হাওরে বন্যা – সুনামগঞ্জের বুকে দুঃসহ হোমানল
হাসান হামিদ–
কিছুদিন আগে ফসল গেছে, ঘরে খাবার নেই; মাছ না পেয়ে রোজগার বন্ধ হওয়াতে তারপর গ্রাম ছেড়েছে মানুষ। এখন ঢেউয়ে ঘর-বাড়ি ভাঙছে অসহায় সুনামগঞ্জের সেইসব মানুষের। ঘরে পানি উঠছে, কেউ মাচায় আশ্রয় নিয়েছে, কেউ অন্যের ঘরে থাকে। ঢেউয়ে কারো কারো ভিটা-মাটি ভেঙে যাওয়ায় ঘর হেলে গেছে; না হয় পড়ে গেছে। এখনো সরকারের দায়িত্বশীলদের তেমন কার্যক্রম নেই। না খেয়ে থাকা, আধ পেটে থাকা এই মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলুন, তেমন বিপর্যয় আসেনি; সব ঠিকঠাক।
পানি কিছুটা কমে যাওয়ার খবর যখন পেয়েছি, তখন বৃষ্টি আবার শুরু হয়েছে। খবরে দেখলাম, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কের কার্যালয় (ইউএনআরসিও) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ গবেষণা কেন্দ্রের (জেআরসি) বৈশ্বিক বন্যা সতর্কতা পদ্ধতির (গ্লো-এফএএস) বিশ্লেষণ করে ‘আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হতে পারে’ এই মর্মে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে। তারা বলছে, গত ২০০ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার বন্যার উজানে মাত্রা সবচেয়ে ভয়াবহ হবে। ইসিএমডব্লিউএফ পূর্বাভাসে আরও বলা হয়েছে, আগামী ১০ দিনের মধ্যে হিমালয়ের দক্ষিণাঞ্চলে ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এতে করে ব্রহ্মপুত্রের ভারত ও বাংলাদেশ অংশে পানি বাড়বে। তবে বন্যা পরিস্থিতি নির্ভর করে বৃষ্টিপাতের ওপর। ইতিমধ্যে পানি বৃদ্ধির পরিমাণ কমে আসছে। কিন্তু আবার বৃষ্টি শুরু হওয়াতে আতঙ্ক বোধ করছি।
আমি যে গ্রামে জন্মেছি সেটি সুনামগঞ্জ জেলার হাওর পাড়ের আবিদনগর। সেখানে আসেপাশের সব গ্রামেই দেখেছি, হাওরাঞ্চলে বর্ষা আসার সময় আগে বছর বছর আগাম বাড়ী-ঘর বাঁধা হত। এবার আগাম পানি চলে আসায় অসুবিধা হয়েছে বাড়ি বাঁধায়। হাওর থেকে চাইল্লা বন এনে বাড়ি বাঁধা সম্ভব হয়নি। আফালের ঢেউ থেকে বাড়ি-ঘর রক্ষার কোন ব্যবস্থাও হয়নি। আমার এলাকায় ধর্মপাশা-মধ্যনগরের সব গ্রামের এই অবস্থা। আর এই অবস্থায় এমন উচ্চতার পানিতে ১০ মিনিট বাতাস দিলে হাওরাঞ্চলের অনেক বাড়ী-ঘর পানিতে মিশে যাবে, সেটা জানা কথা। আগাম বন্যায় একমাত্র বোরো ফসল হারানোর পর আবারও বন্যার প্রকোপে পড়ে জেলার কৃষকরা সর্বশান্ত হচ্ছেন। ঘর বাড়ি হারিয়ে দিশেহারা সবাই।
আমার মনে হয়, হাওর এলাকার দুর্গত মানুষের পাশে এখন দাঁড়াতে হবে পুরো দেশের মানুষকে। বেসরকারি সংস্থাগুলোরও জরুরি ভিত্তিতে হাওর এলাকায় ত্রাণ কাজ পরিচালনা করা দরকার। দুর্গত এলাকায় উপযুক্ত পরিমাণে খাদ্য, জলপরিশোধনকারী ট্যাবলেট, পেটের পীড়ারোধের ওষুধ, খাবার স্যালাইন জরুরি ভিত্তিতে পাঠানো দরকার। পাশাপাশি গবাদি পশুর খাদ্যের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। হাওরের কৃষক বাঁচাতে এখন সরকারি পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ বিতরণ করা দরকার। সেই সাথে স্থানীয় মহাজনদের হাত থেকে দরিদ্রমানুষকে বাঁচানো প্রয়োজন। এনজিওগুলোর এখন বাধ্যতামূলকভাবে ঋণ মওকুফ করতে হবে। আর পুরো এলাকার পানিশোধনের ব্যবস্থা করা দরকার। হাওর বাঁচাতে দরকার সবক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে, সাংগঠনিক পর্যায়ে। ব্যক্তিগত ভোগবিলাস কিছুটা কমিয়ে আসুন আমরা সকলে ত্রাণ নিয়ে হাওরবাসীর পাশে দাঁড়াই; কেননা আগে হাওরের দুর্গত মানুষদের বাঁচাতে হবে। বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগে সবচেয়ে যেটা জরুরি সেটি হলো জাতীয় ঐক্য। এই জাতীয় ঐক্য ধরে রেখে সকল দেশপ্রেমিক মানুষ এক হয়ে দাঁড়াতে হবে দুর্গত হাওরবাসীর পাশে।
কৃষক জাতির মেরুদণ্ড। কৃষক বাঁচলে দেশ বাচবে। যদিও কৃষকের কল্যাণে অনেক কথা শোনা যায়, কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কতটা হয় তা তো বিদ্যমান পরিস্থিতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। হাওরবাসীর প্রত্যাশা, সরকার দ্রুত এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে কান্না থামানোর জন্য আরো কার্যকর উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে। যে কোনো দুর্যোগেই মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়, আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে অগণিত মানুষ। আর অসহায়দের সাহায্যে এগিয়ে আসা একটি মহৎ কাজ। যে কোনো দুর্যোগ মুহূর্তে প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী সাহায্যের হাত প্রসারিত করা। মানুষ মানুষের জন্য- এই নীতি প্রয়োগের উৎকৃষ্ট সময় এখন।
নিচু অঞ্চল হিসেবে পরিচিত আমাদের সুনামগঞ্জ মূলত হাওরাঞ্চল। এখানকার বেশিরভাগ মানুষের জীবিকার মূল উপজীব্য হচ্ছে কৃষিকাজ ও হাওরে মাছ ধরা। গত বোরো ধান তোলার সময়ে আকস্মিক আগাম বন্যায় প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে বোরো ধানের উৎপাদন। এখন আবারো বন্যা দেখা দেয়ায় বিকল্প কর্মসংস্থানের মাধ্যম মাছ ধরাও বন্ধ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে জেলার কয়েকটি উপজেলাকে দুর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেয়া এখনই দরকার। মনে হচ্ছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুন্দরের অপার লীলাভূমি হাওরের জন্যই লিখে গেছেন,
‘সুন্দর, তুমি চক্ষু ভরিয়া এনেছো অশ্রুজল
এনেছো তোমার বক্ষে ধরিয় দুঃসহ হোমানল’।
(লেখক- গবেষক ও কবি)