:: মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন :: কুশিয়ারা নদীর কুল উপচে পানি পড়ছে। মায়াবী নদীর রাক্ষসী রূপ দেখে ভয়ে গা ছমছম করে। নদীর শ্বেত-শুভ্র কমনীয় বুক মারণ-নেশায় উন্মাতাল। নদী এখন ডুবাতে বসেছে সব। দুই পাড়ের নিরীহ-নিস্তরঙ্গ বসতিরে ভাসিয়ে নিতে চাইছে। এই রূপের দিকে সম্মোহিত চোখে তাকাই আবার তাকাই না। হাওরের পেট ভরে এসে শেষে বসতিরে ডুবানোর পণ করেছে যেন। নদী যেন আপন খেয়ালে বিষ ঢেলে যায় বিস্তীর্ণ জনপদে। নদী এত ভয়ংকর হয় কেমন করে? নদীর সাথে মানুষের কিসের শত্রুতা? পরিশ্রম করে পেটে ভাত জোগাড়ের দায় যাদের, এমন দিনে তাদের মাথায় হাত। দুরু দুরু কাঁপে বুক আসন্ন অভাবের অশনিতে। ঘরের ভিতর পানি ঢুকে গেলে মানুষ ঘুমাবে কই, নদী কি তা জানে? শুধু নদীর কথা বলছি কেন, সারাদেশ যেন মহাপ্লাবনের মুখে। সারা গ্রীষ্মকাল ধরে বিরামহীন তাপদাহের পর বর্ষা ঋতুর টানা বর্ষণ, শরীর জুড়ালেও মনে ধরিয়ে দিচ্ছে দুঃসহ ভয়। এ ভয় আগাম সংকটের, এ ভয় আগামী দুর্যোগের। প্রাকৃতিক দুর্যোগে অভ্যস্ত বাংলার জনপদ কি আরো একটি দুর্যোগের মুখে পড়তে যাচ্ছে? সিলেটের নদীগুলো পানি ধরে রাখতে পারছে না। বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের বিপুল জল এসে সুরমা-কুশিয়ারা, পিয়াইন-লোভাছড়াকে টইটম্বুর করে দিয়েছে। স্ফীতোদর নদীর শরীর ক্রমেই ঢুকে যাচ্ছে লোকালয়ে। বিপর্যস্ত হতে শুরু করেছে জনজীবন। বিঘ্নিত হতে শুরু করেছে প্রাত্যহিক যোগাযোগ। কাঁচামাল, মুদিমাল সংকটের ধ্বনি বাঁজাচ্ছে। রুটি-রুজির উপর আসন্ন কুপ্রভাব বিপর্যয়ের বার্তা হয়ে বাঁজছে গণ-মানুষের বুকে।

বন্যায় যাদের রুজির সমস্যা নেই, তাদের সুখ দেখার মতো। বিশেষত শিশু-কিশোর-তরুণদের। সাঁতার কেটে, নৌকায় ভেসে, তীরে দাড়িয়ে ভরা বিল-বাওড়-নদী-হাওর আর পুকুর-নালার অপরিসীম রূপ-সাগর চোখের দৃষ্টিতে গেঁথে রাখে সারাক্ষণ। দিন ও রাতের প্রতিটি মুহূর্ত অপূর্ব চমকে-শিহরণে কাটে। দূর বিলের শোঁ-শোঁ আওয়াজ স্বপ্ন-জগতের বার্তা নিয়ে আসে। অথৈ জলে ভেসে চলা হাস-মরালের মনোহর সাঁতার চোখে নেশা লাগায়। রাতের পূর্ণিমায় স্ফটিকের মতো জলছবি চোখে সুদৃশ্যের জোয়ার আনে। জলের ওপারে বসতির দৃশ্য কল্পলোকের মতো মনে হয়। কি আছে ওখানে? ঐ বসতির ভেতর? বাতাসের দুলুনিতে টিপটিপে ঢেউ একের সাথে লাগে অপরে। টপটপ নায়ের আঘাতে ফেটে যায় ঢেউ। ভেসে চলে দল-ঘাস,ভেসে চলে কচুরিপানা। চপলা-চঞ্চল জলের শ্রী অঙ্গে অস্থিরতার বাণ। দুরন্ত শাপলার অলৌকিক দাড়িয়ে থাকা দেখে ঘোর লাগে চোখে। বাতাসে ভেসে গানের যে সুর আসে, না জানি সেসব কার কথা বলছে।

