৫৭ গেলেও আসছে ১৯ থেকে ২২ ধারা
তথ্য-প্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা আর থাকছে না। এর বদলে আসছে ১৯ ধারা। ৫৭ ধারার অনুযায়ী কিছু অপরাধ আলাদা করায় সমস্যা ছিল। তাই এটি ‘সেপারেট’ করে ডিজিটাল সিকিউটিরি অ্যাক্টে নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তথ্য-প্রযুক্তি আইনকে ডিজিটাল সিগনেচার আইন হিসেবে রেখে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বানানোর কাজ চলছে। নতুন আইনে রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলোকে এক জায়গায় নিয়ে বাকি অপরাধগুলোকে আলাদা করার পরিকল্পনা হচ্ছে। যদিও প্রথমে দুটি আইনকে একসঙ্গে করার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বিভ্রান্তি এড়াতে ভিন্ন ভিন্নই রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে ৫৭ ধারা আরও বেশি খোলাসা ও সুস্পষ্ট করে নতুন আইনের ১৯ ধারায় আসছে। কেবল ১৯ না এর পাশাপাশি আরও কিছু ধারা এ সংশ্লিষ্টই থাকবে বলেও জানিয়েছেন তারা।
নতুন আইনের খসড়ার তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫৭ ধারাটিকে সামান্য বদলে গেছে নতুন আইনে। সেটা ব্যাখ্যাগুলো সুস্পষ্ট হওয়া। অপরাধগুলো তালগোল না পাকিয়ে যাওয়া। ৫৭ ধারার মতো এখানেও আইনের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফাঁক-ফোকর রাখা হচ্ছে। অবশ্য আইনমন্ত্রী বলছেন, ‘প্রিম্যাচ্যুর মন্তব্য না করাই ভালো। আগস্টের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।’
৫৭ ধারার ১ উপ-ধারা: ‘কোনও ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’
উপ-ধারা ২: ‘কোনও ব্যক্তি উপ-ধারা (১)-এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বছর এবং ন্যূনতম সাত বৎসর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন৷’
অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা মতে, ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কোনও ব্যক্তির তথ্য যদি নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ করে, এতে যদি কারও মানহানি ঘটে, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, তা হবে অপরাধ। এর শাস্তি ১৪ বছর কম কারাদণ্ড এবং অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানা। ২০০৬ সালে হওয়া ওই আইন ২০০৯ ও ২০১৩ সালে দুই দফা সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ সংশোধনে সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর থেকে ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান করা হয়। আর ৫৭ ধারার অপরাধকে করা হয় অজামিনযাগ্য।
এ ধারা থেকে বেরি হয়ে এসে তৈরি হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এটি তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্তরা বলছেন, ৫৭ ধারায় সব ধরনের অপরাধ একসঙ্গে নিয়ে এসে শাস্তির বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে সেটা আরেকটু স্পষ্ট করে ভিন্ন ভিন্ন শাস্তির বিধান রাখার ব্যবস্থা করা যায় কিনা ভাবা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত তৈরি হওয়ার খসড়ার ১৯ ধারার অনুযায়ী,
(১) কোন ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইট অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে দণ্ডবিধি ( ১৮৬০ সালের ৪৫ নম্বর আইন) এর ৪৯৯ ধারা মতে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মানহানি ঘটাইলে তাহা হইবে একটি অপরাধ।
(২) কোনও ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোনও ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কোনও কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা বা অশ্লীল এবং যাহা মানুষের মনকে বিকৃত ও দূষিত করে, মর্যাদাহানি ঘটায় বা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে তাহা হইলে ইহা হইবেএকটি অপরাধ।
(৩) কোনও ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় কোনও ব্যক্তির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানিবার অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনও ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্পচার করেন যাহা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পাঠ করিলে বা দেখিলে বা শুনিলে তাহার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে তাহা হইলে ইহা হইবে একটি অপরাধ।
ব্যতিক্রম: ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনও ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে প্রকৃত ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত বা ব্যবহৃত কোনও পুস্তক, লেখা, অংকন বা চিত্র অথবা যে কোনও উপাসনালয়ের উপর বা অভ্যন্তরে বা প্রতিমাসমূহ পরিবর্তনের জন্য ব্যবহৃত যে কোনও প্রকার খোদাইকৃত, মিনাকৃত, চিত্রিত বা প্রকারান্তরে প্রতিচিত্রিত অথবা কোনও ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত কল্পমূর্তির ক্ষেত্রে উপ-ধারা ৩ প্রযোজ্য হইবে না।
(৪) যদি কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১), (২) অথবা (৩)এর অধীন কোন অপরাধ সংঘটন করেন তাহা হইলে তিনি অনধিক ২ বছর কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ০২ (দুই) মাস কারাদণ্ডে বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিতে হইবেন।
প্রস্তাবিত আইনটির ২০ ধারায় বলা হয়, কোনও ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যা পড়লে, দেখলে বা শুনলে বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা বা ঘৃণার ভাব বর্ধন করে বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে, বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় তাহলে ওই ব্যক্তির অনধিক সাত বছরের কারাদণ্ড, অন্যূন এক বছরের কারাদণ্ড, বা সাত লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। ধারা-১৯-এ অপরাধের শাস্তি এক বছর থেকে দু্ই বছরের জেল। ধারা-১৯ জামিনযোগ্য হলেও ধারা-২০ জামিন অযোগ্য।
নতুন আইন আসছে সেখানে ৫৭ ধারার অস্তিত্ব থাকবে কিনা প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আজকের সভায় ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ নিয়ে যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, সেখানে অনেক কিছুই এসেছে। তবে চূড়ান্তটা জানতে আগামী আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ৫৭ ধারা যদিন আছে ততদিন মামলা হবে। আজকের আলোচনা থেকে একটা রূপরেখা করে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মধ্যে এনে আমরা আগামী অগাস্ট মাসে চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে বসব।
এদিকে, বেসিসের চেয়ারম্যান মোস্তফা জব্বার বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে ৫৭ ধারা অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। একই ধারা দুই আইনে থাকার দরকার নাই। নতুন আইনে আরও সুস্পষ্ট বিভাজন করে অপরাধগুলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে। লঘু ও গুরু অপরাধ একসঙ্গে একই ধারায় রাখলে একই রকমের সাজা হবে এটা কোনও যৌক্তিক কথা হতে পারে না। ৫৭ ধারার এই দিকটি পরিবর্তন করে ১৯ থেকে ২২ ধারার মধ্যে রাখার চিন্তা করা হচ্ছে। আজকের সভায় অনেক ধরনের আলোচনা হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে সেগুলো আবারও ঠিক ঠাক করে আগস্টের মাঝামাঝি এটি চূড়ান্ত হবে।’ তিনি আরও বলেন, চেষ্টা ছিল দুই আইন একসঙ্গে করার কিন্তু এতে কনফিউশন বাড়বে অনেকে মত দেওয়ায় দুটি পৃথক আইন রাখা হবে তবে তথ্য-প্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারা থাকবে না।