হাওরের বাঁধ নিয়ে আবারো শঙ্কা-সংশয়
হাওরের বাঁধ নির্মাণ শুরু হওয়ার কথা মাঝ ডিসেম্বর থেকে। শেষ করার কথা ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। নির্ধারিত সময়ের এক মাস পেরোতে চললেও নির্মাণকাজ প্রায় শুরুই করা যায়নি। সুনামগঞ্জে বাঁধ নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৯৬টি কমিটির মধ্যে কাজ শুরু করতে পেরেছে মাত্র চারটি। বাঁধ নির্মাণের এ বিলম্ব আবারো ভাবাচ্ছে হাওরের কৃষকদের। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ নিয়ে সংশয় তো আছেই, বাঁধের স্থায়িত্ব নিয়েও শঙ্কায় আছেন তারা। বাঁধ নির্মাণে এ বিলম্বের জন্য প্রকৃতিকে দুষছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। হাওরের পানি না নামার কারণে বাঁধের কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে বলে দাবি তাদের। যদিও স্থানীয়রা দুষছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে। হাওরে বাঁধ নির্মাণকাজে বিলম্ব হয়েছিল গত বছরও। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও অনেক বাঁধের কাজ গত বছর শেষ করতে পারেনি পাউবো। ফলে মার্চ-এপ্রিলে হাওড়ের বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ বোরো ফসল। সরকারি হিসাবেই ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে সার্বিক চাল উত্পাদনে। উত্পাদন ঘাটতিতে চালের বাজার চড়ে যায় অস্বাভাবিক।
গত মৌসুমে বাঁধ নির্মাণে পাউবো ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর ঠিকাদার প্রথা বাতিল করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ঠিকাদারদের বদলে সব বাঁধের কাজ হবে স্থানীয় কৃষকদের সমন্বয়ে গঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) আহ্বায়ক করে পাউবো কর্মকর্তাকে রাখা হয়েছে পিআইসির সদস্য সচিব হিসেবে। তবে কর্তৃত্ব খর্ব হওয়ায় কিছুটা নাখোশ পাউবো কর্মকর্তারা। পাউবো সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক ভুঁইয়া বলেন, নীতিমালা পরিবর্তন করে বাঁধ নির্মাণে যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তারা এ কাজে দক্ষ নয়। ফলে কাজ শুরুতে বিলম্ব হচ্ছে। পিআইসি গঠন হলেও অনেক কমিটির বিপরীতে এখন পর্যন্ত ব্যাংক হিসাব খোলা হয়নি। ফলে তাদের কাজে টাকাও ছাড় দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।যদিও জেলা প্রশাসন বলছে ভিন্ন কথা। হাওড়ের পানি না নামার কারণেই বাঁধ নির্মাণে বিলম্ব হচ্ছে বলে দাবি তাদের।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলাম বলেন, প্রকৃতির ওপর আমাদের হাত নেই। পানি না নামার কারণে বাঁধের কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে। বাঁধের কাজ শুরু ও শেষ করার যে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে তা কেবল সুনামগঞ্জের জন্য নয়, সারা দেশের জন্য। প্রকৃতি ও অবস্থানগত ভিন্নতার কারণেই সুনামগঞ্জের কাজ শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছে। পাউবোর সুনামগঞ্জ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এবার জেলার ১১ উপজেলার মোট ৫৩টি হাওড়ে সাড়ে ৫০০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এজন্য মোট ১ হাজার ৯৬টি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। প্রকল্পের সমসংখ্যক পিআইসিও গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি পিআইসি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার কাজ করবে। এজন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ৬ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওড়ে দুটি প্রকল্পের কাজ শুরুর মাধ্যমে বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু হয়। বুধবার শুরু করা হয় জামালগঞ্জের পাকনার হাওড়ে মুচিবাড়ি ও গজারিয়া বাঁধের নির্মাণকাজ। তবে এ উপজেলায়ও এখন পর্যন্ত সবগুলো প্রকল্পের প্রাক্কলন শেষ হয়নি বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীম আল ইমরান। তিনি বলেন, ৭০টির মতো প্রকল্পের প্রাক্কলন শেষ হয়েছে। আর হয়তো ৩০টির মতো হবে।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে সুনামগঞ্জে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে। গত বছর আবাদ হয়েছিল ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৫ হেক্টরে। কৃষকদের প্রত্যাশা ছিল, গত মৌসুমে ফসলহানির ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এবার নির্ধারিত সময়েই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হবে। কিন্তু এবারো নির্ধারিত সমর পেরিয়ে যাওয়ার পরও কাজ শুরু না হওয়ায় সংশয়ে আছেন তারা। জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনেরবাঁক এলাকার কৃষক আসাদ উদ্দিন বলেন, গত বছরও নির্ধারিত সময়ে বাঁধ নির্মাণ শুরু না হওয়ায় সময়মতো তা শেষ করা যায়নি। একই অবস্থা এ বছরও। বিলম্বে শুরু করায় নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শেষ করা অসম্ভব হবে। ফসল নিয়ে আমাদের বিপদে পড়তে হতে পারে এবারো। তাড়াহুড়ার মধ্য দিয়ে কাজ শেষ করলে বাঁধ দুর্বল হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন কৃষকদের অনেকে। এ আশঙ্কার কথা জানিয়ে দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া এলাকার কৃষক আবদুুল হক বলেন, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়া করা হবে। এমনটা হলে বাঁধ হবে দুর্বল। কয়েক বছর ধরেই এমনটা হয়ে আসছে। বাঁধ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই বলে কৃষকদের আশ্বস্ত করেন সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক। তিনি বলেন, আমরা সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করছি। কোনো মহল থেকে যাতে কোনো ধরনের প্রশ্ন না ওঠে, সেভাবে কাজ করছি আমরা। কাজ যেহেতু শুরু করতে পেরেছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা শেষও করতে পারব।
উল্লেখ্য, গত বছরের মার্চে পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে বাঁধ ভেঙে পানিতে নিমজ্জিত হয় প্রায় সোয়া দুই লাখ হেক্টর জমির বোরো ধান। এ পরিমাণ জমির ধান থেকে চাল উত্পাদন হওয়ার কথা ছিল প্রায় ১০ লাখ টন। ফসলহানির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মত্স্য ও প্রাণিসম্পদেরও। হাওড়ে ফসল না থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়েন বিপুলসংখ্যক কৃষিশ্রমিক।