১০ টাকার শিঙাড়া, চা, সমুচা এবং অভিনেতা, যুব নেতাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
যুক্তরাজ্য থেকে ডা: আলী জাহান-
১. ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তাহে দু’দিন-তিনদিন করে মোট তিন বছর যাতায়াত করেছি। Neuropsychiatryর উপর মাস্টার্স ডিগ্রী (MSc in Neuropsychiatry) করছিলাম। দুর্ভাগ্য হলো যে, তিন বছর যাতায়াত করার পরও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নাম জানি না। জানার ইচ্ছেও হয়নি। উপাচার্যের অফিস কোথায় তা জানতাম না। ছাত্র সংসদের অফিস কোথায় তাও জানা ছিল না। তবে ডিপার্টমেন্ট’র অফিস কোথায় তা জানতাম। ক্লাসের বাইরে কোনো সাহায্য লাগলে কার সাথে যোগাযোগ করতে হবে তা অবশ্য জানা ছিল।
২. আপনার হয়তো ভাবছেন, আমি একজন বোকা লোক। আপনারা হয়তো বা সঠিক। তবে আমার মতো বোকা লোকের সংখ্যা ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শতকরা ৯৫-৯৭ ভাগ। ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে শিক্ষা অর্জনের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির অফিস কোথায়, ওনার নাম কী, উনি কি সাদা দলের না নীল দলের তা জেনে তাদের কি লাভ? উনি কি মানবিক ভিসি না অমানবিক ভিসি তা জানার কোনো প্রয়োজন আছে? উনি কি অভিনেতা ভিসি না যুব ভিসি তা জেনে আমার কি লাভ?
৩. তবে বাংলাদেশে তা জানলে অনেক লাভ আছে। অনেক প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন আছে বলেই বাংলাদেশের কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কাহিনী পত্রিকার পাতায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং টিভি চ্যানেলে প্রধান খবর হয়ে ওঠে। গবেষণার খবর আসেনা তবে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির খবর আসে। আত্মহত্যা বন্ধের খবর আসে না তবে আত্মহত্যার খবর আসে। মানুষকে বাঁচানোর খবর আসে না তবে পিটিয়ে রক্তাক্ত করার, মেরে ফেলার খবর আসে। এসব বন্ধে উপাচার্য মহোদয়গণ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এমন খবর চোখে পড়ে না। তবে বিভিন্ন মুখরোচক সংবাদের জন্ম দিয়ে উনারা মিডিয়ায় বারবার আসেন। উনাদের পরিচয় আপনাকে জানতেই হবে। না জানলে আপনি পিছিয়ে থাকবেন।
৪. বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানতাপস উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ দায়িত্ব পালনকালীন সময় উনার যোগ্যতার অনেক অনেক প্রমাণ দিয়েছেন! সমালোচনাকারীরা বলছেন যে, উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেনের টিকেট মিস করেছেন, লাইনচ্যুত হয়েছেন। সে কারণেই উনার বিরুদ্ধে উনারই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ছাত্রছাত্রীরা দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করেছেন। তদন্ত কমিটি হয়েছে এবং তারাও তার ভয়াবহ দায়িত্ব বিচ্যুতির প্রমাণ পেয়েছেন। উনি অবশ্য তা থোড়াই কেয়ার করেন। পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেছেন। নিজের অযৌক্তিক অবস্থানকে যৌক্তিক প্রমাণ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। সরকারের তাতে মন গলেনি। নতুন উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণ করছেন ১৪.০৬.২১ তারিখে। কিন্তু এই মহান জ্ঞানী ব্যক্তি থেমে যাবার মতো পাত্র নন। আজ পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন সময়ে তিনি একটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। শুটার সিনেমায় তিনি ঢাকার এক পুলিশ কমিশনারের চরিত্রে অভিনয় করেন।তিনি বলেছেন যে, কাজের ফাঁকে তিনি অভিনয় করেছেন এবং তাতে দোষের কিছু দেখছেন না।সুযোগ পেলে নায়ক হিসেবে তিনি ভবিষ্যতে অভিনয় করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। তিনি আরো মনে করেন যে, তার দেখাদেখি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও অভিনয়ে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন। আরও দাবি করেছেন যে, অভিনেতা হিসেবে তিনি স্বার্থক। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ব্যক্তির (উপাচার্য) এসব গুণাবলী থাকে তার পরিচয় দেশবাসীর কাছে তো বটেই বরং পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলাভাষী মানুষদের থাকা দরকার। হাস্যকর কাজ কর্মের মাধ্যমে উনারা সাধারণ মানুষের কাছে বিনোদনের পাত্র হবেন এটাই স্বাভাবিক। ভোর রাত তিনটার সময় ঘুম থেকে জাগিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস নেন যে ভিসি এমন জ্ঞানী ব্যক্তির নাম আপনি কেনো জানবেন না? তাকে নিয়ে যদি কেউ হাসাহাসি করে তাহলে কি তা জামিন অযোগ্য অপরাধ হবে?
