মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধুকেও হার মানায়। নিষ্ঠুরতা কারবালার ময়দানের মতোই ভয়াবহ। জাতির পিতাকে হত্যা করা হলো অথচ জীবন বাজি রাখলেন না কেউ। করলেন না টুঁশব্দ। দিলেন না আত্মাহুতি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতার লাশ রেখে কেউ গেলেন শপথ নিতে, কেউ শপথ পড়াতে। কেউ ব্যস্ত থাকলেন জান বাঁচাতে। কেউ নীরবে কাঁদলেন কেউ থাকলেন সিদ্ধান্তহীনতায়। কেউ অপেক্ষা করলেন স্বেচ্ছা কারাবরণের। কেউ গেলেন বাড়ি থেকে পালিয়ে। পুরোটাই এক ব্যর্থতার নির্মম ইতিহাস। ঘটনার প্রতিবাদে রাজপথে আসতে না পারার কলঙ্ক। এখন সবাই অনেক কথা বলছেন। গালভরা বক্তৃতা দিচ্ছেন। সেই ব্যর্থতার জবাব মেলে না। এ লেখা যখন লিখছি তখন স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করেছে।
বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন বিশে^র বুকে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে। যিনি দেশটি প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি এই উঠে দাঁড়ানো দেখে যেতে পারেননি। তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়। দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা সদ্য স্বাধীন-সার্বভৌম নতুন দেশটিকে টার্গেট করেছিল। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থামাতে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় জাতির পিতাকে। সেই হত্যার প্রতিবাদ জানাতে ব্যর্থ হয়েছিল তখনকার আওয়ামী লীগ। প্রতিরোধ করতে পারেনি রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনী। সেনাপ্রধানের ফোন পেয়ে সশস্ত্র বাহিনী পাল্টা অবস্থান নেয়নি। সেসব ব্যর্থতা এখনো এক রহস্যের বেড়াজালে আচ্ছন্ন। আওয়ামী লীগের বিশাল সংগঠন ছিল। অভাব ছিল না নেতা-কর্মী, আমলা-কামলা, চাটুকারের। তারা কোথায় ছিলেন? সারা দেশে সেনাবাহিনী নামেনি। ঢাকার নির্দিষ্ট এলাকায় ছিল তাদের বিচরণ। তার পরও কেন একটি মিছিলও বের করল না ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ। বাকশাল গঠনের পর দলে দলে যোগদানের হিড়িক ছিল। প্রতিদিনই সারা দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যোগ দিতেন। লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিতেন। জাতির পিতার জন্য জীবন দেওয়ার ঘোষণা দিতেন। সংবাদপত্র জুড়ে থাকত সেসব খবর। আমলা-কামলা, নেতা-কর্মী, নিরাপত্তারক্ষীর অভাব ছিল না। নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর কেউ টুঁশব্দ করল না। ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতারা চুপসে গেলেন ভোরবেলায়। সকালে ৩২ নম্বরে ১ লাখ লোক জমায়েত হলে খুনিচক্র এক সেকেন্ড টিকতে পারত না। ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠান ছিল। সারা দেশের নেতা-কর্মীরা ছিলেন ঢাকায়। ক্যাম্পাস ছিল রাতভর ছাত্রলীগ কর্মীদের হাঁটাচলায় মুখরিত। ভোরে খবর শুনে কেউ মিছিল করল না কেন? সেই ব্যর্থতার দায় কি তখনকার ছাত্রলীগ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এড়াতে পারবেন? ক্যাম্পাস থেকে একটি মিছিল বের হলে তা মুহূর্তে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ত সারা দেশে। নেতাদের ব্যর্থতা আর চুপসে যাওয়ায় থমকে গেলেন কর্মীরা। আর বঙ্গবন্ধুর সহচররা গেলেন শপথ নিতে। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের ক্যাবিনেট সচিব এইচ টি ইমাম। তখনকার পররাষ্ট্র সচিব ফখরুদ্দিন আর এইচ টি ইমাম একসঙ্গে, এক গাড়িতে গেলেন বঙ্গভবনে। তাঁদের জোর করে নিতে হয়নি। স্বেচ্ছায় গিয়েছিলেন। বড় নিষ্ঠুর আমাদের সেসব ইতিহাস।