এবার আমরা বাংলাদেশের বন্যা নিয়ে প্রচলিত ইতিহাসে একটু চোখ বুলিয়ে নিইঃ
বাংলাদেশের ইতিহাস মানে বন্যারও ইতিহাস। প্রতি শতাব্দীতে বঙ্গীয় বদ্বীপ প্রায় অর্ধডজন বন্যার মুখে পড়েছে, ব্যাপকতায় যা ১৯৮৮ সালের প্রলয়ংকরী বন্যার প্রায় সমান। বাংলাদেশের এই মৌসুমি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা মহাভারত, রামায়ণ প্রভৃতি গ্রন্থে উল্লিখিত আছে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনামলে তাঁর অর্থমন্ত্রী কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্রে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যান উল্লেখ রয়েছে। জ্যোতির্বিদ বরাহ-মিহির বৃষ্টির পূর্বাভাস দিতে পারতেন। জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট ও ব্রহ্মগুপ্তও বর্ষা মৌসুম নিয়ে গবেষণা করেছেন। বিখ্যাত সংস্কৃত কবি কালিদাস রচিত বর্ষার বিরহাভিসার মেঘদূত এবং ঋতুসংহার কাব্য বিশ্ববিশ্রুত ধ্রপদী-মহাকাব্য। জ্যোতির্বিদ বরাহর পুত্র মিহিরের বধু লীলাবতী বাংলার বন্যা ও খরা নিয়ে মোক্ষম কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, ইতিহাসে যিনি খনা নামে পরিচিত। আরবরা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করতে জাহাজ চালাতে গিয়ে ঋতুর সঙ্গে মৌসুমি বায়ুর পরিবর্তন জনিত জ্ঞানকে লাভজনকভাবে কাজে লাগিয়েছে। বাংলায় ১৮৭০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত সংঘটিত বন্যার ওপর অধ্যাপক পিসি মহলানবীশ প্রণীত সর্বপ্রথম বিস্তারিত রিপোর্টটিতে দেখানো হয়েছে যে, মাঝারি আকারের বন্যা গড়ে প্রতি দুই বছরে একবার এবং ভয়াবহ বন্যা গড়ে ৬/৭ বছরে একবার সংঘটিত হয়েছে।

বর্তমান বাংলাদেশে বেশিরভাগ অঞ্চল বিভিন্ন প্রকার বাধ, রাস্তা-ঘাট নির্মিত হবার কারনে বন্যার হঠাৎ আক্রমণ থেকে মুক্ত। দীর্ঘমেয়াদি বন্যা হলে ধীরে ধীরে পানি ঢুকে প্লাবিত করার সুযোগ পায়। তবে প্রধান নদীগুলোর প্রবেশমুখে বিশেষত উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ বন্যা দেখা দেয় প্রায়ই। সিলেট, সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ইত্যাদি জেলাগুলোতে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানি এসে নদী তীরবর্তী জনপদ প্লাবিত করে ফেলে। নদীর ধারনক্ষমতার অধিক পানি প্রবাহের ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকে। পরে ধীরে ধীরে পানি সরে গেলে অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু বৈশ্বিক আবহাওয়ার প্রভাবে বন্যার কারন দেখা দিলে সারাদেশ প্লাবিত হয়। সেক্ষেত্রে সবগুলো নদী দিয়ে প্রবাহিত পানি সাগরে নির্গত হতে দীর্ঘ সময় লাগে বলে মধ্যভাগও প্লাবিত হয়ে যায়। এ ধরনের প্লাবিত অবস্থা এক থেকে দুই মাস স্থায়ী হতে পারে। তখন এ দেশে মহাদুর্যোগের পরিস্থিতি তৈরি হয়। জনদুর্ভোগ চরমে ওঠে। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অবকাঠামো ও উন্নয়ন।

