তামিমুল করিম হৃদয় ::

আগাম বন্যা বা অতি বৃষ্টিতে দেশের বিপুল এলাকার কৃষি জমি তলিয়ে যাওয়া এবং নানা প্রাসঙ্গিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে দেশবাসী উদ্বিগ্ন। কৃষকের অসহায় যাতনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনায় সম্ভবত প্রথম বারের মত বাঁধ তৈরীতে অনিয়মের একটি শক্ত প্রতিরোধ গড়ে উঠল। এই প্রতিরোধে শুধুমাত্র পাউবো ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের বিষয়টি মুখ্য আলোচনায় চলে এসেছে। এর সাথে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে অনেক তদারকী দপ্তর/ব্যক্তির প্রাতিষ্ঠানিক দায়ও সংশ্লিষ্ট। পাউবো ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ অবলম্বন বা তাদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার কোন উদ্দেশ্য আমাদের নয়। বিষয়টির একটি দায়িত্বহীনতার চিহ্নিত করা গেলে ভবিষ্যতে এর সুরক্ষায় সহায়ক হতে পারে ভাবনায়ই এ অবতারনা। যে কোন এলাকার উন্নয়ন কাজ, ভৌত অবকাঠামো নির্মানে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, স্টেকহোল্ডার, সচেতন নাগরিকগণের অনেক নৈতিক দায় আছে-যা এড়ানো উচিত নয়।  আমরা বলতে চাই দেশের কৃষি উন্নয়ন, কৃষকের উন্নয়নে সরকারের এত এত ভর্তুকি, সদিচ্ছা কেন প্রজাতন্ত্রের কমর্চারী/জনপ্রতিনিধিদের অবহেলার বলি হবে? সুনামগঞ্জ জেলাসহ দেশের বিপুল এলাকার কৃষি ফলন কেন এভাবে অংকুরেই বিনষ্ট হবে?

পাউবো বা তার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কি এসকল কর্তাব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রন এবং তদারকীর ঊর্ধে? সরকার কৃষির উন্নয়নে ধারাবহিক কাযর্ক্রমে কৃষি কোর কমিটি গঠণ করেছেন। যতদুর জানা যায় এ কমিটি ইউনিয়ন পর্যায় থেকে উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায় কাজ করে।  কৃষি ফলন এভাবে বিনষ্ট হওয়ার বিষয়টি কি তারা আদৌ নজরে রেখেছিলেন? এ বিষয়ে কি সরকারের কোন উচ্চ স্থরে অবগত করেছিলেন? কোন সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল কি? নাকি সবাই নাকে তেল দিয়ে শুধু ফটোসেশনে ব্যস্ত ছিলেন। হাওর এলাকার উন্নয়ন সরকারে একটি অগ্রাধিকার বিষয়। হাওর উন্নয়নে সরকার একটি হাওর উন্নয়ন বোর্ডও গঠন করেছেন। হাওর উন্নয়ন বোর্ড এ ক্ষেত্রে কি কাজটি করেছ?? আমরা জানি সরকারের স্থানীয় প্রশাসনের নির্ভরতা ও সমন্বয়ে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনই নিয়ামক শক্তি। যে সকল হাওর রক্ষা বাঁধ সঠিকভাবে নির্মাণ হয়নি সেসকল এলাকার উপজেলা, জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির কোন সভায় কি বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে?

জেলা প্রশাসকগণ প্রতি মাসে সরকারের নিকট একটি মাসিক প্রতিবেদন প্রেরণ করেন। উক্ত প্রতিবেদনে জেলার বিশেষ কোন বিষয়ে সরকারের আশু দৃষ্টিযোগ্য বিষয় উল্লেখেরও একটি বিষয় রয়েছে। যা সরকার বিশেষ গুরুত্বের সাথে সবসময় বিবেচনা করে থাকেন। সঠিকভাবে বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ হলেও কোন মাসিক প্রতিবেদনে কি বিষয়টি স্থান পেয়েছিল? এই সব প্রশ্নবোধকের সম্ভবত একটিই উত্তর, না। নির্বাচনে প্রার্থী বিজয়ী করতে আমাদের বিভিন্ন স্থরের নেতৃরৃন্দ যেভাবে মাঠে চষে বেড়ান, এহেন কোন পদক্ষেপ নেই বিজয়ী করেত যা অবলম্বন করেন না এরুপ বিন্দুমাত্র কোন ভূমিকা কি কোন জনপ্রতিনিধি, নেতা গ্রহণ করেছেন? এর উত্তরও “না”। তবে কৃষি আর কৃষক যাবে কোথায়? ঐ চকলেটের বিজ্ঞাপনই শিক্ষণীয়-উপর ওয়ালা জানেন। হাওরে পানি বাড়ার সাথে চালের মূল্য বৃদ্ধির কোন অথনৈতিক সুত্র নিশ্চয়ই আছে, যা হয়তো বিশ্বের অনেক ইকোনমিক জার্নালও জানেনা, জানে শুধু আমাদের দেশের চাল ব্যবসায়ীরা।  না হলে কোন যুক্তিতে এক-দু’দিনের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি ৩-৪শ টাকা মূল্য বৃদ্ধি পায়। সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোন কাজটি করেছেন। ভ্রাম্যমান আদালত গুটিয়ে থাকলো কেন? আসলে সকলেই গড্ডালিকা প্রবাহে জলকেলিতে ব্যস্ত। চাকরামি করতে হয় বলে করা, চাকরামির মধ্যে কোন আন্তরিকতা, দায়বদ্ধতার বালাই নেই। সকল যন্ত্রের মধ্যে যতক্ষন পর্যন্ত “চেক এন্ড ব্যালেন্স” সিস্টেম কঠোরভাবে বাস্তবায়ন না হচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত আরো অনেক দূর্ভোগ পোহানোর জন্য আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।

