৮০ শতাংশ নারী স্বামীর হাতে নির্যাতিত হন
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নারী। বিরোধী দলের নেতা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন একজন নারী। দেশ স্বাধীনের পর সম্প্রতি প্রথম নারী নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন কবিতা খানম। এ ছাড়া দেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রী, এমপি, সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদ অলঙ্কৃত করছেন নারীরা। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপির দায়িত্ব পালন করছেন একজন নারী। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে নারীর অগ্রগতি বা উন্নয়ন হয়েছে ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। তবে ক্ষমতায়নের বিষয়টি এখনো সে পর্যায়ে পৌঁছেনি। এটি এখনো অনেকটা দুর্বল জায়গায় রয়ে গেছে। পরিবার বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও বেশ দুর্বল। অবশ্য এ ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। এ ছাড়া নারী ব্যাপকভাবে নির্যাতনের শিকার, সম্পদের ওপর তাদের অধিকার নেই বললেই চলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে রাজনীতি, অর্থনীতি, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ সার্বিক কর্মকা-ই পরিচালিত হচ্ছে তাদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। এর মাধ্যমে সমাজে কিছুটা পরিবর্তন হলেও নারী সমাজের মুক্তি মেলেনি সমাজের। তারা বলেন, আইনি সহায়তায় এখনো নারী অনেক পিছিয়ে। তা ছাড়া নতুন বাল্যবিবাহ আইন নারীদের অধিকার অনেকটা খর্ব করেছে। সময়ের সঙ্গে নারীদের নির্যাতন কমছে না, যা একটি নারীকে ওপরে ওঠার পথ রুদ্ধ করে দেয়। জেনেভাভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ‘বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদন ২০১৫’-এ বলা হয়, বিশ্বের ১৪৫টি দেশে নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে করা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪তম। এর আগে, ২০১৪ সালে ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ৬৮ নম্বরে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দুই ধাপ কমেছে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নের ওপর নির্ভর করছে উন্নত বাংলাদেশের স্বীকৃতি। নারীরা ক্ষমতার শীর্ষে যাচ্ছে। তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কাজ করা হচ্ছে। নারীদের অগ্রগতির যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে তা দূর করার জন্য এরই মধ্যে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। তিনি আরও বলেন, যেদিন রূপে-গুণে একজন নারীকে সমান মূল্যায়ন করা হবে সেদিন নারীর সমঅধিকার অর্জিত হবে। একই সঙ্গে নারীর সিদ্ধান্তকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। শিক্ষায় এগিয়ে নারী, উচ্চপদে পিছিয়ে : মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ সভায় ৫৭ সদস্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীসহ নারী ৫ জন। প্রশাসনের শীর্ষ সচিব পদে ৭২ জনের মধ্যে নারী মাত্র ৪ জন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, সরকারি চাকরিতে পদ আছে ১৪ লাখ ৭১ হাজার ৩৬টি। এর মধ্যে নারী আছে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৮০৪ জন।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করলে নারীদের অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও দারিদ্র্যের কারণে অনেক বাবা-মা আগেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। এ কারণে চাকরিতেও নারীর সংখ্যা কম। তা ছাড়া উচ্চপদে অনেক পুরুষ সহকর্মী নারীদের সেভাবে গ্রহণ করে না। তারপরও যেসব নারী উচ্চ পদে নিয়োগ পান অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নানা বাধার সম্মুখীন হন। এ কারণেই উচ্চ পদে নারীরা পিছিয়ে আছে।
বাল্যবিবাহ রোধ আইনের সমালোচনায় বিশেষজ্ঞরা : বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের খসড়ায় মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর রাখা হলেও বিশেষ বিধানের মাধ্যমে মেয়েশিশুর বিয়ের কথা বলা হয়েছে। এ নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে নানা আলোচনা, সমালোচনা শুরু হয়। দেশি ও বিদেশি নানা সংগঠনের ও নারীনেত্রীদের আপত্তি ও প্রতিবাদের মুখেই সরকার বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ বিল পাস করে ২৭ ফেব্রুয়ারি। বিলটি পাস করার সাতদিনের মাথায় আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এটি সংবিধানের ৭, ১১, ১৫, ২৬, ২৭, ৩১ এই ধারাগুলোর পরিপন্থী বলে আইনটি বাতিল চাওয়া হয়েছে। এ নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ নোটিশ দিয়েছেন সরকারকে। সেই সঙ্গে আইন বাতিল করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, ১৯২৯ সালে যে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে সেই আইনকে যুগোপযোগী করার জন্য ২০১৪ সালে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আইনটি কীভাবে যুগোপযোগী করা যায় তার জন্য সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় বসেছি, সুপারিশ দিয়েছি। কিন্তু আইনটি পাসের পর বিস্মিত হয়েছি। যে বিশেষ বিধান রেখে আইনটি পাস হয়েছে তা এর মূল গতিকে নষ্ট করে ফেলবে। যারা নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী নয়, ধর্ষক শ্রেণি এই আইনের সুযোগ নেবে, ফলে নারীরা আরও নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হবে। একই সঙ্গে আইনটি সব আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।
চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি ফোরামের পক্ষ থেকে লায়লা খন্দকার বলেন, ১৮-এর নিচে যে কেউ শিশু। এ আইনে বেশকিছু বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়, যেগুলো আমাদের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে। এ আইনে শিশুর মতামতের কথা বলা হয়নি, এ আইনে বিশেষ বিধান কী সেই বিষয়েও কোনো কিছু উল্লেখ নেই, যা স্পষ্ট করা প্রয়োজন।
এখনো ৮০ শতাংশ নারী স্বামীর হাতে নির্যাতিত : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১৫’ শীর্ষক দ্বিতীয় জরিপে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিবাহিত নারীদের ৮০ দশমিক ২ শতাংশ জীবনের কোনো না কোনো সময় স্বামীর হাতে কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার। ২০১১ সালে প্রথম এ বিষয়ে একটি জরিপ করা হয়। তখন এ নির্যাতনের মাত্রা ছিল ৮৭ দশমিক ১ শতাংশ। এখানে বলা হয়েছে, গ্রামে ও শহরে স্বামীর নির্যাতনের শিকার হলেও ৭২ দশমিক ৭ শতাংশ নারী তাদের ওপর নির্যাতনের কথা কখনই প্রকাশ করেননি। নির্যাতনের পর আইনি সহায়তা নিয়েছেন মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ নারী। এর মধ্যেও সালিশ ব্যবস্থা প্রাধান্য পেয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, নির্যাতনের কথা প্রকাশ করার সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। তবে এ নির্যাতনের মাত্রার জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি যথাযথ না হওয়ার কারণ হিসেবে মনে করেন তিনি। দেশে আইনের অভাব নেই, কিন্তু আইনের প্রচার ও যথাযথ প্রয়োগ নেই।