হাওর এলাকার বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে
সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার হাওর অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। ইতোমধ্যে একমাত্র ফসল বোরো ধানের ৫০ শতাংশেরও বেশী নষ্ট হয়েছে। এরপর গত কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ ও সীমান্তের ওপার থেকে আসা ঢলে আরো এলাকা পানির নিচে চলে গেছে। বোরো ধানের অংশ বিশেষ এখনো যতটা টিকে আছে, পানির ওপরে আছে, কতদিন সে অবস্থায় থাকবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পানি বাড়লে এই ধানও আর ঘরে উঠবে না। তখন চাষিদের সম্পূর্ণ নিঃস্ব ও নিরালম্ব হয়ে পড়তে হবে। ধান হারানোর বিপদের সঙ্গে নতুন বিপদও দেখা দিয়েছে। হাওরকে বলা হয় ধানের খনি, মাছের খনি। ধান বেশিরভাগই গেছে, মাছও যেতে বসেছে। মাছে ব্যাপক মড়ক দেখা দিয়েছে। মাছ মরে ভেসে উঠছে পানির ওপর। ধানের পর মাছই হাওর এলাকার মানুষের অর্থের প্রধান উৎস। মাছ শেষ হয়ে গেলে এই অবলম্বনও আর থাকবে না। শুধু মাছই বা কেন, হাঁস ও পাখি পর্যন্ত মরে সাফ হয়ে যাচ্ছে। তা হলে আর কি থাকলো হাওর এলাকার মানুষের জন্য? তারা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় রীতিমত দিশাহারা। মাছ, হাঁস ও পাখ-পাখালির এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর কারণ কি, তা বুঝা যাচ্ছে না। অনেকের ধারণা, উঠতি ধান পানিতে ডুবে-পচে পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। এ জন্যই হাঁস ও পাখি মরে যাচ্ছে। ভিন্ন একটি আশংকার কথাও বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, পার্শ্ববর্তী ভারতের মেঘালয় রাজ্যে অবস্থিত উন্মুক্ত ইউরেনিয়াম খনির তেজস্ক্রিয় পদার্থ পানির সঙ্গে মিশে হাওরগুলোতে প্রবেশ করার কারণেই মাছ, হাঁস বা পাখি মরে যাচ্ছে। আশংকার এই দিকটি এখনো খতিয়ে দেখা হয়নি।
কারণ যদি এটাই হয়, বাংলাদেশের ওই এলাকায় তা ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওরের মতো বৃহৎ হাওরের সঙ্গে ছোট-বড় অসংখ্য হাওরের পানি দূষিত ও ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে মাছসহ কোনো জলজ প্রাণীই আর বাঁচতে পারবে না। গোটা এলাকায় একটা অভাবিত পরিবেশগত মহাবিপর্যয় ঘটে যাবে। কাজেই, এখনই হাওরের পানি দূষিত হওয়া এবং মাছ, হাঁস ও পাখির মড়কের কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিকারের পদক্ষেপ নিতে হবে। বিলম্ব হলে ক্ষতির মাত্রা ও পরিধি বাড়বে। এ কথা কারো অজানা নেই, আকস্মিক টানা ভারী বর্ষণ ও সীমান্তের ওপার থেকে আসা পাহাড়ী ঢল হাওর এলাকার এই আগাম বন্যা, ফসলহানি ও বিপর্যয়ের কারণ। খবরাখবরে এও জানা গেছে, রক্ষাবাঁধ বা বেড়িবাঁধগুলো উঁচু ও টেকসই হলে হাওরগুলোতে এভাবে পানি ঢুকে ফসল ডুবিয়ে দিতে পারতো না। বাঁধ যে ঠিক মত বানানো হয়নি, পর্যাপ্ত বরাদ্দের পরও বাঁধগুলোর সংস্কার ও মেরামত যে হয়নি, সে কথাও উঠে এসেছে। হাওর এলাকাবাসীদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও অভিযোগ সাক্ষ্য দিচ্ছে, বরাদ্দের অর্থ তিন নাই তিন ছাই হয়ে গেছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। এ বিষয়টিও সরকারকে আমলে নিয়ে তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এরকম অবহেলা, উপেক্ষা অর্থ লোপাটের ঘটনা না ঘটে সেটাও দেখতে হবে।
লাখ লাখ চাষি ফসল হারিয়ে এখন নিঃস্ব। পানির সয়লাবে তাদের সকল আশা ও ভবিষ্যৎ ভেসে গেছে। হাওরের বিপুল মৎস্য সম্পদ ও হাঁস এই নিদানকালে তাদের খুবই কাজে আসতে পারতো। সে আশারও গুড়ে বালি পড়েছে। এমতাবস্থায়, তাদের কি হবে, কিভাবে তাদের দিন কাটবে, সংসার যাত্রা নির্বাহ হবে, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। ইতোমধ্যে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। আগামী চৈত্র ছাড়া ফসল পাওয়ার সুযোগ নেই। এই সময় পর্যন্ত তাদের খাদ্যসহ সকল প্রয়োজনীয় উপকরণ যোগান দিতে হবে। দাবি উঠেছে, হাওর এলাকাকে উপদ্রæত অঞ্চল ঘোষণা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার। পরিস্থিতি যা, তাতে এটাই করতে হবে। সরকারের তরফে কিছু ত্রাণ-সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে যা প্রয়োজনের তুলানায় মোটেই যথেষ্ট নয়। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী দেয়ার পাশাপাশি কম দামে খাদ্য ও অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। চাষিরা ব্যাংক ও মহাজনী ঋণ নিয়ে ফসল আবাদে বিনিয়োগ করছিল। এখন এই ঋণের কি হবে, সেটাও দেখতে হবে। এই সঙ্গে আগামীতে আবাদঘাটের জন্য যে অর্থ ও উপকরণের প্রয়োজন হবে তার আয়োজন ও বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করতে হবে। হাওর এলাকার মানুষ কার্যতই এখন বিপন্ন। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সরকারকে যেমন সকল প্রকার সহায়তা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে তেমনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, সেবা সংস্থাকেও দুর্গত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। এখানে গড়িমসি করার যেমন অবকাশ নেই, তেমনি রাজনৈতিক ব্লেম গেমেরও কোনো সুযোগ নেই। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ইতোমধ্যে ব্লেম গেম শুরু হয়ে গেছে। এই ব্লেম গেম অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিপন্ন ও নি:সহায় মানুষকে সর্বোতভাবে সহায়তা করাই এখন প্রধান জাতীয় কর্তব্য।