বিশেষত: সরকারি কাজের ক্ষেত্রে কোন জনপ্রতিনিধি, নেতা, আমলা বা কোন প্রেসার গ্রুপের অযাচিত হস্তক্ষেপ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি কমন স্ট্যান্ডার ক্রাইটেরিয়া প্রনয়ণ করে ইজিপি বাস্তবাযন নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ খুব সফলতার সাথে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি দেশের আপামর জনসাধারণের আস্থা অবিচল।  সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। এখনও কয়েকটি কাজে দক্ষতা প্রদর্শব করে যাচ্ছে। জাতীয়  স্বার্থে হাওর রক্ষা ও হাওর উন্নয়নে এ কোরকে দায়িত্ব প্রদানের বিষয়টি বিবেচনার দাবী রাখে। একটি সমন্বিত এবং লাগসই পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে: যেখানে বাঁধের বহুমুখি ব্যবহার, জীববৈচিত্র রক্ষা, মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও সুরক্ষা, কৃষির আধুনিকায়ন ইত্যাদি বিষয় গুরুত্ব পাবে। হাওর অঞ্চলে এলজিইডি, সিবিআরএমপি, আইসিইউএন ইত্যাদি যৌথ ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু প্রকল্প চলমান আছে। বতর্মান দূর্যোগে এ সকল সংস্থার গৃহীত কার্যক্রম কতটুকু যথার্থ ছিল তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যদি এসকল সংস্থা কোন কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ না করে থাকে তবে তাদের দায়বদ্ধতা এবং এসকল সংস্থার সাথে সম্পাদিত চুক্তির বিষয়টি পুনঃবিবেচনার দাবী রাখে।

কারণ, সিবআরএমপি সরকারের নিকট হতে অনেক মিষ্টি কথার উল্লেখে বেশ কয়েকটি জলমহাল সরকারের নিকট হতে হস্তান্তর করে নিয়ে গেছে। যা আসলে তাদের নানারুপী ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। সার্বিকভাবে হাওর ও হাওর অঞ্চল নিয়ে সকল স্থরেই একটি তুঘলগি কান্ড বিস্তৃত আছে, যার লাগাম এখনই টানা উচিত। সকল ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র একটি সংঘবদ্ধ দায়িত্বহীনতার চিত্রের খুঁজ পাওয়া যায়, যা হাওর অঞ্চলের এ দূর্ভোগকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলতে নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে বলে প্রতীয়মান হয়। একটি ভূল হতে পরবর্তী সংশোধনের ব্যবস্থা না হলে ভূলটি বিস্তৃত হতে হতে এর কুফল অনেক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই শুধরোনোর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। অ-কাজের শ’য়েক কাজীর থেকে কাজের এক কাজীই যথেষ্ট এটা বিবেচনায় রাখতে হবে। একটি খন্ড চিত্র : বিগত প্রবল বর্ষনের সময়। বিশেষত গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার যে সকল পাথর শ্রমিকের বাড়ী সুনামগঞ্জ জেলায়, তাদের দেখা গেছে বাস ভর্তি করে সকলেই নিজ নিজ বাড়ী উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন। কারন পাথর কোয়ারিতে কাজ নেই, আবার এলাকায় যা কিছু ধানী জমি তা নিজের বা বর্গা হোক তা তলিয়ে যাচ্ছে।

অনেকের সাথে আলোচনায় জানা গেল এই জমি চাষে অনেকের ঋন অপরিশোধিত আছে, কারো কারো হালের গরু বিক্রি করতে হয়েছে। অনেকের নিকট বাড়ী যাবার ভাড়াটিও নেই। একটি বালতির মধ্যে সংসারের সবকিছু নিয়ে কি প্রানান্তকর যাত্রা। চোখে মুখে অজানা আতংক, হতাশা, অনিশ্চয়তা। শরণার্থীর চেহারা স্মরণ করিয়ে দেয়। মানবিক হৃদয়ই শুধুমাত্র এ চেহারার গভীর বিষাদ অনুভব করতে পারে। ভাসমান জীবনের এ অসহায় চেহারার কসম, খেটে খাওয়া মানুষদের জীবনের নির্ভরতা যেনো আরাম আয়েশী ব্যবস্থাপনার অমানবিকতায় আর নষ্ট না হয়। হাওর ও হাওর জনপদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যেনো এখনই বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। আর যারা এদের পবিত্র পরিশ্রমের ফল নিয়ে  খেলায় মেতেছে, খেলায় মাতার পায়তারায় আছে তাদের একটি কঠোর মেসেজ দেয়ারও প্রয়োজন রয়েছে। আমরা আশা করি, যে সকল কর্তা ব্যক্তি এখনও নাকে  পুরোপুরি তেল দেননি বা ঘুমের আবেশ এখনো আসেনি তারা অন্তত বিষয়টি ভেবে দেখবেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn