হাত নেই, পা নেই, আক্ষেপ নেই
ইয়ানিস ম্যাকডেভিডের সঙ্গে প্রথম দেখাতেই তাঁর বিশেষত্বটা আপনার চোখে পড়বে। হাত নেই, পা নেই, একটা অত্যাধুনিক হুইলচেয়ারে তিনি চলাফেরা করেন। তাঁর সঙ্গে আপনার আলাপ জমে উঠবে দ্রুত। ইয়ানিস নিশ্চয়ই খুব আগ্রহ নিয়ে নিজের গল্প বলবেন, আপনার গল্প শুনবেন এবং টুকটাক রসিকতাও করবেন। আমাদের সঙ্গে আলাপের এক ফাঁকে যেমন বলছিলেন, ‘কীভাবে যে আপনারা দুই পায়ের ওপর হাঁটেন, সেটা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়!’
ইউনিসেফ (জাতিসংঘ শিশু তহবিল) বাংলাদেশের আমন্ত্রণে ইয়ানিস ম্যাকডেভিড ঢাকায় এসেছিলেন ৭ জুলাই। ঢাকা ও সাভারের কয়েকটি জায়গা ঘুরে সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও তরুণদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। ইউনিসেফের কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে আমাদের দেখা হলো ৯ জুলাই। বাংলাদেশে এসেছেন এবারই প্রথম। তবে ভ্রমণপ্রিয় এই তরুণ এরই মধ্যে ইউরোপ ও এশিয়ার বহু দেশ ঘুরেছেন। ঘুরে বেড়ানো তাঁর নেশা। ইয়ানিসের ভাষায়, ‘চার সপ্তাহের বেশি আমি এক জায়গায় থাকতে পারি না। এটাই সম্ভবত আমার সত্যিকার অক্ষমতা। হা হা হা!’ জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব উইটেন হার্ডেকের ইকোনমিকসের এই ছাত্র একজন অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তা (মোটিভেশনাল স্পিকার)। গত এক বছরের মধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় ষাটটি বক্তৃতা করেছেন তিনি।
তাঁর বক্তব্যের মূল কথা খুব সহজ (খুব কঠিনও বলা যায়)। ‘যা তুমি পরিবর্তন করতে পারবে না, সেটা মেনে নাও। তোমার কী নেই, সে হিসাব না করে বরং দেখো, কী আছে।’ অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তবেই জীবন থেকে এই শিক্ষা পেয়েছেন ইয়ানিস ম্যাকডেভিড। হাত-পা ছাড়া তিনি জন্মেছেন। খুব ছোটবেলায় অতশত বুঝতেন না। মোটরসাইকেলে বসা একটা খেলনা পুলিশ অফিসার নিয়ে খেলতেন আর স্বপ্ন দেখতেন, ‘বড় হয়ে আমিও ওর মতো হব, মোটরসাইকেলে চড়ে গুন্ডা–বদমাশদের তাড়া করব!’
ভাবুন তো, বাচ্চা একটা ছেলে জীবনে প্রথম একটা কঠিন সত্যের মুখোমুখি হলো আট বছর বয়সে। আয়নায় নিজের পূর্ণ অবয়ব দেখে আবিষ্কার করল, সে আর দশটা মানুষের মতো নয়। যে স্বপ্নটা সে এত দিন দেখে এসেছে, সেই স্বপ্নপূরণের পথ তার নেই। হ্যাঁ, আট বছর বয়সেই প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছিলেন ইয়ানিস ম্যাকডেভিড। এরপর থেকে পারিবারিক, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানগুলো এড়িয়ে চলতেন। সিঁড়ি ভাঙার ভয় কিংবা হুইলচেয়ারে চলাফেরা করার লজ্জায় কোথাও যেতে চাইতেন না। কোথাও গেলে সবাই তাকিয়ে থাকে—এই ব্যাপারটাও তাঁকে পীড়া দিত।
