প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে আ’লীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের শেষ জীবন
লুৎফর রহমান সোহাগ-
উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস এ দলটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর এই দলটির জন্মকালীন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। স্বাধীন বাংলাদেশে যার নাম বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে গেছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই বঙ্গ অঞ্চলের তুমুল জনপ্রিয় এই নেতা পাকিস্তান আমলেও ছিলেন প্রধান সারির বিরোধীদলীয় নেতা। একদিকে শাসক গোষ্ঠীর নিপীড়ন, অন্যদিকে নিজ হাতে গড়া সংগঠনের ‘ষড়যন্ত্রে’ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। এরপর একদশক জীবনযন্ত্রণা ভোগ করা শামসুল হকের শেষযাত্রাও হয় জন্মস্থান টাঙ্গাইলে। তবে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলায় ১৯১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করা শামসুল হকের মৃত্যুর তথ্যও ৪ দশকের বেশি সময় অজানা ছিল।
আওয়ামী মুসলিম লীগের (বর্তমানে আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের রাজনৈতিক বিকাশ ঘটে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের ১৫০ নং মোগলটুলীর কর্মী শিবিরে। ১৯৪৪ সালের ৯ এপ্রিল স্থাপন করা মুসলিম লীগের ওই কর্মী-শিবিরকে নেতৃত্ব দিয়ে দুই বছরের মধ্যেই জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন শামসুল হক। ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষে কেবল বাংলায়ই মুসলিম লীগ একক সরকার গঠন করে; যা ভূমিকা রেখেছিল ভারত ভাগে। এছাড়াও ভারত ভাগের সময় জামায়াতে উলামায়ে হিন্দের প্রবল বিরোধীতার মুখেও এই কর্মী-শিবিরের ভূমিকাতেই গণভোটে সিলেট পাকিস্তানভুক্ত হয়েছিল।
তবে নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কমিটির দুই প্রধান সদস্য নুরুল আমীন ও ইউসুফ আলি চৌধুরী মুসলিম লীগকে নিজেদের পকেট সংগঠন বানিয়ে ফেলেন। এর ফলে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন-২৪ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের কর্মী সম্মেলনে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যাত্রা শুরু হয়। যার সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক। ভাষা আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালনের জন্য ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পূর্ব বাংলাজুড়ে পালিত ছাত্র ধর্মঘটে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষের পর গ্রেফতার হন তিনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের পরও একই কারণে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন এই নেতা।
ভাষা আন্দোলনে শামসুল হকের ভূমিকা ও কারাবরণের বিষয়টি ওঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেও। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘শামসুল হক সাহেবের সাথে জিন্নাহর একটু তর্ক হয়েছিল, যখন তিনি দেখা করতে যান বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার বিষয় নিয়ে। শামসুল হক সাহেব আমাকে এসে বলেছিলেন।শামসুল হক সাহেবের সৎ সাহস ছিল, সত্য কথা বলতে কাউকেও ভয় পেতেন না।’ সেই শামসুল হক ১৯৫৩ সালে মানসিক ব্যাধি ও অসুস্থ শরীর নিয়ে কারামুক্তি লাভ করলেও একই বছরই দলের ‘অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে’ আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত হন; যার ফলে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মানসিক ভারসাম্যহীন হয়েই ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন তিনি, এরপরই নিখোঁজ হয়ে যান; পরবর্তী ৪ দশকেও যার কোন হদিস মেলেনি।
সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীন ‘আত্মস্মৃতি : সংগ্রাম ও জয়’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাকে (শামসুল হককে) আটক করা হয়। তখন তিনি বিবাহিত, একটি কন্যা সন্তানের পিতা। স্ত্রী নরসিংদীর সেকান্দার মাস্টার সাহেবের কন্যা আফিয়া খাতুন এমএ কলেজের লেকচারার। জেলখানায় শামসুল হকের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। নিজ পরিবারের প্রতি তাঁর মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। আফিয়া খাতুন তাঁকে ত্যাগ করেন। আফিয়া এখন পাকিস্তানে মিসেস আফিয়া দিল।
