হাওরের ‘বিস্ময়’: রাবি পড়ুয়া রহমত ও তার মা রেজিয়া
আতিক রহমান পূর্ণিয়া-
ময়লা-ছেঁড়া কাপড় গায়ে মধ্যবয়সী রেজিনা খাতুন ছেলেকে নিয়ে এসেছেন কিশোরগঞ্জের দুর্গম হাওর বেষ্টিত মিঠামইন উপজেলা পরিষদ ডাক বাংলোতে। কাঁদামাখা খালি পা। রেজিনা খবর পেয়েছেন ডাক বাংলোতে সাংবাদিক আছেন। রাত তখন প্রায় দেড়টা। সাংবাদিককেই তিনি তার ছেলের ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তার কথাগুলো বলার শেষ ভরসা মেনে নিয়ে এসেছেন। রেজিনার পেছন পেছন আসা ছেলে রহমত আলী এবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। গায়ে ছেঁড়া একটি টি-শার্ট আর পুরানো রংচটা জিন্স প্যান্ট। পায়ে সেলাই করা স্পঞ্জের সেন্ডেল। অনেকটা সময় নিয়ে রেজিনা বলে গেলেন কীভাবে ভিক্ষা করে করে ছেলে রহমতকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছেন। আর জানালেন এতদূর এসে থমকে যাওয়ার এক অজানা আশঙ্কার কথা। রেজিনা ও তার ছেলের সাথে ছিলেন মিঠামইনের কিংবদন্তি শিক্ষক শ্যামল কান্তি বিশ্বাস।
রেজিনা, রহমত এবং শিক্ষক শ্যামল কান্তি জানালেন, ২০০৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ের এক কর্মকর্তার নজরে পড়েন রহমত। সেই কর্মকর্তা রহমতকে প্রাথমিকে ভর্তি করতে তুলে দেন শ্যামলের হাতে। শ্যামল কান্তি তখন মিঠামইনের ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। রহমতের মা রেজিনা মিঠামইন উপজেলা কমপ্লেক্স ও তার আশপাশে ঠিকা বুয়ার কাজ করতেন। সববেলায় ছেলের জন্য খাবারও জোটাতে পারতেন না। দিনের পর দিন না খেয়ে খালি পেটে স্কুলে যেত রহমত। নিরব স্বভাবের ছেলেটির ক্ষুধার জ্বালা কখনও কখনও টের পেয়ে শিক্ষকরা এক-দু টাকা দিতেন। তা দিয়েই কেক-বিস্কুট খেয়ে ক্লাস রুমে পড়ায় মন বসাতো রহমত। শৈশবে বাবা হারানো রহমত এভাবেই চেয়ে-চিন্তে মায়ের কষ্টের যৎকিঞ্চিত রোজগারের ছায়াতলে থেকে প্রাথমিকের গন্ডি পার করে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয় মিঠামইন উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে সবাইকে চমকে দেয় রহমত।
মাহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের ছোট ভাই ও কলেজ প্রিন্সিপলসহ স্থানীয়দের সহায়তায় এসএসসি পাস করে সুযোগ পেয়ে যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে। ভর্তির ৫ মাস পর ঈদের ছুটিতে এবার বাড়ি এসেছে রহমত। রেজিয়া বলেন, ‘আমি চলি মাইগ্গা (ভিক্ষা করে)। আর পারতাছি না। অহন আমার ছেরেডারে কেউ একটু টান দিলেই উইঠা যাইতো।’ রেজিয়া গত দশ বছর যত টাকা শ্রম দিয়ে রোজগার করেছেন বা সহযোগিতা পেয়েছেন তার প্রায় সবটাই ব্যয় করেছেন রহমতের জন্য। ফাঁকে ফাঁকে সঞ্চয়ও কিছু করেছিলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার খরচ সম্পর্কে রেজিনার ধারণা কল্পনারও বাইরে ছিলো। ছেলের ভর্তি কোচিং, রাবিতে ভর্তি আর পাঁচ মাস খরচের পর এখন রহমতের রাবিতে থাকা-খাওয়া ও লেখাপড়া বাবদ মাসপ্রতি প্রায় ৭/৮ হাজার টাকা কোনওভাবেই জোগাতে পারছেন না রেজিনা।
রহমত এখনও হলে সিট পায়নি, থাকে রাবির পাশে এক মেসে। রেজিনা বলেন, ‘যত টেকা পাডাই, পিতে খালি কয় খাওন হয় না। হোস্টেল এক সিট কইরা দিক।’ রহমত বলেন, ‘আমার লজ্জার বা ছোট হওয়ার কিছু নাই। সবার সহযোগিতায় লেখাপড়া শেষ কইরা মারে দেইখা রাখমু, দেশের লাইগা কাম করমু।’ রেজিনা, রহমতের সাথে আলাপচারিতার একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়, পরদিন (শুক্রবার) ভোরে তাদের থাকার জায়গাটি দেখতে যাওয়ার। আগেই তারা জানিয়েছিলেন, তাদের থাকার কোনও ঘর নেই, বাড়ি নেই। উপজেলা প্রশাসনের কৃপাতেই কমপ্লেক্সের ভেতর মাথাগুঁজার একটু ঠাঁই আছে মাত্র। শুক্রবার ভোর সাড়ে পাঁচটায় মিঠামইন উপজেলা স্টাফ কোয়ার্টার করতোয়ায় গিয়ে দেখা যায় ডাইনিং স্পেসটিতে নোংরা স্যাঁতস্যাঁতে চৌকিতে রাত কাটায় রহমত। আর তারপাশেরই আবর্জনায় ভরপুর পরিত্যক্ত রান্না ঘরের মেঝেতে কোনও রকম ছেঁড়া কাথা বালিশে ঘুমিয়ে আছেন হাওরের এক ‘অনন্য’ মা রেজিনা।