অতি বন্যার উৎস সন্ধানে গবেষণার কোনো অন্ত নেই। প্রকৃতির উপর মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপ ছাড়াও রয়েছে কিছু প্রাকৃতিক কারনও। বলা হয়ে থাকে, মোটামুটি দশ বছর পরপর খরা ও বন্যা পর্যায়ক্রমে দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ একটি বড় বন্যার প্রায় দশ বছর পর আরেকটি বড় বন্যার সম্ভাবনা আসে। খরা ও বন্যার মাঝখানে এক-দুই বছর ব্যবধান থাকতে পারে, কখনো কখনো একই বছরে ঘটে থাকে। এই চক্রটি ইতিহাস ঘাটলে সহজেই বুঝতে পারি আমরা। উনিশশো আটাশির পর উনিশশো আটানব্বই, অতপর দুহাজার সাত, তারপর দুহাজার সতের সালের ভয়াবহ বন্যা। এই চক্রের পেছনে যে দুটি বৈশ্বিক প্রভাব কাজ করে বলে জানা যায় তাহলো এল-নিনা ও লা-নিনো।
 
বিশ শতকের শেষের দিকে এল-নিনা ও লা-নিনো নামক গুরত্বপূর্ণ প্রপঞ্চ দুটির উদ্ভব ঘটে। স্পেনিশ ভাষায় যার অর্থ যথাক্রমে ছোট বালক ও ছোট বালিকা। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু ও ইকুয়েডরের জেলেরা ভিন্নধর্মী দুটি সমুদ্র স্রোতের ফলে সৃষ্ট অবস্থাকে এরূপ নাম দিয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরে কয়েক বছর পরপর হঠাৎ উষ্ণস্রোতের আবির্ভাব ঘটে। একে এল-নিনো বলে। এল-নিনোয় ক্ষরা হয় এবং পানির অভাব হয়। লা-নিনোয় হয় ঠিক তার উল্টো। এর মানে হচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রচুর পরিমানে বৃষ্টি হবে। দীর্ঘ ক্ষরার পর তা ভালো লক্ষন মনে হলেও লম্বা ক্ষরার পর হঠাৎ পৃথিবী বেশী পানির চাপ সহ্য করতে পারে না। শুরু হয় বন্যা ও মাটি ভাঙ্গন।

এল-নিনা ও লা-নিনোর সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যাটি হলো, শীত-গ্রীষ্মকাল সংক্রান্ত। আমাদের দেশে শীতকাল ও গ্রীষ্মকাল দুটি বিপরীত তাপমাত্রার ঋতু। তেমনি প্রশান্ত মহাসাগরেরও রয়েছে শীতকাল এবং গ্রীষ্মকাল। প্রশান্ত মহাসাগরের গ্রীষ্মকালকে বলে এল-নিনো আর শীতকালকে বলে লা-নিনো। আমাদের দেশের ঋতুকালের প্রভাব শুধু দক্ষিন এশিয়া ব্যাপী বিরাজ করে। অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগর পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ জুড়ে রয়েছে। তাই প্রশান্ত মহাসাগরে কিছু ঘটলে পুরো পৃথিবী জুড়ে তার প্রভাব পড়ে। প্রশান্ত মহাসাগরের গ্রীষ্মকাল পুরো পৃথিবীকে গরম করে দেয় এবং একইভাবে তার শীতকাল পুরো পৃথিবীকে ঠাণ্ডা করে দেয়। আবার দেখা গেলো, প্রশান্ত মহাসাগরের শীতকালের সময় হয়ত বাংলাদেশে গ্রীষ্মকাল। তখন ঐ গ্রীষ্মকাল আমাদের জন্য অস্বাভাবিক হয়ে দেখা দেয়। হয়ত ঝড়, শিলাবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি দুর্যোগ হবে। গ্রীষ্ম শীত যেমন পর্যায়ক্রমে আসে, এল-নিনো এবং লা-নিনোও পর্যায়ক্রমে আসতে থাকে প্রশান্ত মহাসাগরে। এই পর্যন্ত ব্যাপারটিকে স্বাভাবিকই মনে হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরপর এরা অনেক শক্তি সঞ্চার করে। সেই বছরগুলোয় বিরূপ প্রভাব পড়ে সারা পৃথিবীর আবহাওয়ায়। এই পরিস্থিতি সাধারনত সাত থেকে দশ বছর পরপর আসে। আজকের পৃথিবীতে বছর সুনির্দিষ্ট করে এল-নিনা ও লা-নিনোর পূর্বাভাস দেয়া যাচ্ছে। তাই বহু ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে পৃথিবী।