ব্যর্থতার দায় সশস্ত্র বাহিনীসহ কেউ এড়াতে পারে না। রাজনীতিবিদরা ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আমলারা মুহূর্তে বদলে গিয়েছিলেন। অন্য বাহিনীর মতো পুলিশপ্রধানও গেলেন আনুগত্য জানাতে। মুহূর্তে সবাই হয়ে গেলেন খুনিচক্রের সহযোগী। রাষ্ট্রপতিকে রক্ষায় ব্যর্থ হলেন সে সময়ের সব গোয়েন্দা সংস্থা আর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরা। মুহূর্তে সুর বদলালেন দলে দলে বাকশালে যোগদানকারীরাও। বঙ্গবন্ধুর পায়ের নিচে বসে বেশি চাটুকারিতা যারা করতেন, তাদেরও পাওয়া যায়নি। নিজেদের রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে ওঠেন সবাই। দলের কোনো একজন নেতাও ডাক দেননি কর্মীদের বেরিয়ে আসতে। ব্যর্থতা ছিল রক্ষীবাহিনীরও। এ বাহিনীর সব সদস্যই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। নির্দেশ না পেয়ে ক্ষোভে-অভিমানে সাভারে রক্ষীবাহিনীর দুজন সদস্য আত্মহত্যা করেন। বিডিআরের ভিতরে থাকা তাদের অস্ত্রাগারের অস্ত্র আটকে দেওয়া হলো। তাদের অস্ত্র দেওয়া হলো না। রক্ষীবাহিনী বের হলে পরিস্থিতি বদলে যেত। বলা হয়, সেনাবাহিনীর বিচ্ছিন্ন সদস্যরাই ঘটনা ঘটিয়েছিল। প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে সেনাপ্রধানের নির্দেশ অন্যরা কেন শুনলেন না? যারা ৩ নভেম্বর পাল্টা অবস্থান নেওয়ার তাগিদ অনুধাবন করলেন তারা কেন ১৫ আগস্ট বের হলেন না? রুখে দাঁড়ালেন না খুনি মেজর চক্রের বিরুদ্ধে? বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, সবাই বসে বসে খুনিদের তামাশা দেখলেন। এর চেয়ে কলঙ্কজনক, দুঃখজনক ঘটনা এ জাতির ইতিহাসে কিছু নেই। কোনো দিন হবেও না। শাফায়েত জামিল, খালেদ মোশাররফ অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ছিলেন। কিন্তু তাঁরাও ছিলেন সিদ্ধান্তহীনতায়। ৩ নভেম্বরের প্রতিরোধ ১৫ আগস্ট হলে ইতিহাস বদলে যেত।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার বইটি পড়ছিলাম। এ এল খতিব ও অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বইতেও ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য আছে। খুনি ডালিমের স্ত্রী নিম্মি ছিলেন শেখ রেহানার সহপাঠী। নিম্মি নিয়মিত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আসতেন। বাদ থাকত না ডালিমের শাশুড়িও। তারা দুপুরে খেতেন। আসতেন ডালিমও। একদিন ডালিম বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে বললেন, তার মা নেই। বেগম মুজিবকে দেখলে মায়ের মুখটা মনে পড়ে। অনুমতি নিয়ে ডালিম বেগম মুজিবকে মা ডাকলেন। বেগম মুজিব তাকে পুত্রস্নেহে খাবার তুলে দিতেন। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস সেই ডালিম ছিলেন ১৫ আগস্টের খুনিদের অন্যতম। খুনি ডালিমের কি একবারের জন্যও মনে পড়েনি বেগম মুজিবের স্নেহের কথা? মানুষ এতটা ভয়াবহ হয় কী করে! খুনিদের সরদার মোশতাককে বিজয়ী করে আনেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনের ২৯১টিতে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। সবাই বিপুল ভোটে জয়ী হলেও মোশতাক মাত্র ৭০০ ভোটে জয়ী হন। তা-ও ফল ঘোষণা করতে বিলম্ব হয়। ভোটের প্রচারণার সময় মোশতাক একদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে