বার্তাডেক্সঃ ২৪ ঘণ্টায় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সিরিজ বৈঠক করে গেছেন বহুল আলোচিত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। রোববার রাতে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময় হয়েছে বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ এবং শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে। সর্বত্রই মানুষের ‘অধিকার’ নিয়ে আলোচনা করে গেছেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডোনাল্ড লু। আলোচনায় ঘুরেফিরে এসেছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সুশাসন এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গ। এখানে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র, যাতে মানুষের আকাক্সক্ষার সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটে। কূটনৈতিক সূত্র এটা নিশ্চিত করেছে যে, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এমন আলোচনা হয়েছে। অবশ্য ঢাকার তরফে মার্কিন মন্ত্রীকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার আন্তরিক বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাবের ওপর বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, জিএসপি পুনর্বহাল এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিকে ফেরতের বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে।
মার্কিন মন্ত্রীর ভাষ্য মতে, দুই পক্ষের মধ্যে সততার সঙ্গে অত্যন্ত খোলামেলা কথা হয়েছে। আলোচনার বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গভীরতা বুঝাতে ডোনাল্ড লু ‘অনেস্ট’ এবং ‘ওপেন’ এই দুটি শব্দ ব্যবহার করেছেন। সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন এবং পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে লু বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের মধ্যে ‘অনেস্ট’ এবং ‘ওপেন’ আলোচনা হয়েছে।
গণতন্ত্র এবং সর্বজনীন মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জানিয়ে ব্রিফিংয়ে দেয়া সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, দুটি বিষয়ের অবস্থান মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। তাই এ নিয়ে বিশ্বের যেখানেই সমস্যা সেখানেই যুক্তরাষ্ট্র কথা বলে, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারদের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসন খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে উন্মুখ হয়ে আছে জানিয়ে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মুক্তভাবে মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা এবং এক বা সম্মিলিতভাবে মতামত, আইডিয়া কিংবা চিন্তা জনসমক্ষে শেয়ার করার স্বাধীনতার পক্ষেই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান।
সংবাদ ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবের বক্তব্যের মাঝামাঝিতে সালাম দিয়ে শুরু করা বক্তব্যে ডোনাল্ড লু বাংলায় বলেন, মনোমুগ্ধকর নদীমাতৃক এবং অতিথিপরায়ণ মানুষের দেশ বাংলাদেশে আসতে পেরে আমি আনন্দিত। আমি এখানে এসেছি, আমাদের দুই দেশের বন্ধুত্বকে শক্তিশালী করতে, যখন বিশ্ব শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে লু বলেন, আমরা খুবই গর্বিত, আমরা আজ শ্রম অধিকার নিয়েও কথা বলেছি। বাংলাদেশের মানুষ ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। আমরা এ দেশে শ্রম অধিকার উন্নয়নে সহযোগিতা করবো। ব্রিফিংয়ে মার্কিন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু আমাদের বন্ধু সে কারণে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আমরা কীভাবে আরও অর্থবহ করতে পারি তা নিয়ে আলোচনা করেছি। এ ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে ভালো ও যৌক্তিক পরামর্শ পেলে আমরা অবশ্যই গ্রহণ করবো। আমাদের কোথাও দুর্বলতা চিহ্নিত হলে আমরা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবো। তাদের পরামর্শ যে আমরা গ্রহণ করি তার নমুনা দেখিয়েছি।
একটি স্বচ্ছ, সুন্দর এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী মোমেন বলেন, ভালো নির্বাচন আমরাও চাই। আওয়ামী লীগ সব সময় ভালো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। আওয়ামী লীগ ভোটের মাধ্যমে সরকারে এসেছে কখনো বুলেটের মাধ্যমে আসেনি মন্তব্য করে মোমেন বলেন, জনরায়ের প্রতি আমাদের বিশ্বাস আছে। বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনার দাবি করে তিনি বলেন, যেহেতু আমরা বন্ধু, তাই আমরা খোলামেলা আলোচনা করেছি। মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ শান্তি চায়। তার ভাষ্যটি ছিল এমন ‘আমরা শান্তি চাই। বিশ্বের সব জায়গায় শান্তি যাতে প্রতিষ্ঠিত হয় সে জন্য আমরা অগ্রণী ভূমিকায় থাকি।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। কীভাবে সামনের ৫০ বছর সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি তা নিয়ে হয়েছে।