প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণ-শীতল স্রোত জনিত চরম প্রভাবের কোনো পূর্বাভাস এ বছর নেই। বড় আকারের বন্যারও কোনো পূর্বাভাস তাই এ বছর নেই। তবে হঠাৎ প্রচুর বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলের প্রভাবে উত্তর ও উত্তর-পূর্বের নদীগুলোতে বিপুল পানির প্রবাহ হলে আকস্মিক বন্যা দেখা দিতে পারে। ইতিমধ্যে তেমন বন্যা দেখাও দিয়েছে। সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে এই অবস্থার উন্নতি হবে না সহজে। আরো কিছুদিন ভাসিয়ে নিয়ে চলবে। তারপর পানি নেমে দেশের মধ্যাঞ্চল দিয়ে নির্গত হতে হতে বর্ষা মৌসুমটি পার হতে থাকবে। স্বাভাবিক মাত্রার বন্যা দিয়ে যথারীতি শেষ হবে বছরটি। আবহাওয়ার দেশীয় এবং বৈশ্বিক গতি-প্রকৃতি আমাদের তেমনটাই ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। বৃষ্টি ও ঢলের পানি মাত্রা ছাড়ালে অবশ্য ভোগান্তির মাত্রাও বেড়ে চলবে। বন্যার বিপর্যয়ে আমাদের মতো দেশের ক্ষয়ক্ষতি হয় অপূরণীয়। অর্থনীতি আর জন-স্বাস্থ্য বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেখা দেয় মানবিক বিপর্যয়। এমনতর ক্ষতি থেকে বাঁচতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে বন্যা-ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তোলা জরুরী।

আমাদের দেশের বন্যা ব্যবস্থাপনার অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে এখনো। যত্রতত্র খাল-বিল ভরাট হবার কারনে নদীর পানির স্বাভাবিক নির্গমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মধ্যাঞ্চলের বিল আর কৃষিজমিতে বন্যার পানি প্রবেশ করতে পারে না। বন্যার পানি প্রবেশ করতে না পারলে কৃষিজমিতে পলি পড়তে পারে না। পলি, জমির মাটিকে উর্বর করে। পলির অভাবে জমিতে ফসল উৎপাদনের জন্য অতিমাত্রায় রাসায়নিক সারের উপর নির্ভর করতে হয়।

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বর্ষার সৌন্দর্য অপরূপ। বৃষ্টির সময়টা থাকে উপভোগের উপলক্ষ্য হয়ে। আবহমান বাংলার আঁকা-বাকা পথ সমান পানির উপর দিয়ে সোজা রাস্তায় পরিণত হয়। তাই বর্ষাকালে নাইওর যাবার হিড়িক পড়ে যেতো। কদমের ফুল বাহারি দৃশ্য সাজায়। ক্ষেত-খামারে কাজ থাকে না বলে অখন্ড অবসরে মানুষ কিচ্চা-গল্প-গান ও অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে। নৌকা বাইচের মতো লোকজ উৎসবের জন্ম হয়েছে। আখ, পাট আর ঝোঁপ সদৃশ ধইঞ্চার ক্ষেত জলের মাঝে ঠায় দাড়িয়ে থাকে। পাট কাটা হয়ে পঁচনের কবলে পড়ে। চৌদিকে ভুরভুর করে ছড়ায় পঁচা পাটের গন্ধ। আখের রসে মুখে তৃপ্তি আসে। হাওর-বিলে এক পায়ে দাড়ানো হিজলের নিঃসঙ্গ উপস্থিতি। ভাসমান কচুরি, দলঘাস, শাপলার উপস্থিতি জলের উপর সজীব-সুন্দর দৃশ্যের অবতারনা করে। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ ‘একদিন জলসিড়ি কবিতায় বর্ষার রূপ এঁকেছেন এইভাবে–

“বাংলার শ্রাবনের বিস্মিত আকাশ
চেয়ে রবে; ভিজে পেচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে
শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প-ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে;”

