ফাহিমা আক্তার সুমি- দুপুর সোয়া তিনটা। ৯৯৯-এর কল সেন্টারে এক নারীর ফোন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত। আমি আর বাঁচতে চাই না। অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়েছি। আমার মৃত্যুর পর যেন মরদেহ ময়নাতদন্ত করা না হয়। জরুরি সেবা থেকে তাকে সংযোগে রেখে বুঝানো হয়। এরপর ওই নারীর ঠিকানা নিয়ে নওগাঁ থানায় বিষয়টি জানিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। থানা থেকে ঘটনাস্থলে একটি দল যায়। সেখানে একটি বাড়ি থেকে তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সূত্র জানায়, ওই নারী বিভিন্ন কারণে হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। ৬ই জুলাই নওগাঁ থেকে আত্মহত্যার প্রচেষ্টায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে ৯৯৯-এ ফোন দেন। তার অনুরোধ ছিল মৃত্যুর পর যেন তার মরদেহ ময়নাতদন্ত করা না হয়। হতাশাগ্রস্ত ওই নারীকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করে তার ঠিকানা নেয়া হয়। তাকে উদ্ধারের জন্য সহায়তা পাঠানো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
প্রথমে তিনি ঠিকানা জানাতে চাননি। ঠিকানা জানার পর তাৎক্ষণিকভাবে নওগাঁ সদর থানায় বিষয়টি জানিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়। পরবর্তীতে ৯৯৯-এর পক্ষ থেকে নওগাঁ থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে উদ্ধার তৎপরতার আপডেট নেয়া হয়। জাতীয় জরুরি সেবার তথ্যনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১২ই ডিসেম্বর জাতীয় জরুরি সেবার যাত্রা শুরু হয়। শুরু থেকে ২০২২ সালের ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত মোট ফোন এসেছে চার কোটি ৪ লাখ ২১ হাজার ৪৩৫টি। এরমধ্যে দুই কোটি ৩৯ লাখ ৪৯ হাজার ২৮৪টি অপ্রয়োজনীয় ফোন (৫৯.২৫ শতাংশ)। কথা না বলে চুপ করে থাকা ফোনের সংখ্যা (ভুতুড়ে) এক কোটি ৭৬ লাখ ২৮ হাজার ১০৬টি। ফোন করে দুষ্টমি বা উল্টাপাল্টা কথা বলেছে ২২ লাখ ৫০ হাজার ৯১৭টি। ৪০ লাখ ৭০ হাজার ২৬১টি মিসড কলের সংখ্যা। জরুরি সেবার জন্য ফোন এসেছে ৯ লাখ ৪৬ হাজার ১৮টি।
এরমধ্যে সেবা চেয়ে ফোন দিয়েছে ৬৯ লাখ ৮১ হাজার ১১৪টি, নারীদের ফোনের সংখ্যা ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৯৫৮টি এবং শিশুদের ৮ লাখ ৭৬ হাজার ৪৩০টি ফোন কল। এরমধ্যে জরুরি প্রয়োজনে পুলিশি সেবায় ফোন আসে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৫১৩টি, আগুনের ঘটনায় ৮৫ হাজার ৫০৮ এবং এম্বুলেন্স সেবা পেতে ১ লাখ ৯৯৭টি। ৯৯৯ দেশের যেকোনো জায়গায় চব্বিশ ঘণ্টা নাগরিকের জরুরি মুহূর্তে ও প্রয়োজনে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও এম্বুলেন্স সেবা প্রদানে সবসময় প্রস্তুত থাকে। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টায় তিন শিফটে কাজ করছেন সাড়ে চারশত জন কর্মী। এখন একসঙ্গে ফোনদাতাদের ১০০টি ফোন গ্রহণ করতে পারে সংস্থাটি। ৯৯৯-এর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ফোনদাতাদের কল গ্রহণ করছিলেন এক পুলিশ সদস্য। তিনি বলেন, সকাল থেকে বেশির ভাগ ফোন এসেছে মারামারি ও জায়গা-জমি সংক্রান্ত। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ১৫০টি ফোন রিসিভ করেছি। এরমধ্যে ৬টি পেয়েছি জরুরি। বাকিগুলো অপ্রয়োজনীয়। শিশু বা অন্যরা ফোন দিয়ে আজেবাজে কথা বলেন।
অনেকে ফোন দিয়ে সেবা না চেয়ে চুপ করে থাকেন। অনেক সময় মিসড কল দিয়ে কেটে দেয়। এই ফোনগুলো পেলে খুবই খারাপ লাগে। মাথায় একটা বাড়তি চাপের সৃষ্টি হয়। তারপরেও সেবামূলক এই কাজটিকে খুব উপভোগ করি। ১৫০টি ফোনের মধ্যে যদি ছয়জনকে আমরা সেবা দিতে পারি আর বাকিগুলো অপ্রয়োজনীয় হয় তাহলে মাঝে মাঝে খারাপই লাগে। তারা ফোন দিয়ে তাদের সমস্যার কথা বলুক। আমরা তো তাদের সেবা দিতে সবসময় প্রস্তুত। অনেক সময় এই অযাচিত ফোনের জন্য বাকিরা জরুরি প্রয়োজনে ফোন দিয়ে আমাদের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারেন না। লাইন ব্যস্ত দেখায়। অনেক সময় শিশুরা ফোন করে চেঁচামেচি করে। অনেকে আবার মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিব্রত করে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর গণমাধ্যম ও জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রশিক্ষক পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার মানবজমিনকে বলেন, ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ২২-২৩ হাজার ফোন আসে।
প্রতিদিন অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অনেক সময় ফোনদাতার দেয়া ঠিকানায় গিয়ে কিছুই পাওয়া যায় না। দিনে ব্লাঙ্ক কল আসে (ভুতুড়ে) ২০ থেকে ৫০টা। মানুষ কিছু বিষয় নিয়ে বেশি ফোন করে। সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, পারিবারিক সহিংসতা, ধর্ষণ, মারামারি, এম্বুলেন্স, চুরি, আত্মহত্যা ও জায়গা জমি সংক্রান্ত। আমাদের কাছে সেবা না চেয়ে অযাচিত যে ফোন আসে তাতে আমরা বিরক্ত হচ্ছি সেটি নয়, তবে এটি আমাদের সেবাকে বিঘ্নিত করছে সেটির সন্দেহ নেই। যখন এই ফোনগুলো রিসিভ করা হয় তখন লাইন ব্যস্ত থাকে। এই সময়টাতে তো অগ্নিকাণ্ড বা অনেক বড় কোনো ঘটনা ঘটতে পারে। তাদেরকে আমরা এই মুহূর্তে সেবা দিবো কীভাবে? ফোন করে সেবা না চেয়ে উল্টাপাল্টা কথা ও গালাগাল করে এটাও কিন্তু বিভ্রান্তকর। তিনি আরও বলেন, প্রথম দিকে এই ধরনের অযাচিত কলের সংখ্যা আরও অনেক বেশি ছিল। এখন কিছুটা কমেছে। এই বিষয়ে সবার সচেতনতা দরকার। প্রতিদিন অনেক শিশু ফোন দিয়ে চেঁচামেচি করে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া উচিত।
কেউ ফোনের রিচার্জ কোথায় করবেন সেটা জানতেও ফোন দেন। আবার অনেকে সিগারেট ফুরিয়ে গেলে ফোন দিচ্ছেন। একটার পর একটা মিসড কল দেয়ার সংখ্যাও অনেক। একই নম্বর থেকে একাধিকবার ফোন আসলে তাদের কিছুদিনের জন্য ব্লক করে রাখা হয়। এরআগে তাদেরকে মেসেজ দিয়ে সতর্ক করা হয়। এই ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা এবং ছয় মাসের কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। এই সেবাটিতে শুধু জরুরি প্রয়োজনে ফোন করবেন। জরুরি সেবা দেয়ার পাশাপাশি আমরা অনেক ফোনদাতাকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শও দিয়ে থাকি যেগুলো জরুরি সেবার মধ্যে পড়ে না। সেবাটির সঙ্গে এখনো অটোমেটিক লোকেশন সিস্টেমটি সংযুক্ত হয়নি। এটি সংযুক্তির কাজ চলছে। যদি আমরা এটি পেয়ে যাই তাহলে অপ্রয়োজনীয় কলের সংখ্যা আরও কমে আসবে। অটোমেটিক কলার লোকেশনের মাধ্যমে কল দাতার অবস্থান জানতে পারলে আমাদের সেবা দিতে আরও সুবিধা হবে। অযাচিত কল দিতেও মানুষ একবার ভাববেন, সচেতন হবেন। এই বিষয়ে গণমাধ্যমেরও বড় ভূমিকা রয়েছে।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১৫৩ বার