এলেন। অনুরোধ করলেন তার নির্বাচনী এলাকা সফরের জন্য। বঙ্গবন্ধু সে অনুরোধ রক্ষা করেন। তার পরও সেই জোয়ারে মাত্র ৭০০ ভোটে জয়লাভে বোঝা যায় মোশতাক কতটা অজনপ্রিয় ছিলেন নিজের এলাকায়। সেদিন খুনি মোশতাক জয়ী না হয়ে রশিদ ইঞ্জিনিয়ার বিরোধী পক্ষ থেকে সংসদে এলে কী এমন ক্ষতি হতো? এত আসন না পেলেও কিছু আসত-যেত না আওয়ামী লীগের। এ নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে একজন জিজ্ঞাসা করলেন, মোশতাককে নির্বাচনে জেতাতে সাহায্য করা আপনার জন্য খুব জরুরি ছিল? জবাবে বঙ্গবন্ধু হাসলেন। বললেন, সে আমার একজন পুরনো সহকর্মী। ১৫ আগস্ট মোশতাক বঙ্গবন্ধুর সেই অবদানের কথা মনে রাখেননি।
প্রতিবাদী বীর যোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। ১৯৭১ ও ’৭৫ সালের সুবিধাভোগী আমলাকুল, কামলাকুলকে যখন গালাগাল করেন অনেকের মতো আমার খারাপ লাগে না। কাদের সিদ্দিকী একজন বীর যোদ্ধা। ’৭৫-এ কেন্দ্রের নয়, টাঙ্গাইলের নেতা ছিলেন। গভর্নর ছিলেন। সেই অবস্থানে থেকে একমাত্র তিনিই সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর কয়েক শ সহযোদ্ধা জীবন দিয়েছেন। অনেকে গিয়েছেন ফাঁসির মঞ্চে। কারও হয়েছিল যাবজ্জীবন। তাদের এ রাষ্ট্র এত বছরেও স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু পুরস্কৃত করেছে খুনিদের সহায়তাকারীদের। দলের দুঃসময়ে যারা ভূমিকা রাখে তাদের আবেগ থাকে। তারা চাটুকারিতা করতে পারে না। তাদের কেউ পছন্দ করে না। কিন্তু তাদের অবদান খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
রক্ষীবাহিনীর দুজন উপপরিচালক ছিলেন- প্রয়াত আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সরোয়ার হোসেন মোল্লা। তাঁদের দুজনের সঙ্গে বিভিন্ন সময় কথা বলেছিলাম সেসব ব্যর্থতা নিয়ে। সরোয়ার মোল্লার কিছু কথা প্রকাশও করেছি বাংলাদেশ প্রতিদিনে। সেই কালো সকালে কারা তাঁদের ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গভবন ও ক্যান্টনমেন্টে? সারা দিন ব্যস্ত রাখলেন বিভিন্ন আলোচনার নামে। সেই সেনা কর্মকর্তাদের তালিকা দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। চাওয়া-পাওয়াতে ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের অনেকের পরিবার-পরিজন অনেক পেয়েছে আওয়ামী লীগ থেকে। বাদ যায়নি ৭ নভেম্বরের পাল্টা অবস্থানকারীদের পরিবারও। সেসব নিয়ে আলোচনা করতে চাই না আজ। বরং আসি জেনারেল খলিলের কথায়। তিনি ছিলেন বিডিআরপ্রধান। পিলখানায় রাখা অস্ত্র শতভাগ মুক্তিযোদ্ধার প্রতিষ্ঠান রক্ষীবাহিনীকে দিলেন না তিনি। মোশতাকের বঙ্গভবনের প্রভাবশালীদের তালিকায় জেনারেল খলিলও ছিলেন। তিনিও পরে আওয়ামী লীগ করেছেন। মনোনয়ন নিয়েছেন বারবার। ১৯৯১ সালে নৌকা পেয়েছিলেন সর্বশেষ। ’৯২ সালে ভোরের কাগজে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ভোররাতে তিনি শেভ করতে করতে খবর পেয়েছিলেন। এত ভোরে উঠে কেন শেভ করতে করতে রেডিও ছেড়েছিলেন সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি।