ব্রিফিংয়ে দেয়া সূচনা বক্তব্যে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, আমাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। উল্লেখ্য, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন ছাড়াও সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি’র সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেন ডোনাল্ড লু। সচিব বলেন, আমি নিজেও তার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছি। যেখানে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শ্রম-পরিস্থিতি, নিষেধাজ্ঞা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, সহযোগিতা, ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা নিয়ে কথা হয়েছে। গত বছরের মতো এবারও আমাদের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, আমরা একটি সময়সূচি ধরে চলমান মেকানিজমের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্পর্ককে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করবো। আমাদের যে সম্পদ ও প্রক্রিয়া আছে, সেগুলো ব্যবহার করে সম্পর্ককে পরের ধাপে উন্নীত করবো। এদিকে, ডোনাল্ড লু তার বাংলাদেশ সফরে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে আলাদা সাক্ষাৎ করেন।
র্যাব সংস্কার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমায় সন্তোষ
এদিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর র্যাব সংস্কারে অভূতপূর্ব উন্নতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে ডোনাল্ড লু বলেন, এতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা নেমে এসেছে আশাতীত ভাবে। র্যাব প্রসঙ্গে আমাদের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। গত সপ্তাহের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে চিহ্নিত করা হয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে অসামান্য উন্নতি হয়েছে। এটা খুবই ভালো কাজ। এ উন্নতির কথা আমরাও স্বীকার করছি। এটা প্রমাণিত হয়, র্যাব সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও আইন প্রয়োগের দায়িত্ব মানবাধিকার রক্ষা করেই করতে পারবে। এ সময় অপর এক প্রশ্নের জবাবে জিএসপি ফেরতে যে সব শর্ত রয়েছে তা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র নিবিড়ভাবে কাজ করছে জানিয়ে লু বলেন, এই তালিকার অনুমোদন পেলে প্রথম দেশ হবে বাংলাদেশ। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস) নিয়ে চমৎকার আলোচনা হয়েছে জানিয়ে ডোনাল্ড লু বলেন, এটি কোনো ক্লাব নয় বরং একটি কৌশল। যা আমরা বাংলাদেশকে শেয়ার করেছি।
সবার রাজনীতি করার অধিকার আছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
এদিকে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র সঙ্গে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক হয়। সেখানে মার্কিন অতিথির সম্মানে পররাষ্ট্র সচিব একটি ভোজের আয়োজন করেন। ওই ভোজসভায় সরকারি কর্মকর্তারা ছাড়াও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। নির্বাচন এবং বিএনপি’র রাজনীতি নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ১০ই ডিসেম্বর আমরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের (বিএনপি) সমাবেশের ব্যবস্থা করে দিয়েছি, এজন্য যুক্তরাষ্ট্র খুশি। তারা বলেছে, সবার রাজনীতি করার অধিকার আছে। আমরা বলেছি, আমরা সেটা মানি। সেজন্য তারা (বিএনপি) শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি করছে। সেগুলোতে আমাদের কোনো বাধা নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা (যুক্তরাষ্ট্র) যদি জনগণের সম্পদ নষ্ট করে, ফায়ার ওপেন করে; কিংবা রাস্তাঘাট বন্ধ করে তখন আমরা তাদের নিষেধ করি। অন্যথায় তারা (বিএনপি) ফ্রি। তারা রাজনৈতিক দল। তারা মতপ্রকাশ করতে পারে। তারা (বিএনপি) ১০ তারিখে করেছে, কিছুদিন আগেও করেছে এবং সবার জন্য এটা ফ্রি আছে। র্যাবের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আসাদুজ্জামান খান বলেন, তারা বলেছে, এটা তাদের দেশে একটা জটিল প্রক্রিয়া। এটা একটু সময় নিতে পারে। তবে তোমরা যে প্রক্রিয়ায় অ্যাডভান্স হচ্ছি, আমার মনে হয় এটা ভবিষ্যতে ক্লিয়ার হয়ে যাবে। এ একটা ইঙ্গিত দিয়েছে। কবে নাগাদ নিষেধাজ্ঞা উঠতে পারে- এ বিষয়ে কোনো বার্তা আছে কি-না? জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, টাইম ফ্রেম দেয়নি। তবে প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করতে হবে। আমার মনে হয়, আমরা সঠিক পথে আছি। তারা বলেছে, তোমরা যে পথে এগোচ্ছে সেটাই সত্যিকারের পথ। র্যাবের সংস্কার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি দাবি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা (যুক্তরাষ্ট্র) আমাদের বর্তমান কর্মকাণ্ডে খুশি। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে কাজ করছে, এটা নিয়ে তারা সন্তুষ্ট। তারা (যুক্তরাষ্ট্র) বলেছে, অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তারা চায় এ অগ্রগতি যেন সবসময় থাকে। নির্বাচন বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা আগেই বলে দিয়েছি, প্রধানমন্ত্রী চাচ্ছেন একটা সুষ্ঠু নির্বাচন। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রী কাউকে বাধা দিচ্ছেন না মতামত প্রকাশ করার জন্য। তারপরেও নির্বাচনের তিন মাস আগে সিকিউরিটি ফোর্স নির্বাচন কমিশনের কাছে চলে যাবে। তারাই সবকিছু কন্ট্রোল করবে। তার আগ পর্যন্ত যেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকে প্রধানমন্ত্রী আমাদের সে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১০৫ বার