সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার দয়ামীর গ্রামের চার তরুণের মধ্যে বেশ সখ্য ছিল। প্রায়ই তারা একসঙ্গে আড্ডা দিতেন, নানা বিষয়ে গল্প করতেন। তাবলিগে যাওয়ার কথা বলে হঠাৎ একদিন তারা ঘর ছাড়লেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাদের সন্ধান না পেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনার এক বছর হতে চললেও বাড়ি ফেরেননি তারা। নতুন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে ‘হিজরতের নামে ঘরছাড়া’ যে ৩৮ জনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা র্যাব সোমবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করেছে, সেখানে ওসমানীনগরের এই চার তরুণের নামও আছে। এ ছাড়া তালিকায় সিলেট শহরের এক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর নামও আছে। যদিও এই পাঁচ তরুণের স্বজনেরা জানিয়েছেন, নিরুদ্দেশ হওয়ার পর থেকে তাদের সঙ্গে পরিবারের আর যোগাযোগ হয়নি। কেন, কী কারণে তাঁরা ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন, এর সুস্পষ্ট কোনো কারণ তারা বুঝতে পারছেন না।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন দয়ামীর গ্রামের শেখ আহমদ মামুন (২৩), মো. হাসান সায়িদ (২৪), সাইফুল ইসলাম ওরফে তুহিন (২৪) ও মো. সাদিকুর রহমান (৩৩)। একই দিন নিখোঁজ হন সিলেট শহরের শিবগঞ্জ গোলাপবাগ এলাকার বাসিন্দা তাহিয়াত চৌধুরী (১৮)। তাদের মূল বাড়ি জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কাদিমল্লিক গ্রামে। তাদের সন্ধানে পুলিশ ও র্যাব কাজ করছে বলে জানা গেছে। নিখোঁজ তরুণদের পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘নিখোঁজ’ পাঁচজনের মধ্যে একজন শরীরচর্চাকেন্দ্রের (জিম) প্রশিক্ষক। একজন মাদ্রাসা থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করেছেন। অন্য তিন তরুণের মধ্যে দুজন শিক্ষার্থী। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, অন্যজন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিলেন। একজন মাদ্রাসার পাঠ অসমাপ্ত রেখে পাহারাদার পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। নিখোঁজ তরুণেরা জঙ্গিবাদে জড়িত হয়েছেন বলে র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে যে তথ্য জানানো হয়েছে, এ সম্পর্কে তরুণদের স্বজনেরা অবহিত নন বলেও দাবি করেছেন।
তাহিয়াতের বাবা কামাল উদ্দিন চৌধুরী অনেক আগে দুবাইপ্রবাসী ছিলেন। এখন দেশেই থাকেন। তিনি বলেন, তাহিয়াতের গত বছর সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাণিজ্য বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। নিখোঁজের দিন উপশহর এলাকায় যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে তাহিয়াত আর ফেরেননি। তিন ছেলের মধ্যে তাহিয়াত সবার ছোট। তার বড় ছেলে ফার্মেসি ব্যবসায় যুক্ত এবং দ্বিতীয় ছেলে শিক্ষার্থী ভিসায় যুক্তরাজ্যে আছেন
তাহিয়াতের নিখোঁজের ঘটনায় জিডি হওয়ার পর থেকে পুলিশ সন্ধান চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিলেট মহানগরের শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আনিসুর রহমান। তবে তাঁর কোনো খোঁজ মেলেনি বলেও জানান তিনি। নিখোঁজ সাদিকুর রহমান দয়ামীর বাজারের একটি শরীরচর্চাকেন্দ্রের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। এ প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রায় তিন বছর আগে কাজ নেন। স্থানীয় এক মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পরে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে বিভিন্ন শরীরচর্চাকেন্দ্রে কাজ শুরু করেন। ২০১৮ সালে বিয়ে করেন। তার চার বছরের এক মেয়েও রয়েছে।
সাদিকুরের স্ত্রী ফারজানা রিয়া বলেন, তাবলিগের কথা বলে তিনি (সাদিকুর) ঘর ছাড়েন। এক সপ্তাহ পরও যখন ফেরেননি, তখন থানায় পরিবারের পক্ষ থেকে জিডি করা হয়। সাদিকুরের তিন বোনের মধ্যে দুই বোন যুক্তরাজ্যে থাকেন। তাঁরা বিবাহিত। অপর বোন ও সাদিকুরের মা এখানে আছেন। নিরুদ্দেশের পর থেকে স্বামীর সঙ্গে আর তাঁর যোগাযোগ হয়নি বলে জানিয়েছেন রিয়া।মো. হাসান সায়িদ ঢাকার ফরিদাবাদ মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাস করেন। এরপর বাড়িতে এসে যৌথভাবে পাথরের ব্যবসা শুরু করেন। তবে করোনা পরিস্থিতিতে ব্যবসায় লোকসান করে বাড়িতে বেকার দিন কাটাচ্ছিলেন। সচ্ছল পরিবার তাদের। বাবা মো. ছোরাব আলী হাসান একসময় আরব আমিরাতপ্রবাসী ছিলেন। তবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি দেশেই আছেন। নিখোঁজের পাঁচ মাস আগে পরিবারের সদস্যরা সায়িদকে বিয়ে করিয়েছেন। নতুন স্ত্রীকে বাড়িতে রেখেই তিনি তাবলিগে যাওয়ার কথা বলে নিরুদ্দেশ হন।
সায়িদের বাবা ছোরাব আলী বলেন, তার ছেলে ভালো আরবি জানেন। যখন ছেলে জানিয়েছেন, একটা বিদেশি তাবলিগের দল এসেছে, তখন তিনি ভেবেছেন, হয়তো ছেলে তাবলিগেই যাচ্ছেন। এর পর থেকেই ছেলে নিরুদ্দেশ। অথচ নিরুদ্দেশের আগে অসুস্থ থাকায় তাঁকে (ছোরাব আলী) এক দিন আগে চিকিৎসকও দেখিয়েছেন সায়িদ। এভাবে ছেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারেন, এটা তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। শেখ আহমদ মামুনের ছোট ভাই শেখ আলী মাহিন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। তারা দুই ভাই একই বিছানায় ঘুমাতেন। মাহিন জানান, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে শেখ আহমদ মামুন সবার বড়। তিনি সিলেটের লিডিং ইউনিভাসির্টিতে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিষয়ে দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সেমিস্টারে পড়তেন। নিখোঁজের পর থেকে মামুনের ফেসবুক আইডি ডিঅ্যাকটিভ বলে তিনি জানিয়েছেন।
নিখোঁজ সাইফুল ইসলাম স্থানীয় দারুল কোরআন মাদ্রাসায় টাইটেল পর্যন্ত পড়লেও চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেননি। এরপর পরিবারের সদস্যরা তাঁকে স্থানীয় একটা গ্যারেজে পাহারাদারের চাকরিতে নিযুক্ত করেন। নিখোঁজের আগপর্যন্ত সেখানেই কাজ করছিলেন। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। সাইফুলের বাবা আবদুল মানিক জানান, নিখোঁজের পর থেকে পরিবারের কারও সঙ্গে সাইফুলের যোগাযোগ নেই। তাঁর অবস্থান কোথায়, সেটাও তাঁরা জানেন না। ওসমানীনগর থানার ওসি এস এম মাঈন উদ্দিন বলেন, চার তরুণ একসঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়েছেন বলে তাদের পরিবারের সদস্যরা ধারণা করছেন। তবে পুলিশ তাঁদের সন্ধান চালানো অব্যাহত রেখেছে। এখনো তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। সূত্র: প্রথম আলো
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১৩৩ বার