ঘরের গোলায় পর্যাপ্ত শষ্য আছে যাদের কিংবা গাঁটে আছে নিশ্চিত পয়সার রমরমা, তাদের মেজাজ ফুরফুরে থাকে সারা বর্ষাকাল। দিন আনে দিন খায় শ্রমিক-কৃষকের নিদারুন কষ্টে কাটে সময়। বর্ষা তাদের জীবনে অভিশাপ হয়ে আসে। পানি সরে নতুন ফসলের দিন আসলে তবে মুক্তি মিলে তাদের। বৈষম্যের সমাজে এই গল্প চিরাচরিত। মানুষ মানুষের জন্য, কথাটি যেন বইয়ের পাতায় বন্দী। তবুও ত্রাণ আসে, দুর্যোগ খুব তীব্র হলে। বন্যার্তদের সহায়তার হুজুগে নানান রকম ধান্দাও জমে উঠতে দেখা যায়। পরোপকারে নেশা যাদের, ঝাপিয়ে পড়ে তারা। মানুষের পাশে দাড়ানোর মানুষ দেশে তখন বহু সংখ্যায় দেখতে পাওয়া যায়।

ভারতের আসামে বন্যা হলে বাংলাদেশে তার সরাসরি প্রভাব পড়ে। চীনে বন্যা হলেও প্রভাব পড়ে। আন্তর্জাতিক নদীগুলোর মাধ্যমে ঐ দেশগুলোর বন্যার পানি এদেশে প্রবেশ করে। বন্যা দেশকে ভাসিয়ে দিয়ে বিধৌত-বিশুদ্ধ করে। পরিমিত বন্যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। অতি বন্যায় ক্ষতি হয়, বিপর্যস্ত হয় জনজীবন। হাওর এলাকা বাদ দিলে বাংলাদেশের অন্যত্র প্রতি বছরের স্বাভাবিক বন্যাটিও আর নেই। এটাও এক প্রকার বিপর্যয়। একটা সময় ছিলো, জ্যৈষ্ঠ মাস শেষ হবার আগেই জোয়ারের পানিতে দেশের মধ্যাঞ্চলের বিলগুলো ভরে যেতে শুরু করতো। নদীর পানি খাল-নালা ও নিচু মাঠ দিয়ে ছুটতো। খাল উপচে পানি গ্রামদেশের বসতবাড়ির ফাঁক-ফোকর দিয়ে হুড়মুড় করে প্রবাহিত হতে থাকতো। বিল ভরার আগেই বাড়ির পাশ দিয়ে ছোট নৌকা স্রোত ডিঙিয়ে চলার পথ তেরি হয়ে যেতো। বিলের সাথে কৃষক-গৃহস্থের জীবন্ত সম্পর্কটি অবিকৃত থাকতো। শুষ্ক মৌসুমেও যেমন বিলে যাওয়া যায়, বর্ষা মৌসুমেও যাওয়া যায়। বিলের সাথে কৃষকের বিচ্ছেদ ছিলো না কোনোকালে। নতুন পানি আসার সাথে সাথেই মাছ ধরার জন্য কিছু মানুষ ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে খাল-বিলে ছুটতে শুরু করতো। সারা বর্ষা মৌসুমটা এদের মাছ ধরেই পয়সা রোজগার চলতো। এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম, বাড়ি থেকে দূরের বড় বাজার, এমনকি সারা বছরে যাবার সময় হয় নি যেসব আত্মীয়ের বাড়ি, পানির সোজা পথে সেসব জায়গায় যাবার পথ সহজ হতো।

আজ এসবের কোনোটিই আর দেখতে পাওয়া যায় না। ঘনঘন রাস্তার ভাঁজে আটকা পড়েছে সেসব পথ। যুগ যুগ ধরে প্রবাহিত খালের উপর সেতু না বানিয়ে মাটি ভরে রাস্তা টেনে নেয়া হয়েছে অজস্র জায়গায়। এটি পরিবেশ ও কৃষির প্রতি প্রকট উদাসীনতার নমুনা। নদীর পানি আগের মত বিলের সাথে মিতালী করার সুযোগ পায় না। আষাঢ় মাস পেরিয়ে গেলেও পানি ঢোকে না বিলে। অবস্থা এখন এমনই। বন্যার চিরাচরিত রূপ আর নেই। গ্রামবাংলার চিরদৃশ্যমান স্বাভাবিক বর্ষাকাল ইতিহাসের বিষয় হতে চলেছে। বিলের ভেতর থৈ-থৈ পানির একদা নিত্য দৃশ্যটি এখন দেখতে পাবার অর্থ হলো, সারাদেশে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে গেছে। অথচ জলের ঋতু বর্ষাকাল জলে টইটম্বুর করে রাখার কথা সারা বাংলা। বিলের দেশে শাপলার আকারও ছোট হয়ে গেছে। শাপলা পানির মাপে বাড়ে কিনা। পানি অল্প তাই শাপলাও বাড়ে অল্প। মাছের আকাল, পাট পঁচানোর জলেরও আকাল। বদ্ধ জলে পাট পঁচে দূষিত করছে পরিবেশ। বৃষ্টিতে পথ-ঘাট কাঁদা হয়ে থাকে। চলাচলে ভীষন কষ্ট। ইটের-পিচের পথ ছাড়া চলাচল একরকম অসম্ভব। সহজেই ডিঙ্গি করে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি ছুটে যাবার সুযোগটি এখন আর মেলে না। কাঁদা মেখে, পা টেনে টেনে চলতে হয়।