৫. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গবেষণার চাইতে রাজনীতি ও দলীয় চর্চা বেশি হচ্ছে কিনা তা যারা বাংলাদেশে থাকেন তারা ভালো বলতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিশ্ব (র্যাং কিং) তালিকা সেই তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ নিয়ে কোনো হা-হুতাশ বা অস্বস্তি লক্ষ্য করা যায় না। পরিবর্তে, মাঝেমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংঘর্ষের খবর আসে। এর মধ্যে গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য দাবি করে বসেন যে, পৃথিবীতে এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া যাবে না যেখানে মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে শিঙাড়া, সমুচা এবং চা পাওয়া যায়। উনার সেই বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক ট্রল হলেও উনাকে উনার বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের চেয়ারে বসে এ ধরনের বিনোদনমূলক বক্তব্য দিলে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারা কেন বরং সারা দেশের লোকজন আপনার নাম এবং পরিচয় জানবে। আপনার সেই পরিচয়ের ব্যপ্তি দেশ ছেড়ে মহাদেশের গণ্ডিতে ছড়িয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আপনি মুহূর্তেই দেশের গণ্ডি ছেড়ে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠবেন।
৬. জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক জ্ঞানতাপস ব্যক্তি উপাচার্যের দায়িত্ব ছেড়ে একটি রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠনের দায়িত্ব নিতে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছিলেন এ দায়িত্ব নিতে তার ভেতর কোন অস্বস্তি কাজ করছে না। উনার সেলাই খোলা মুখ দিয়ে আরো একটি ইচ্ছে তিনি প্রকাশ করেছেন। এবং সে ইচ্ছেটা হচ্ছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের চাকরি করার অধিকার আছে। এমন চমৎকার বক্তব্য দেয়ার পর দেশবাসী উনার নাম জানবেনা কেন?
৭. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক মহান জ্ঞানতাপস ভিসি মানবিক সোবহান সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাবার শেষ দিনে বিশ্ববিদ্যালয় ad-hoc ভিত্তিতে নিয়োগ নিয়ে যা করেছেন তা বাংলাদেশে এর আগে কখনো ঘটেছে বলে জানা নেই। উনি অবশ্য একটি কঠিন যুক্তি দিয়েছেন। দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাবার শেষদিনে কেন তিনি এতো নিয়োগ দিলেন- এই বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছেন, নিতান্তই মানবিক কারণে একটি সংগঠনের নেতাকর্মীদের তিনি শেষ মুহূর্তে নিয়োগ দিয়েছেন। এমন মানবিক একজন বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির নাম লোকজন জানবে না তা কি হয়?
৮.চিন্তাগুলো কয়েক দিন/সপ্তাহ ধরে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বাংলাদেশে কাউকে জিজ্ঞেস করলে সহজভাবে উত্তর দিতে উনারা রাজি হন না। আমি তাদের বিপদ বাড়াতে চাই না। তাই সে প্রশ্নগুলো আর তাদেরকে করি না। নিজের ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি চলতে থাকে। কিন্তু কোনো সমাধান পাই না। আমার সেই অস্বস্তিকর মুহূর্তগুলোতে কিছুটা হলেও স্বস্তির ঠান্ডা বাতাস বইয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। ১০.০৬.২১ তারিখের বাংলা সংবাদপত্রের সংবাদ অনুসারে এ মহান ব্যক্তি জনগণকে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে ‘সরকারি তথ্য লুকানোর কিছু নেই। সরকারের ৯৯ শতাংশ তথ্য প্রকাশে কোন সমস্যা নেই’। তাঁর এ কথার উপর ভিত্তি করে আমি কিছু প্রশ্ন করবো। উনি বা উনার সরকার সে প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিলেও পাঠকরা আমার সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে সাহস পাবেন বলে মনে করি। আমার ভেতরে অস্বস্তি কমে আসতে শুরু করেছে! আমি দেখতে পাচ্ছি আপনারা সাহসী হয়ে উঠছেন। আমার প্রশ্নের উত্তর গুলো আসা শুরু হয়েছে।
৯. উপরে বর্ণিত বাংলাদেশের তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মানুষ গড়ার কারিগরদের যে কাহিনী বর্ণনা করলাম তাদের ব্যাপারে আমার জানার অধিকার আছে? জানতে চাইছি বারবার অভিযোগ উত্থাপন করার পরেও ওনাদের ব্যাপারে কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি? আদৌ কোনো ব্যবস্থা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল? ভবিষ্যতের বাংলাদেশে মহান জ্ঞানী ব্যক্তি যুব মিজান, মানবিক সোবহান অথবা অভিনেতা কলিমুল্লাহদের হাত থেকে কি কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের বাঁচার কোন সুযোগ আছে? তাদেরকে বাঁচানোর কোনো পরিকল্পনা আছে?