জেনারেল খলিলকে আওয়ামী লীগে কারা নিয়েছিলেন? কেন নিয়েছিলেন? অনেক প্রশ্নের জবাব মেলে না। কী করে আমীন আহমেদ চৌধুরী হয়ে গেলেন রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব? বঙ্গভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব কর্নেল মতিনকে কারা দিলেন? রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নিয়ে জিয়াউর রহমান, বিডিআরপ্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, পুলিশের আইজি নুরুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার মসহুরুল হক বঙ্গভবনে এত দ্রুত কেন বৈঠকে মিলিত হলেন? রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের শান্ত করতে ১৭ আগস্ট কার নির্দেশে সাভার ক্যাম্পে গেলেন সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল কর্নেল মইনুল হোসেন চৌধুরী? জেনারেল শফিউল্লাকে সেনাপ্রধান থেকে সরিয়ে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হয়। আবার একই দিন সিজিএস করা হয় খালেদ মোশাররফকে। ইতিহাসের অনেক কঠিন সত্য রয়েছে। সেসব আড়াল করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এম এ জি ওসমানী হন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা। আর মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান হন চিফ অব দ্য ডিফেন্স স্টাফ। জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অফিসার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার এম এ মঞ্জুর। তিনি ছিলেন দিল্লিতে ডিফেন্স অ্যাটাশে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর শুনে তিনি ঢাকা আসেন। ছায়ার মতো ছিলেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। খালেদ মোশাররফ সিজিএস হওয়ায় তাঁর মন খারাপ ছিল। তিনি হাল ছাড়েননি। নিয়তির পরিহাসে এই মঞ্জুর জিয়া হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। রক্ষীবাহিনীর পরিচালক নুরুজ্জামান ১৫ আগস্ট দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি দেশে ফেরার পর অক্টোবরের শুরুতে রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ হয়। সে সময় নুরুজ্জামান বারবার শাফায়েত জামিল, খালেদ মোশাররফদের সঙ্গে কথা বলেন পাল্টা কিছু করার। খুনিদের উৎখাত ও মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করতে তাঁরা দুজন নুরুজ্জামানের সঙ্গে একমত হলেন। তাঁদের চেষ্টা ভণ্ডুল করে দেয় ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জাসদ। তাঁরা জিয়াউর রহমানকে সমর্থন জানান। গত ১৪ বছর পুরস্কার তাঁরাও কেউ কম পাননি আওয়ামী লীগ থেকে।
বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় নিরাপত্তা বলয় শক্তিশালী ছিল না। সাদামাটাভাবে জীবন কাটাতেন জাতির পিতা। দেশের রাষ্ট্রনায়ক হয়েও থাকতেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ছোট্ট বাড়িতে। ভাবতেন না নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা। রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক কর্নেল সরোয়ার মোল্লার সঙ্গে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিয়ে পুলিশের ই এ চৌধুরী, এসপি মাহবুব উৎকণ্ঠায় ছিলেন। রক্ষীবাহিনীর দুই সেকেন্ডম্যান সরোয়ার মোল্লা ও আনোয়ারুল আলম শহীদকে নিয়ে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর কাছে যান। নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠার কথা বঙ্গবন্ধুকে জানান। পরামর্শ দেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ছেড়ে বঙ্গভবন অথবা গণভবনে উঠতে। এতে সায় দিলেন না বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু তাঁদের বললেন, ‘মানুষ সারা জীবন আমাকে তাদের মাঝে পেয়েছে। ধানমন্ডি ছাড়লে তাদের থেকে দূরে সরে যাব। আমি মানুষের নেতা। মানুষের মাঝে থাকতে চাই। ’ বেগম মুজিবও সম্মত ছিলেন না ৩২ নম্বর ছাড়তে। এ বাড়ি পছন্দের ছিল শেখ কামাল ও জামালেরও। সরোয়ার মোল্লা বলেন, রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টসহ অন্য বাহিনীগুলো। রক্ষীবাহিনী নয়। রক্ষীবাহিনীর কাজ ছিল সদ্যস্বাধীন দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিক করা। অস্ত্রধারী, কালোবাজারি, মজুদদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এ বাহিনীর সদস্যরা সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের একটা কমিটমেন্ট ছিল। সর্বহারা ও জাসদের গণবাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করতে পারে এমন তথ্য ছিল রক্ষীবাহিনী ও পুলিশের কাছে। সরোয়ার মোল্লা বলেন, এ খবরে ধানমন্ডি ৩২-এর আশপাশে টহল বাড়িয়েছিলাম। রক্ষীবাহিনীর সেই টহল ভালো নজরে নেননি শেখ মণি। তিনি ভুল বুঝলেন। তিনি ভাবলেন তাঁকে ডিস্টার্ব করতে কারও নির্দেশে রক্ষীবাহিনী ধানমন্ডিতে টহল বাড়িয়েছে। এ বিচার বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়ায় টহল কমাতে হয়েছিল। তিনি বলেন, রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের ঘাঁটি ছিল সাভার। শেরেবাংলানগরে ছিল প্রধান কার্যালয়। নিজস্ব অস্ত্রাগার ছিল না। অস্ত্র রাখা হতো পিলখানায়। পরদিন বিডিআরপ্রধান খলিল আমাদের অস্ত্র দেননি। রক্ষীবাহিনী প্রধান দেশে না থাকায় আলোচনার নামে শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা তাঁদের দুজনকে সারা দিন ব্যস্ত রাখেন ক্যান্টনমেন্ট ও বঙ্গভবনে। তিনি বলেন, আমাদের ঘরানার সেনা অফিসাররা ধৈর্য ধরতে বললেন রক্ষীবাহিনীকে। সাভারে আমাদের দুজন সদস্য বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবরে আত্মহত্যা করেন। কোনো রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, সরকার কারও কাছ থেকে নির্দেশ পায়নি রক্ষীবাহিনী কিছু করার।
আগাম গোয়েন্দা তথ্য নিয়েও অনেক প্রশ্ন। তবে ভারতীয় গোয়েন্দাদের তথ্যের ভিত্তিতে ইন্দিরা গান্ধী সতর্ক করেন বঙ্গবন্ধুকে। ইন্দিরার বান্ধবী তাঁর সরকারের মন্ত্রী পুপুল জয়করের একটি বই আছে। বইটি ইন্দিরা গান্ধীর আত্মজীবনীমূলক। তিনি লিখেছেন, ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’প্রধান রামেশ্বর নাথ কাও একদিন ইন্দিরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ইন্দিরাকে জানান, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ভিতরে বিদ্রোহ পাকিয়ে তোলা হচ্ছে। ইন্দিরা সব তথ্য ঢাকা গিয়ে মুজিবকে জানানোর নির্দেশ দেন। কাও ঢাকায় আসেন। তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থা তাঁকে বিস্মিত করে। বাগানে পায়চারি করতে করতে তিনি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। তারপর বঙ্গবন্ধু তাঁকে আশ্বস্ত করেন, ‘কিছু হবে না। ওরা আমার লোক। পাকিস্তান আর্মি কিছু করার সাহস পায়নি, বাংলাদেশে ওরা কী করবে?’ মন খারাপ করে কাও দিল্লি ফিরে যান। সবকিছু অবহিত করেন ইন্দিরাকে। বঙ্গবন্ধুর একটা বিশ্বাস ছিল তাঁর জাতির প্রতি। দল, সরকার ও তাঁকে রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকদের প্রতি। কেউই সেই বিশ্বাস রাখেনি। আসলে মানুষের চেহারা বদলাতে সময় লাগে না। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সবাই বদলে গেল। আর যারা বদলালেন না তারা থাকলেন একরাশ ব্যর্থতা, হতাশা, কষ্ট সঙ্গে নিয়ে।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
২৩১ বার