ফাতেমা চৌধুরী স্বপ্না-

অনেক বছর আমেরিকা প্রবাস জীবন কাটানোর পর ফেব্রুয়ারীর ১৭ তারিখ বাংলাদেশ গেলাম। বাংলাদেশে গিয়ে আম্মা এবং ভাই বোনদের সাথে সময় কাটানোর পাশাপাশি প্রিয় শহর সুনামগঞ্জে পায়ে পায়ে হাঁটার চেষ্টা করেছি, প্রিয় মানুষদের এক নজর দেখে আসার ইচ্ছায় কোনো কমতি ছিলো না। তবুও সবার সংগে দেখা হয়নি, মনে দু:খ রয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারীর ২৬ তারিখ বিকেলে শ্রদ্ধেয় বারী চাচাকে দেখতে গেলাম। বারী চাচা শুধু আমেরিকা প্রবাসী, আমাদের প্রতিবেশী শ্রদ্ধেয় রুপু ভায়ের আব্বা নন, তিনি আমার বাবার সাথের একজন রাজনৈতিক সহযোদ্ধোও। সুনামগঞ্জ আওয়ামীলীগ রাজনীতির ছিলেন পুরুধা ব্যক্তিত্ব। ছিলেন  মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। আমার সাথে ভাই পাভেল এবং বোন নীতাও ছিলো। চাচা দেখেই বললেন, তুমি তো স্বপ্না। কেমন আছো তোমরা সবাই? চিনতে পেরেছেন দেখে আমারও খুব খুশী লাগলো। ভেবেছিলাম চাচার মেয়ে আমার বন্ধু মিলিকেও বাসায় পাবো। মিলি তখন একটা বিয়েতে মল্লিকপুরে। পেলাম না। চাচা কাজের লোককে ডেকে আমাদের চা নাস্তা দিতে বললেন।

