হাওরে সংকট কাটছে না ফসলহারা কৃষকের: হুমকির মুখে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ
দিরাই ও শাল্লায় হাওর দুর্যোগে সংকট কাটছে না ফসলহারা কৃষকের। দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকার কর্তৃক বিশেষ খাদ্যসহায়তা ভিজিএফ, ফেয়ার প্রাইজ, ভিজিডিসহ বিভিন্ন সহায়তা প্রদান ছাড়াও বিভিন্ন এনজিও এবং সামাজিক উন্নয়ন সংঘটনের ব্যানারে খাদ্য সহায়তা প্রদান করলেও সংকট নিরসনে আশানুরূপ ভুমিকা রাখতে পারছে না। এবছর দিরাই ও শাল্লা উপজেলার ২৭ টি হাওরের শতভাগ ফসল অকাল বন্যায় তলিয়ে যাওয়ায় হাওরের ৬০ হাজার পরিবার শুধু খাদ্য সংকটে নয়, হাওর জনপদে শিক্ষা,স্বাস্থ্যসহ মৌলিক চাহিদার চরম সংকট দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে হাওর পাড়ের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ হুমকির মধ্যে পড়তে পারে।
স্থানীয়রা জানান- সরকারের বিভিন্ন সহায়তা প্রাপ্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কিছুটা ঘুরে দাড়াতে পারলেও বরাদ্দ অপ্রতুলতার কারণে শতভাগ সংকট নিরসন হচ্ছে না। কৃষির উপর নির্ভরশীল হাওর জনপদের লোকজন শতভাগ ফসল হারিয়ে, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা সংকটে ভোগছেন। কর্মসংস্থান না থাকায় এ সংকট ক্রমেই বাড়ছে। কাজের সন্ধানে এলাকা ছাড়া হচ্ছেন অনেকেই। হাওরে তলিয়ে যাওয়া পচা ধানেই বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন ফসলহারা কৃষক। রাত পোহালেই ধান তুলার প্রতিযোগীতায় হাওরে নৌকা ভাসান কৃষকরা। হাওরের গভীরে যেখানে পাকা ও আধপাকা ধান তলিয়ে গেছে, সেখানেই ডুবুরি হয়ে পচা ধান, কেউবা বাঁশের তৈরী নিড়ানি (আচড়া) দিয়ে পঁচা ধান নৌকায় তুলছেন। ধানের গুনগতমান না থাকলেও ক্ষুধার জ্বালায় শালুক না খেয়ে শালুকের মতই পঁচা ধানের খোঁজে প্রতিদিন দিরাই-শাল্লার হাওরে নৌকা নিয়ে ছুটছেন। দিরাই উপজেলার রফিনগর, রাজানগর ও চরনারচর ইউনিয়ন এবং শাল্লার আট গাঁও ইউনিয়নসহ দুই উপজেলার চার ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের খাদ্যভান্ডার খ্যাত কালিয়াকোটা হাওর অকালে তলিয়ে যায়। ফসল হারা নি:স্ব কৃষকরা হাওরের বুকে প্রতিদিন শত শত ছোট নৌকা নিয়ে যার যার মত করে পঁচা ধান তুলতে দেখা যায়। এমন চিত্র দ্বিতীয় খাদ্য ভান্ডার খ্যাত ভরাম হাওরসহ ২৭টি হাওরে।
পুরুত্তা (ছেলে-মেয়েরা) ঘুম থাইক্কা উইট্টাই(উঠে) খাওন চায়, খাতা কলমের খরচই দিতা পাররাম না, স্কুলেই কিলাখান পড়তো, মাথায় ধরে না, শ দুইশমন ধান পাইলামনে, সবই শেষ, দশ দিন ধরে হাওরে যাই, কষ্ট করতে করতে শইল্ল্য ধরি লাইছে, দেখি কষ্ট কইরাও ৩/৪মাসের খাওননি জোগাড় করা যায়, মেয়র সাবে কিছু চাল দিছইন, পরিবারে ৬ জন খাওরা, দেইরা খরছতো আছেই-বাচ্চার মারও শইল্য অসুখ, পঁচা ন্যাড়া থাইকা যে ধান লয়রাম, তা যদি উনা দেয়া যাইতো (সিদ্ধ করা যেতো) তাইলে কিছু চাউল পাইতাম, উনা না দেয়ায় দশ ভাগের একভাগ চালও অয় না। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ভরাম হাওর পাড়ের ফসলহারা কৃষক আক্তারুজ্জামান। তিনি এবার অন্যের জমি বর্গা নিয়ে বরাম হাওরে সাড়ে নয় কেদার জমি করছিলেন, এতে ১ লাখ টাকা তার খরচ হয়। গত ১০ দিনে বরাম হাওরে ছোট নৌকা দিয়ে তলিয়ে যাওয়া ধান ডুব দিয়ে তুলে আনছেন বাড়িতে। ন্যাড়া পঁচে যাওয়ায় ধান তুলতে বেশ খাটুনী খাটতে হচ্ছে তাকে। রোদে শুকিয়ে অভিনব কৌশলে ন্যাড়া থেকে ধান আলাদা করছেন। তিনি জানান, বিগত ১০ দিনে ৪/৫মন ধান তুলেছেন কৃষক কামরুজ্জামান।
ভাটিবাংলা যুবসমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক প্রশান্ত সাগর দাস বলেন, হাওরের ধান ও মাছ হারিয়ে হাওর জনপদে শুধু খাদ্যসংকট নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক চাহিদার চরম সংকট দেখা দিতে পারে। শুধু খাদ্য সহায়তা নয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সহায়তার ব্যাপারে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। হাওর দুর্যোগে শিক্ষা সহায়তা না পেলে হাওর পাড়ের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে।
সরকারের খাদ্যসহায়তার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক রোটারিয়ান রাতুল চৌধুরী বলেন, শুধু খাদ্য সংকট নয়, বহুমুখী সংকটে হওরপারে চলছে হাহাকার, এ সংকটে পড়ে এবার অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী জীবীকার তাগিদে পিতা-মাতার সাথে কাজের সহযোগী হিসেবে এলাকা ছাড়ছে । শিক্ষা সহায়তা না পেলে হাওরপাড়ের স্কুল কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়বে আশংকা জনক হারে।
এদিকে শনিবার উপজেলা গণমিলনায়তন হলে ঢাকাস্থ দিরাই উন্নয়ন ফোরাম কর্তৃক অয়োজিত উন্নয়ন ফোরামের সহ সভাপতি সুজাত আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং সহিদুর রহমান টিটিুর সঞ্চালনে ক্ষতিগ্রস্থ ফসলহারা কৃষকদের মধ্যে ত্রান বিতরনকালে স্থানীয় সাংসদ ড. জয়া সেনগুপ্তা বলেন, হাওরপাড়ের মহাদুর্যোগে আমরা মর্মাহত, এ দুর্যোগ উত্তোরনে সরকার বিভিন্ন সহায়তা প্রকল্প গ্রহন করেছে, উপজেলায় ১৬ হাজার ৩শ জনকে ৩৮ কেজি করে চাল ও নগদ ৫০০টাকা করে দেয়া হয়েছে, খাদ্যবান্ধব কর্মসুচির আওতায় ফেয়ার প্রাইজ ৯ হাজার, ভিজিডি ৮ হাজারসহ মোট ৩৫ হাজার পরিবারকে বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করছে, দুর্যোগ মোকাবেলায় সবসময় পাশে থাকবো উল্লেখ করে তিনি বলেন, ত্রান বিতরনে সুসম বন্ঠন নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয়া আছে, এতে কোন ধরনের অনিয়ম মেনে নেয়া যাবে না। দিরাই উন্নয়ন ফোরামের ত্রান সহায়তার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে জয়া সেন বলেন, এ দুর্যোগে প্রবাসীসহ বিত্তবানদেরকে সহযোগীতায় এগিয়ে আসার আহবান জানান। ৭টি ইউনিয়নের ১১শ জনের মধ্যে ১০ কেজি করে চাল প্রদান কওে দিরাই উন্নয়ন ফোরাম।