আর এখন? ইয়ানিস বলেন, ‘মানুষের মনোযোগ কেড়ে নেওয়া একটা দারুণ উপভোগ্য বিষয়। কোথাও গেলে সবাই ফিরে ফিরে তাকায়, নিজেকে সুপারস্টার মনে হয়!’ দৃষ্টিভঙ্গির এই বড় পরিবর্তন আনার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন তাঁর মা। ইয়ানিস বলছিলেন, ‘মা আমাকে কখনোই বুঝতে দিতে চাননি, আমি আলাদা।’ ছেলেকে বিশেষায়িত স্কুলে দিতে রাজি হননি তিনি, আর দশটা ছেলেমেয়ের মতো সাধারণ স্কুলে পাঠিয়েছেন। এমনকি স্কুলে শিক্ষক যখন বলেছেন, ‘নাচের ক্লাসটা ওর না করলে হয় না?’ মা পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, ‘কেন নয়?’ ইয়ানিসকেও জোর দিয়ে বলেছেন, ‘নাচের ক্লাসে তোমাকে যেতেই হবে।’ এখন সে সময়ের কথা মনে করে জার্মান তরুণটি হাসেন। বলেন, ‘অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমিও নাচতে চেষ্টা করতাম।’
মা ছাড়া আরও অনেকের কাছে কৃতজ্ঞ ২৫ বছর বয়সী এই যুবক। ছোটবেলার আরেকটা ঘটনা বললেন তিনি। ‘পাঁচ বছর বয়সে একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমার স্বপ্নের সেই মোটরসাইকেলওয়ালা পুলিশ! তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার মতো হতে চাইলে আমাকে কী করতে হবে? এখন বুঝি, প্রশ্নটা তাঁর জন্য খুব কঠিন ছিল। তবে তিনি কিন্তু একটা দারুণ উত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “আগে পড়ালেখা শেষ করো, তারপর দেখা যাবে।”’ মোটরসাইকেল চালানো বা পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন তাঁর পূরণ হয়নি। তবে ইয়ানিস ম্যাকডেভিডের একটা বিশেষায়িত গাড়ি আছে। জয়স্টিকের সাহায্যে নিজের গাড়ি তিনি নিজেই ড্রাইভ করেন।
ইয়ানিস বিশ্বাস করেন, হাত-পায়ের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো সৃজনশীলতা। চিন্তার শক্তি। বলছিলেন, ‘আমার মতো বিশেষভাবে সক্ষম যাঁরা, তাঁদের সবার আমার মতো আর্থিক সচ্ছলতা নেই। পরিবার বা সমাজের কাছ থেকে সহায়তা অনেকে পায় না। তবু আমি বলব, মনের জোরটাই সবচেয়ে বড়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলেন স্টিফেন হকিং। শুধু চিন্তার ক্ষমতা দিয়েই একটা মানুষ কীভাবে নতুন নতুন আবিষ্কার করে আমাদের চমকে দিচ্ছেন, ভাবুন একবার!’
কেবল স্টিফেন হকিংই নন, নানান দেশ ঘুরে ঘুরে ইয়ানিস অনুপ্রেরণা পান খুব সাধারণ মানুষদের কাছ থেকেও। ইউনিসেফের আয়োজনে ঢাকার মিরপুরে একদল সুবিধাবঞ্চিত শিশুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি। এই ছেলেমেয়েরা কীভাবে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে, সে গল্পও বললেন। ‘গান গেয়ে ওরা আমাকে স্বাগত জানিয়েছে। আপনার হাত-পা আছে কি নেই, ছোট ছেলে–মেয়েদের কাছে কিন্তু এসব গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি মুখে কলম ধরে লিখতে পারি দেখে যেমন একটা ছোট মেয়ে খুব অবাক হলো। বলল, তুমি মুখ দিয়ে লিখতে পারো! আমি তো এখনো হাত দিয়েও লেখা শিখিনি।’ এভাবেই নানা দেশ ঘুরে অনুপ্রাণিত হন, মানুষকে অনুপ্রাণিত করেন এই তরুণ। কথা দিয়ে মুগ্ধ করার জাদু তিনি জানেন। হ্যাঁ, ইয়ানিস ম্যাকডেভিড এমন একজন মানুষ, যাঁর সঙ্গে প্রথম দেখাতেই তাঁর বিশেষত্বটা আপনার চোখে পড়বে। তিনি ভীষণ আত্মবিশ্বাসী, আমুদে। খুব ভালো বক্তা। আর তাঁর চোখ দুটো ভীষণ উজ্জ্বল!