‘শামসুল হক সম্পূর্ণ বিকৃতমস্তিষ্ক অবস্থায় জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শামসুল হকের চিকিৎসায় আওয়ামী মুসলিম লীগ কোনো উদ্যোগ নিয়েছিল বলেও মনে পড়ে না। শামসুল হক ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন- কখনও বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে টাকা ধার চাইতেন, কেউ সমাদর করলে আহার করতেন।’
‘টাঙ্গাইলের ওয়ার্টারলু বিজয়ী শামসুল হকের মৃত্যু কোথায় কি অবস্থায় হলো তার কোনো বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে দেখিনি। শোকসভাও করেনি কোনো রাজনৈতিক দল বা অন্যরা। অথচ এই শামসুল হক একদিন ছিলেন বাংলার তরুণ মুসলিম ছাত্রসমাজের প্রিয় নেতা- ১৯৫২ সালেও ভাষাসংগ্রামী এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক।’
দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগ থেকে তার বহিষ্কার, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নিখোঁজ হওয়া ও মৃত্যু রহস্য হয়েই ছিল। এর মধ্যেই ২০০৭ সালে টাঙ্গাইলের কালিহাতির কদিম হামজানিতে তার কবর আবিষ্কার হয়। একইসাথে জোকারচরের জনপ্রিয় কংগ্রেস নেতা মহিউদ্দীন আনসারির বাড়িতে তার মৃত্যুর বিষয়টি প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রয়াত মহিউদ্দীন আনসারীর নাতি সেলিম আনসারী জানান, ১৯৬৫ সালে শামসুল হক তাদের বাড়িতেই মারা যান। তিনি জানান, বিপরীতমুখী রাজনীতি করলেও ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝিতে তার দাদা মহিউদ্দিন আনসারী কলকাতা থেকে বাড়ি ফেরার পথে কোথাও থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যন্ত অসুস্থ বন্ধু শামসুল হককে দেখে বাড়িতে নিয়ে আসেন।
কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে শামসুল হকের তথ্য গোপনই থেকে যায়। শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া এই নেতা ‘পাগলের মত’ জীবনযাপন করতেন। একসময়ের তীব্র জনপ্রিয় নেতা সামনে থাকলেও তাকে কেউই চিনতে পারেননি, এমনকি তার মৃত্যুও সেই রহস্য ভেদ করতে পারেনি। বর্তমানে স্থানীয় শ্রমিক লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত সেলিম আনসারী বলেন, ‘আমাদের বয়স তখন ৭-৮ বছর হবে। তিনি বেশ কিছুদিন আমাদের বাড়িতে ছিলেন, ৪-৫ মাস হবে। একসময় প্রচন্ড জ্বরে তিনি মারা যান।’ আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেসের বিপরীতমুখী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই বিতর্ক এড়াতে শামসুল হকের মৃত্যুর ঘটনা গোপন করা হয়েছিল বলে জানান তিনি।
সেলিম আনসারী বলেন, ‘আমরা তো তখন ছোট, তিনি যে শামসুল হক সেটা বুঝতে পারি নাই। আমাদের বাড়িতে অনেক নেতা থাকতেন, অনেক ফকির থাকতো সবসময়। পরে বুঝতে পেরেছি যে, তিনি সেই বিখ্যাত নেতা ছিলেন। শুধু আমরা না, এলাকার কেউই তাকে চিনতেন না।’ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও এই টাঙ্গাইলেই সাধারণ নির্বাচনে জমিদার কুরুম খান পন্নীকে পরাজিত করে সারা ভারতে আলোচনায় এসেছিলেন শামসুল হক। ১৯৪৯ সালে মওলানা ভাসানীর সংসদ সদস্যপদ বাতিল হওয়ার পর উপনির্বাচনে জমিদার খুররম খান পন্নীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন শামসুল হক খান, এটিই ছিল পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জনগণের প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ।
এই জনপ্রিয় নেতাকে তার জেলার মানুষরা চিনতে না পারার কারণ কি জানতে চাইলে সেলিম আনসারী বলেন, ‘তাকে কেউ চিনতো না, কারণ তিনি যেভাবে একসময় টাঙ্গাইলে আসতেন, শেষ বয়সে তো সেভাবে ফেরেননি। দুই সময়ের অনেক তফাত ছিল। আগে যে পোশাক ছিল, সেই পোশাকও তো ছিল না।’ তিনি বলেন, ‘শেষে তো এসেছেন ছিন্ন পোশাকে, এক দাড়ি-টুপিওলা মানুষ। আমাদের বাসায় অনেক পাগল থাকতো, সবাই মনে করতো তিনিও এমন একজন পাগল। পুরো ছদ্মবেশ যেটাকে বলে, বলতে পারেন সেটি তেমনি ছিল।’ রাজনৈতিক কারণে মহিউদ্দীন আনসারীও তার পরিচয় গোপন রাখতেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দাদা তার (শামসুল হক) পরিচয় প্রকাশ করতেন না। আমাদের সাথেও শেয়ার করতেন না।’ ২০০৭ সালে বিষয়টি জানাজানির পর কোনো রাজনৈতিক দল বা অন্য কোনো সংগঠন শামসুল হকের বিষয়ে তাদের কাছে তথ্য জানতে চেয়েছে কিনা জানতে চাইলে সেলিম আনসারী বলেন, ‘না, কেউই তার খোঁজ নিতে যোগাযোগ করেনি।’