আমেরিকার বসেবসে চাচা পবিত্র কোরআন শরীফ নিজ হাতে কপি করেছিলেন। তখন তিনি ম্যারিল্যান্ড থাকেন।   উনার নিজের হাতে লিখা কয়েক রুকু’ আমাকে নিউ ইয়র্কে ডাকে পাঠিয়েওছিলেন সে কথাটা মনে হলো। পাঠানো রুকু গুলো এখনও আমার সংগ্রহে সযত্নে আছে বলতেই, দুই বছর সময়ে কিভাবে সম্পুর্ণ কোরআন কপি করেছিলেন,তা নিয়ে অনেক গল্প করলেন। তারপর একে একে অনেক গল্প। আব্বা এবং চাচাদের ছাত্রজীবনের গল্প। আব্বার জন্য বিন্নাকুলী থেকে আমার দাদী নাকি নিজ হাতে পিঠা পুলি তৈরী করে লোক দিয়ে প্রায়ই পাঠিয়ে দিতেন। মায়ের হাতের পিঠা পুলি আব্বা তাঁদের সবাইকে নিয়ে খেতেন। সে সব পিঠার কি স্বাদ! ম্যারীল্যান্ডে থাকাকালীন সময়ে একদিন নিজেই কিভাবে সুস্বাদু রসমালাই বানিয়ে ফেললেন, সে সব গল্প। আমি বললাম, ইশ্ চাচা, আপনার বানানো রসমালাই খাওয়ার ভাগ্য আমার হলো না। আমার কথায় চাচা হেসে কুটি কুটি।
চাচাকে যেনো সেদিন গল্পে পেয়েছিলো। ৭০’ এর নির্বাচনে ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা আমার আব্বার মনোনয়ন পাওয়া থেকে শুরু করে বংগবন্ধু, সামাদ আজাদ চাচাকে নিয়ে অনেক স্মৃতিচারন। হোসন বক্ত নানা সহ আরও অনেক গুনীজনের গল্প। কি সুন্দর,সাবলীল। কোথাও থামছেন না এই বয়সে চাচার স্মরনশক্তি এবং বলার স্পষ্টতা দেখে আমরা যেমন আশ্চর্য হয়েছি তেমনি খুশী হয়েছি। আব্বার কাছে বসে গল্প শোনার আমেজ পেয়েছি। কি যে শান্তি।  চাচার সংগে কাটানো অনেক ভালোলাগায় ভরা সেই সময়টা, আমাদের কাছে খুব মূল্যবান স্মৃতি হয়ে থাকবে।
১০ তারিখে নিউ ইয়র্কের ফ্লাইট ধরার জন্য ৯ তারিখে ঢাকায় চলে আসি। রাতে আমার চাচাতো বোন সালমা আপা/ নজির ভাইয়ের বাসায় ডিনারের দাওয়াত ছিলো। ভাগ্নে হাসান এবং তার স্ত্রী রুনা দেখা করার জন্য আগেই এসে হোটেলে বসেছিলো। সামান্য সময় তাদের সংগে কাটিয়ে সালমাপাদের বাসায় ছুটলাম। পরদিন ভোরে ফ্লাইট। একদম সময় নাই।  সালমা আপা এবং আসমা আপার হাতের মজাদার খাবার এবং নজির ভাই আর আপাদের সংগে কাটলো কিছু সুন্দর সময়। গল্পে গল্পে চলে আসার কষ্ট যেনো কিছুক্ষনের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম। কথা ছিলো, সালমাপাদের বাসায় এসে আমার প্রিয় নাতনী ভাষাকে তাদের ঠিকানা দেয়ার। ঠিকানা পেলে ভাষা দেখা করতে চলে আসতো। এরকমই তার অনুরোধ ছিলো। নিজের বাসায় ডিনারের দাওয়াতও দিয়েছিলো,কিন্তু আমি সালমাপাকে আগে কথা দিয়ে ফেলেছিলাম। এমনিতেই ট্র্যাফিক জ্যামে পরে ঢাকায় আসতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিলো। রাত একটু বেশী হয়ে যাওয়ায় ভাষাকে আর ডাকতে পারিনি। এজন্য ভাষার মতো আমার মনেও দু:খ জমেছে। ইনশাল্লাহ, পরের বার দেখা হবে।
সালমাপাদের বাসা থেকে হোটেলে ফিরে ফোনটা চার্জ করতেই ছোট ভাই সাংবাদিক পীর হাবিবের ম্যাসেজ, রুপু ভাইয়ের আব্বা বারী চাচা মারা গেছেন। আজ রাতেই মারা গেছেন। রুপু ভাইয়ের ছোট ভাই অপু আমেরিকা থেকে এসেছে। রুপু ভাই আমেরিকা থেকে কিছুদিন আগে দেশে অনেক দিন কাটিয়ে আসলেও চাচাকে শেষ বিদায় জানাতে পারলেন না। চাচা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন শুনেছিলাম কিন্তু মারা যাবেন এমনটি তখন মনেও আসেনি। নিউইয়র্ক থেকে আমার হাজব্যান্ড আনোয়ার চৌধুরী ফোন করে খবরটা জানালেন। তারপর আরও অনেকে। মন খারাপের পাশাপাশি, আমাকে বিদেয় জানাতে আসা ভাই জুনেদ খুব আফসোস করছিলো, আমাদেরকে এয়ারপোর্টে বিদায় দিয়ে, সুনামগঞ্জ ফিরে চাচার জানাজায় শরিক হতে পারবে কি না,এই নিয়ে। দেশ ছাড়ার মুহুর্তে চাচার মৃত্যূ,খুব বেশী মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। মাত্র কয়েক দিন আগেই কি সুন্দর গল্প আর আপ্যায়ন করলেন আর আমরা দেশে থাকতে থাকতেই চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন! বারী চাচার প্রস্তানে সুনামগঞ্জ রাজনীতির শেষ বটবৃক্ষটি যেন আস্তে করে মাটিতে শোয়ে পড়লো। আমার বাবার সাথের বেঁচে থাকা শেষ চিহ্নটা মনে হয় সেই সাথে হারিয়ে গেল। হাতে সময়ও তখন এমন, মিলিদের সংগে আর যোগাযোগ করারও উপায় ছিলো না। দোয়া করি, আল্লাহ্ চাচাকে জান্নাতবাসী করুন, পরিবারের সকলের মনে আল্লাহ্ শান্তি দিন,আমিন।

লেখক- ফাতেমা চৌধুরী স্বপ্না

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn