাম্প। আবার পত্রিকার খব্রে এসেছে, আশকোনার হজ অফিসে অভিযোগ করতে গেলে ঠিকমত অভিযোগ নেয়া তো দূরে থাক, উল্টে হজযাত্রীদের সাথে হজ অফিসের কর্মকর্তারা অশোভন আচরণ করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর ফ্লাইট বাতিলের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সময় মতো ভিসার আবেদন না করা, মোয়াল্লেমের সঙ্গে এজেন্সিগুলোর বিলম্বে চুক্তি, সময়মতো বাড়িভাড়া না করা, ভিসা লজমেন্ট ও মোফা সেন্ড করতে বিলম্ব করা, হজ এজন্সিদের গাফিলতিতে যাত্রীর অভাবে এবার অনেকগুলো হজ ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। এইসব আর কতোদিন চলবে?
বছরের পর বছর এই সংস্কৃতি চলে আসছে যে, বহু হজযাত্রীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায় হজ এজেন্সির মালিক, এজেন্ট ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। এদের অনেকের ভিসা হয় অনেক আগে কিন্তু এজেন্সি গুলো তাদের বিমানের টিকেট দেয় না। ভিসাপ্রাপ্ত হজযাত্রীদের সৌদি পাঠাতে এজেন্সি মালিকরা টালবাহানা শুরু করে। তারপর প্রতিটি এজেন্সি হজযাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা দাবি করে থাকে। মধ্যস্বত্বভোগী দালালচক্র প্রায় হজযাত্রীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে এজেন্সিকে ঠিকমত জমা দেয় না। তাই পরে এজেন্সির মালিকরা ভিসা হওয়া সত্ত্বেও টিকিট কাটে না। প্রতারণা করে মধ্যসত্বভোগী ও অনেক এজেন্সি মালিক ঊধাও হয়ে গেছে, অনেকে পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে; কে রাখে কার কান্নার খবর? এই অপসংস্কৃতি এই জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের কাছে তেমন কিছুই না।
হজ ফ্লাইট বাতিলের জন্য কয়েকটি বিষয়কে চিহ্নিত করা যায়। এবছর ফ্লাইট বাতিল হওয়ার জন্য অনেকেই হাবকে দায়ি করেছিলেন। হজ ফ্লাইট বাতিলের কারণগুলো হলো ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে মোয়াল্লেম ফি দেওয়া, দ্বিতীয় হজে ২ হাজার সৌদি রিয়াল চার্জ ধার্য করা, ই-ভিসা প্রিন্টিংয়ের জটিলতা, ৯১ এজেন্সির মোয়াল্লেম না পাওয়া, মদিনায় ৮ দিন থাকার বাধ্যবাধকতা, শুরুতে বিমান ভাড়া ৩ হাজার টাকা ভাড়া বৃদ্ধি করা। তিনি সাংবাদিকদের জানান, হজ অব্যবস্থাপনার জন্য ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, সৌদি আরব, হজ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সঠিক সময়ে সঠিক কাজ না করায় সৌদিতে হজযাত্রী পাঠাতে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। আমার প্রশ্ন হলো, প্রতিবছর নানা অব্যবস্থাপনার কারণে হজ ক্যাম্পে অনেক হজযাত্রী থাকার নজির স্থাপন করে চলেছে আমাদের কর্তৃপক্ষ। এর সুরাহা কি কোনোদিন হবে না?
লেখক- গবেষক ও সদস্য, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র।