পুরুষ যে নির্যাতিত, সেও পুরুষতন্ত্রেরই ফাঁদ
বেশ কিছু বছর থেকেই শুনছি, নারীদের আলাদা দিবস কেনো লাগবে? পুরুষরাও নির্যাতিত, পুরুষদের দিবস নেই কেনো? লেখা বাহুল্য, এসব কথা নারীদিবসকে ঘিরেই বেশি শোনা যায়। এসব কথা একদল মানুষ ঠাট্টা করে বলেন, আরেকদল মানুষ এই ঠাট্টাকে আক্রমণ ভেবে উড়িয়ে দেন। বিশেষ করে বেশিরভাগ নারীই মনে করেন পুরুষরা নির্যাতিত হন না। আসলেই কি তাই? পুরুষরা কি নির্যাতিত হন না? বাহ্যিকভাবে হয়তো পুরুষদের নির্যাতন চোখে পড়ে না। কিন্তু একটু নির্মোহ হতে পারলেই দেখবো, পুরুষতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাতা ফাঁদে পুরুষ ভয়াবহভাবে নির্যাতিত। আফসোস, সেই নির্যাতন নিয়ে কথা বলার অধিকারও সে রাখে না। অনেক ক্ষেত্রেই সে বোঝেও না।
পুরুষ জন্ম থেকেই নির্যাতিত। আমি জেনে-বুঝে এই মন্তব্য করছি। পার্থক্য শুধু এই যে তার নির্যাতনের স্বীকৃতি সমাজ-সংসার, এমনকি তার নিজের কাছেও নেই। তার নির্যাতনের ফাঁদকেই সে পৌরুষত্ব জেনে বড় হয়। পুরুষের জন্ম হয় বংশের বাতি দেবার জন্য, অর্থাৎ তার জন্ম হয়ই কিছু দায়িত্ব পালনের জন্য। সেই দায়িত্ব পালনের জন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণিভেদে তাকে তৈরি হতে হয় শৈশব থেকে। অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়েকে সংসারের কাজ না করলেও চলে, অন্তত বিয়ের আগ পর্যন্ত। কিন্তু বর্গা চাষির ছেলেই হোক, কিংবা রাজপুত্রই হোক, বংশের বাতি জ্বালানোর জন্য তাকে ‘উপযুক্ত’ করে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া জন্মের পর থেকেই শুরু হয়। বর্গা চাষির ছেলে হলে বাবার সাথে মাঠে যেতে হয়, গরু সামলাতে হয়, আর রাজপুত্র হলে অস্ত্রশিক্ষা, গুরুগৃহ- নানা কিছু শিখতে হয় শুধু না, একটা ছকে বাঁধা নিয়মে শিখতে হয়। উৎকর্ষ অর্জন করতে হয়। বাচ্চা ছেলে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলেও কাঁদা বারণ। ছেলেরা আবার কাঁদে না কি? অতএব, ব্যথা পেয়ে ছেলে তুমি হাসো। ছেলে তুমি খেলায় চ্যাম্পিয়ন হও, পাহাড়ে যাও, পড়াশুনায় শ্রেষ্ঠ হও। তুমি চাও বা না চাও। আর যদি খেলাধুলা ভালো না লাগে, তবে তো শৈশবেই ছাপ্পা পড়ে গেলো চরিত্রে, ‘ম্যাদা মার্কা’, ‘মেনিমুখা ছেলে’।
রবীন্দ্রনাথের ‘গিন্নী’ গল্পটা পড়া আছে নিশ্চয়ই। প্রাইমারির এক ছেলে বোনের সাথে নিজের বাসার দাওয়ায় বসে রান্নাবাটি খেলেছিলো বলে পণ্ডিত মশায় ছেলেটিকে পরদিন ক্লাসে সবার সামনে কী নাস্তানাবুদই করেছিলেন! বংশের বাতি দেবার উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য তাকে আবেগশূন্যভাবে তৈরি করা হয়। শরিকের বিবাদ, ব্যবসার চাতুরি, নির্দয়ভাবে ভালো ফলাফলের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে এক ছাঁচে ফেলা পুরুষ মানুষে রূপান্তরের কাজ চলে পুরুষতান্ত্রিক কারখানায়। আমার মনে আছে, আমার এক প্রাক্তন সহকর্মীর বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম তার ছোটভাই মনের সুখে চাকু দিয়ে কচি আম, লতাপাতা কেটে কুচি কুচি করে রান্নাবাটি খেলছে আর বাসার মা, বোন ভীষণ লজ্জিত ছেলে বা ভাইয়ের আচরণে। সারাক্ষণ তাকে এহেনো মেয়ে-সুলভ কাজের জন্য বকা দেয়া হচ্ছে। এমনকি মা-বাবা মারা গেলেও ছেলের কান্না প্রত্যাশিত না, কারণ সেটা পুরুষসুলভ আচরণ নয়। ফলে, কোন ছেলের মধ্যে যদি আবেগের তোড় এসেও যায়, সে সেই আবেগ যেনো প্রকাশিত না হয়ে পড়ে সেই চাপ নিয়েই বড় হয়। আবেগের স্বাভাবিক প্রকাশ তাকে চেপে রাখতে হয়।
স্কুলে গিয়ে পুরুষ হবার তরিকা হিসেবে তাকে শিখতে হয় সিগারেট খাওয়া, মেয়েদের স্কুলের সামনে গিয়ে বা মেয়েদের স্কুলে যাবার পথে শিস দিয়ে তাদের বিরক্ত করা, বন্ধুদের সাথে মারামারি আর গালি দেবার প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা। এই যে চাপ, এই চাপের নীচে শান্ত-নিরীহ ছেলেটি যে কীভাবে পিষ্ট হয়, সে শুধু ভুক্তভোগী পরিবারই জানে। আমরা বাচ্চা মেয়েদের ধর্ষণের বিষয়টা জানি। কিন্তু বাচ্চা ছেলেরা যে কী পরিমাণ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, সে খবর আমরা ক’জন রাখি? পরিবার জানলেও ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, জানাজানি যেনো না হয়, সে বিষয়েও প্রবল সতর্কতা রাখা হয়। কারণ, পুরুষও যে নির্যাতিত, এই সত্য পুরুষতন্ত্র প্রকাশ করে না। করলে তার প্রবল ইমেজ আক্রান্ত হবে। নির্যাতিত তো কেবল নারীরই ইমেজ। ছেলে সন্তানের মার খেয়ে বিচার দেবার নিয়ম নেই পরিবারে, তাকে মার দিয়ে আসতে হয়। মানুষ হিসেবে স্বাভাবিক বিকাশই তার আর সম্ভব হয় না। তাকে পুরুষ হিসেবে প্রতি পদে প্রমাণ করতে হয় নিজেকে।
কোন পুরুষ চাকরি করবে না, আয়-উপার্জন করবে না, তাই আবার হয় না কি? তাকে অবশ্যই রোজগার করতে পারতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে পুরুষের বিয়েই হয় না যথেষ্ট রোজগেরে নয় বলে। যে ছেলে যথেষ্ট রোজগার করে না, তার আবার বিয়ে কি? গরীব পরিবারের কোন মেয়ের ‘চেহারা ভালো’ হলে দৈবক্রমে একটা ‘ভালো বিয়ে’ হয়ে যেতেও পারে, কিন্তু উপার্জনহীন কোন ছেলের বিয়ে হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ বিয়ের পরে ‘বউকে কী খাওয়াবে’- এই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিয়েই তাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে হয়। বিয়ের বাজারে যে যতো বিত্তবান, সে ততো সুন্দর পাত্রী পাবে, এ এক অবিসংবাদী রীতি। এই রীতি পুরুষেরই তৈরি। তার মেধা-মনন-অর্জন কিছুই এক্ষেত্রে তাকে বাঁচাতে পারে না।
পুরুষতন্ত্র নারীর জন্য সতীত্ব-সংস্কার তৈরি করেছে। হায়! এই তন্ত্রের পাহারাদার হতে গিয়ে সে বিসর্জন দিয়েছে নিজের আত্মবিশ্বাস আর শান্তি। যে স্ত্রীকে নিয়ে সে ঘর করে, তাকে সে বিশ্বাস করতে পারে না। সন্তানের বৈধতা নিশ্চিত করার জন্যই যতো আয়োজন। সে নিজের সংগীর কাছে আনুগত্য চাইলো, তাকে অবিশ্বাসের ঘেরাটোপে বন্দী করলো, সন্তানের পিতৃত্বও নিশ্চিত করলো, কিন্তু সে তো একটা ভালোবাসাময় জীবন চাইলো না! ভালোবাসার চেয়ে বংশের শুদ্ধ লতিকার পাহারাদার হয়েই তাকে জীবন কাটাতে হলো। ফলে সে ভয়ংকর হয়ে উঠলো নিজের স্ত্রী,সংগিনী তো বটেই বোন, মেয়ে, মায়ের উপর। যে অংশটুকু সে ঠকাতে চাইলো তার স্ত্রী এবং বোনকে, সেটাই বুমেরাং হয়ে ঠকালো তার আত্মজাকে, তার জন্মদাত্রী মাকে। অথচ সেই ভয়ংকর নিয়মকেই আবার তার অনুসরণও করতে হলো, করতে হয়- সিন্দবাদের দৈত্যের মতো। নিজের ঘরেই নিজে নিপীড়ক হয়ে থেকে গেলো নিজের মানুষদের উপরে, কেবল পুরুষতন্ত্রকে পাহারা দেবার জন্য। সে ক্ষমতা হয়তো পেলো খানিক, কিন্তু জীবন তো যাপন করতে পারলো না। সে পুরুষতন্ত্রের লাঠিয়াল হয়ে সম্পত্তি পাহারা দেয় আর ঠকায় নিজের বোন, মা, মেয়েকে, ঠকায় শরিকদের। তার জন্মই সেজন্য। বীর হবার জন্য সে যুদ্ধ করে। যুদ্ধ বাধায়। যে ঘর সে নির্মাণ করে, সেই ঘরের সে আসলে বাসিন্দা না, সেই ঘরের ত্রাস। সবাই তাকে ভয় করে। যে স্ত্রীকে সে দমন করে রাখে, সন্তান বড় হয়ে সেই অবদমিত স্ত্রীকেই আপন মনে করে সবচেয়ে। মা হিসেবে।
এখন আবার শুরু হয়েছে, নারীদের এগিয়ে যাবার পালা। ধরে-বেধে-মেরে-ঠকিয়েও তাদের আটকে রাখা যাচ্ছে না। যে ছাত্র ক্লাসে বলে ফেলে, মেয়েরা তো পড়াশুনা করে সময় কাটানোর জন্য। সেই মেয়ে প্রজাতিই এখন তাকে ক্লাসে পড়ায়, পরীক্ষার খাতা দেখে, প্রয়োজনে ক্লাস থেকে বের করে দেয়। গত পঞ্চাশ বছরে কতো পালটে গেলো মেয়েদের জীবন! আঙ্গুল কেটে ফেললেও পরীক্ষা দেয়, জজ-ব্যারিস্টার হয়। ঘরে-বাইরে মেয়েরা কাজ করছে। শাসন করছে। কী নির্যাতন! তাই রিকশায় জট বাধলে প্রধানমন্ত্রীকে নারীবাচক গালি দিয়েই থামতে হয়। এ বড় কম অত্যাচার নয়। শিক্ষায়-শাসনে-মেধায় মেয়েরা কতো এগোল, অথচ পুরুষতন্ত্রের কিছু হলুদ হয়ে যাওয়া বিধান থেকে পুরুষত্বের শ্রেষ্ঠত্বের ধারনা থেকে বেরোতে পারলো না পুরুষ, আর ধুঁকতে লাগলো, নিজেকে নির্যাতিত মনে করতে লাগলো ভুল প্রসঙ্গে- এই দোষ আমি ব্যক্তি পুরুষকে দেই না। দেই পুরুষতন্ত্রকে। পুরুষতন্ত্রের বিধান অগ্রাহ্য করে এখন নারী এগিয়ে যাচ্ছে। সে বুঝেছে, এই বিধান তার প্রতি নির্যাতনকে বৈধতা দেয়। তাই দেশের আইন-বিধান-অনুশাসন পুরুষতান্ত্রিক হলেও সে সেসবের তোয়াক্কা না করেই নিজের চলার বেগে পায়ের তলায় রাস্তা তৈরি করে নিচ্ছে।কিন্তু পুরুষ পুরুষতন্ত্রের বাতিল বিধানগুলোকে অগ্রাহ্য করে নিজের পথ খুঁজে নিতে পারছে না। একটা মোহের ভেতর এখনো ঘুরছে। অতীতকালে জমিদারী সময়ে ঘি দিয়ে ভাত খেয়েছিলো বলে, আঙ্গুলে এখনো সেই ঘি-এর গন্ধ শুঁকে খুশি থাকতে চাইছে। নিজেকে প্রতাপশালি ভাবছে এবং সেই ইমেজে যেনো কোন দাগ না পড়ে তার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা চালাচ্ছে।সেটা করতে গিয়ে পুরুষতন্ত্রের যাবতীয় কিল-চড়-অত্যাচার আজও হজম করে যাচ্ছে।
পুরুষের প্রতি যে নির্যাতন, সে পুরুষতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থারই তৈরি। এমনকি পুরুষ যদি তার স্ত্রীর কাজে সাহায্য করতেও চান, কারণ সকলেই নারী-নির্যাতক নয়, পুরুষতন্ত্রের বাধা ইমেজ সেখানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব, পূর্বপুরুষদের বংশ-লতিকা রক্ষার দায়িত্ব, সন্তানের প্রয়োজনে বিয়ে করা এবং স্ত্রীকে ভরণপোষণের দায়িত্ব, রোজগারের দায়িত্ব, সমাজের কাঙ্ক্ষিত পুরুষ হয়ে ওঠার দায়িত্ব, পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার দায়িত্ব, পরিবারের সম্মান বজায় রাখার দায়িত্ব- এতোসব দায়িত্বের অত্যাচারে বেচারি পুরুষ নিজের জীবন উদযাপন করার ফুরসত পায় না। এটাই হলো পুরুষতন্ত্রের ফাঁদে পুরুষের প্রকৃত অত্যাচারিত জীবনের স্বরূপ। সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে পুরুষ রুখে দাঁড়াবে, সে ইঙ্গিত এখনো দেখা যায় না। এমন কি যে স্ত্রীর অত্যাচারের অভিযোগ তারা করেন, সেই স্ত্রী যদি নিজে বিচ্ছেদ নিয়ে চলে যেতে চান, সেখানেও না কি তার পৌরুষের অপমান। পুরুষতন্ত্র তাকে এমনই শিখিয়েছে। বেচারা পুরুষ!
পুরুষতান্ত্রিক এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে পুরুষদের রুখে দাঁড়াবার সময় এসেছে। তারা বরং আন্দোলন করুক সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বিষয়ে, বিয়ে- বিচ্ছেদ-সন্তানের অভিভাবকত্বে সমানাধিকারের প্রসঙ্গে, মেয়ে-শিশু-ছেলে-শিশুর বৈষম্য রোধের লক্ষ্যে- চাপ অনেক কমে যাবে। এইসব দায়িত্ব যখন নারী-পুরুষ সমভাবে নিতে পারবেন, সত্যি, পুরুষদের নির্যাতন অনেক কমে যাবে।
আর সেজন্য যদি একটি দিবস প্রয়োজন হয়, সেই দিবসের পক্ষে আমি। পুরুষদের কেবল পুরুষ না, স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দাবি মৌলিক মানবাধিকারের দাবি। আমি আপনাদের আন্দোলনের সহযাত্রী। পুরুষতন্ত্র নিপাত যাক। পুরুষ মুক্তি পাক।
ড. কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sunamganjbarta.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sunamganjbarta.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।