বন্যার কথা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনার কথাও এসে যায়। আমাদের নদী ব্যবস্থাপনার কোথায় যেন মারাত্মক ত্রুটি রয়ে গেছে। বিভিন্ন শহর, বাজার ভাঙনের মুখে পড়লে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে দেখি না। এটি যন্ত্রপাতি এবং জনবল সংকটের কারনে হতে পারে। কখনো কখনো গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হতে থাকে নদীতে। এরও কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিকার নেই। সর্বস্ব খোয়ানো মানুষের হাহাকার ভেসে ভেড়ায় আকাশে বাতাসে। এক একটা বর্ষা মৌসুম আসে যেন নদীর পাড়ের মানুষের জীবনকে তছনছ করে দিতে। অপরিকল্পিত বন্যা-নিয়ন্ত্রণ বাধ ও অবকাঠামো গড়ে তোলার কারনে নদীগুলো বিস্তৃত প্লাবন ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নদীর পানি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ ক্রমশই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এতে বিরাট অংশের কৃষি জমি পলি থেকে বঞ্চিত থাকছে। হাওর অঞ্চলগুলো বাদে দেশের বাকি প্রায় সকল এলাকাই আজ বন্যা-নিয়ন্ত্রণ বাধ ও বিভিন্ন অবকাঠামো দ্বারা বন্যা প্রবণতা মুক্ত। এটি জীববৈচিত্র এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য হিতকর নয়। নদী এবং বন্যা ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাই পারে এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে।

আজ হাওর এলাকার বন্যার আকস্মিক ভয়াবহতা দেখে বন্যা প্রবণতা মুক্ত অঞ্চলের মানুষ হয়তো বিস্ময়াভিভূত হবে। কিন্তু এই সেদিনও বন্যার বিস্তার সারাদেশব্যপী দেখতে পাওয়া মানুষেরা এখনো জীবিত। হঠাৎ এই পরিবর্তনের হেতু অনেকেই বুঝতে পারেন না। কিংবা বুঝেও, থাকেন না-বোঝার ভাণ করে। বর্ষা বাংলার অনন্য ঋতু। পৃথিবীতে প্রকৃতির কবি আছে সব দেশে, বর্ষার কবি আছে শুধু বাংলায়। বাংলা মুলুকের মতো এমন বর্ষা ঋতু আর কোনো দেশে নেই বলে বর্ষার কবিও জন্মে না। বর্ষাঋতু বাংলার স্বতন্ত্র পরিচয়কে তুলে ধরে। এই ঋতু এখানকার প্রতিটি মানুষকে আপ্লুত করে, আবেগী করে তোলে। ঘুরে-ফিরে বাংলার সব কবিই কবিতায় বর্ষাকালকে প্রসঙ্গ করেছেন। বর্ষা নিয়ে পল্লী-কবি জসীম উদ্দীনের কালজয়ী কবিতাটি হলো ‘পল্লীবর্ষা’। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে বর্ষা এসেছে প্রেম-প্লাবনের মৌসুম হয়ে। জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের কবিতাগুলোতে জল-আবেগের পদগুলো বাংলার বর্ষাকালের জলবতী রসে সিক্ত হয়ে অনন্য করেছে তার প্রকাশ।

”ভিজে হয়ে আসে মেঘে এ-দুপুর—চিল একা নদীটির পাশে
জারুল গাছের ডালে বসে বসে চেয়ে থাকে ওপারের দিকে;
—– — —- — —- (জীবনানন্দ দাশ)”

লেখক :: সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn