তানভীর আহমেদ-

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অর্থসংস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান ফিন্যান্স ক্যাপিটাল ও করপোরেট হাউজের যুগে রাজনীতিতে অর্থসংস্থানের প্রয়োজন বেড়ে গেছে সে অর্থ তারা কিভাবে সংগ্রহ করেন, কিভাবে ব্যয় করেন তা জানার অধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের আছে। কিন্তু আমাদের দেশের জনগণ কিংবা দলের সমর্থক শুভানুধ্যায়ীরা এ বিষয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না। রাজনৈতিক দলগুলো প্রতি বছর নির্বাচন কমিশনের কাছে তাদের ব্যয়ের হিসাব বা বিবরণী দাখিল করেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের আয় দুই কোটি থেকে তিন কোটি টাকার বেশি দেখান না।

আওয়ামী লীগের দেয়া তথ্য অনুসারে দলটি ২০১৬ সালে মোট আয় করেছে ৪ কোটি ৮৪ লাখ ৩৪ হাাজর ৯৭ টাকা। ব্যয় করেছে ৩ কোটি ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭৯৯ টাকা। আয়-ব্যয়ের পার্থক্য ১ কোটি ৮২ লাখ ৪৯ হাজার ২৮৯ কোটি টাকার। ব্যাংকে জমা আছে ২৫ কোটি ৫৮ লাখ ১১ হাজার ৪৪১ টাকা। বিএনপির আয় ৪ কোটি ১৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭৩০ টাকা; ব্যয় ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬৩ হাজার ৮৫২ টাকা। উদ্বৃত্ত রয়েছে ১৪ লাখ ৪ হাজার ৮৭৮ টাকা।

তাদের আয়ের উৎস হলো সদস্যের চাঁদা দান-অনুদান। ধনী ব্যক্তি বা বড় ব্যবসায়ীদের দান বা ডোনেশন সাহায্য-সহযোগিতাকে আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে দেখানো হয়। বড় বড় বিজনেস হাউজগুলোও তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করে। তবে সেটা গোপন রাখা হয়। বহুজাতিক কোম্পানি বা বিদেশী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দান-অনুদান দেয়। সেগুলো হিসাবে আসে না।দলের মনোনয়নপত্র বিক্রি থেকে কিছু আয় হয়। দলীয় মনোনয়নের জন্য প্রার্থী থাকে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীরা মনোনয়ন পাওয়ার জন্য দলকে দান, অনুদান ও চাঁদা দিয়ে থাকেন।প্রবাসী কর্মী-সমর্থকেরা দলের নির্বাচন পরিচালনার জন্য চাঁদা ও অনুদান দিয়ে থাকেন। গ্রাম ও উপজেলাপর্যায়ে নেতাকর্মীরা ব্যবসায়ী দোকানদার ধনী কৃষক জোতদারদের কাছ থেকেও চাঁদা নেন। অনুদান গ্রহণ করেন। অনেক সময় জনগণের কাছ থেকেও চাঁদা নেয়া হয়।রাজনৈতিক দলগুলো পরিচালন ব্যয় ও অর্থসংস্থান নিয়ে খুব একটা কথা বলতে চান না। তবে দল পরিচালনায় ও অর্থসংস্থানের ক্ষেত্রে দলের ধনী ও পুঁজিপতি সদস্যরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

ব্যাংক পুঁজি বা লগ্নিপুঁজির সাথে শিল্প পুঁজির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ফিন্যান্স ক্যাপিটাল। পুঁজির কেন্দ্রীয় ভবনের সাথে সাথে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিবিদদের হাত থেকে পুঁজিপতিদের হাতে চলে গেছে। করপোরেট যুগে ফিন্যান্স পুঁজির দাপটে, ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিরা নিজেরাই নেতৃত্ব নিতে চান। আগে পুঁজিপতিরা রাজনীতিবিদদের অর্থের জোগান দিয়ে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু ফিন্যান্স পুঁজির যুগে পুঁজিপতিরা নিজেরাই নেতৃত্ব দিতে ও নেতা হতে চাচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচনে আমরা দেখলাম ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর বিরাট বিজয়। যুক্তরাষ্ট্রেও ব্যবসায়ীরা এখন সরাসরি রাজনীতিতে আসছেন এবং রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। ৩০ বছর আগে তা চিন্তাও করা যেত না। সে সময় ব্যবসায়ী ও পুঁজির মালিকেরা ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও রিপাবলিকান পার্টিকে চাঁদা, অনুদান ও দান দিয়ে নির্বাচনে জেতার জন্য সহযোগিতা করতেন। পুঁজিপতিদের চাঁদা, দান, অনুদান ও সাহায্য নিয়ে দলগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে সে দেশে।

বিশ্বরাজনীতি এবং আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার আগামী নির্বাচনে ডোনান্ড ট্রাম্পের একজন বাণিজ্যিক পার্টনার অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। পুঁজিপতি, শিল্পপতি ও ব্যাংক মালিকেরা নেতৃত্বের আসনে চলে আসছেন। ভবিষ্যতে তারাই রাজনীতিবিদদের পরিবর্তে দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। শিল্পপতি, পুঁজিপতি ও ব্যাংকাররা রাজনীতিতে ‘নীরব বিপ্লব’ ঘটাতে যাচ্ছেন। তারাই হবেন আগামী দিনের নেতা। তখন করপোরেট হাউজগুলো আগামী দিনের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে।

ইতালির বিখ্যাত রাজনীতিক ও দার্শনিক ভিলফ্রেড প্যারোটো বলেছিলেন, এলিটদের সিন্ডিকেট বা অভিজাতরাই রাজনীতিকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ৮০ পরিবারের একটি সিন্ডিকেট। সাবেক পাকিস্তানে ২২ পরিবার এবং বাংলাদেশে ৫০০ পরিবারের এক সিন্ডিকেট রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অর্থসংস্থানের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক নানা উৎস থেকে অর্থ গ্রহণ করে। নির্বাচন পরিচালনা ও নির্বাচনে জয়লাভের জন্য তাদের বিপুুল টাকার প্রয়োজন।

করপোরেট হাউজগুলো রাজনীতিকে একটা বিনিয়োগ বলে মনে করে। তাদের বিনিয়োগকৃত দলটি যদি নির্বাচনে জিততে পারে, তবে পাঁচ বছরে তারা ‘মূলধন ও মুনাফাসহ বিনিয়োগকৃত পুঁজি’ ফেরত পাবেন। তাই রাজনীতি ও নির্বাচনে বিনিয়োগ কপোরেট হাউজগুলোর জন্য লাভজনক। সঠিক আঁচ-অনুমানের ভিত্তিতে সঠিক দলটিতে বিনিয়োগ করতে পারলে ‘বিরাট সাফল্য’ তাদের হাতে ধরা দেবে।

রাজনীতি ও নির্বাচনে বিনিয়োগের সময় তারা পে-ব্যাক মেথড বা মূলধন ফেরত পাওয়ার পদ্ধতি বিশ্লেষণ করেন। প্রথম বছর, দ্বিতীয় বছর ও তৃতীয় বছরের মধ্যে পুরো বিনিয়োগ ফেরত আসবে কি না সেটা নিরূপণের চেষ্টা করেন। এ ছাড়া, ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন যদি ভালো হয় সে ক্ষেত্রে তারা পুঁজি বিনিয়োগ করে থাকেন। যে দলে বিনিয়োগ করলে রিটার্ন ভালো আসবে সে দলে তারা বিনিয়োগ করেন। সে ক্ষেত্রে তারা দেখেন, কোন দলের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি। সে মোতাবেক, দলের নির্বাচনী ফান্ডে তারা পুঁজি বিনিয়োগ করেন।তারা টাইম ভ্যালু অব মানি টুলসও ব্যবহার করেন। তারা মুদ্রাস্ফীতির হার দিয়ে বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ২০১৭ সালের ১০০ টাকার যে দাম ২০১৯ সালে সে দাম থাকবে না। মুদ্রাস্ফীতির দরুন ২০১৯ সালে আজকের ১০০ টাকার দাম হবে ৮০ টাকা। নির্বাচনী প্রকল্পে অর্থসংস্থানের সময় টাইম ভ্যালু অব মানির বিষয়টি বিবেচনা করা হয়।এ ছাড়া তারা রাজনীতিতে বিনিয়োগের সময় প্রজেক্ট ইভ্যালুয়েশন করেন। একাধিক প্রকল্পের মধ্যে যে প্রকল্পটিতে বিনিয়োগ ঝুঁকি কম ও মুনাফা বেশি, সে প্রকল্পে অর্থাৎ যাদের ক্ষমতা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি সে দলকে তারা অর্থসংস্থান করেন। এখানে তারা বিনিয়োগ ও পুঁজির সঞ্চালন নীতিকে প্রাধান্য দেন।

নেতার জনপ্রিয়তা ও ক্যারিশমাও বিবেচ্য বিষয়। অসাধারণ জনপ্রিয় বা ক্যারিশম্যাটিক কোনো নেতার আবির্ভাব হলে তারা তখন সেই নেতা ও তার দলকে অর্থ জোগান। এ ছাড়া দলের কর্মসূচি বা প্রোগ্রাম তাদের কাছে খুবই গুরুত্বর্পূণ। কর্মসূচি ব্যবসায়বান্ধব ও পুঁজির জন্য নিরাপদ মনে হলে তারা অর্থের জোগান দেন। জাপানের ভোটাররা করপোরেট হাউজগুলোর ভূমিকা বা অবস্থান দেখে ভোট দেন তাদের অনুকূলে। করপোরেট বা বিজনেস হাউজগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকে মিডিয়া ও গণমাধ্যম। মিডিয়ার মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করা হয়। প্রভাবিত হয়ে ভোটারদের একটা অংশ ভোট দেন। এভাবে অর্থসংস্থানের পাশাপাশি তাদের বিনিয়োগকে নিরাপদ করার জন্য মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয়।

রাজনীতিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিজনেস হাউজগুলো অনেক সময় ঝুঁকিও নিয়ে থাকে। লোকসান হয়, যেহেতু রাজনীতি ও নির্বাচনে বিনিয়োগ অনেকটা অনুমানের ওপর নির্ভর করে। সে জন্য ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ থেকে লোকসান হয়ে যায়। বিজনেস হাউজগুলো অনেক লোকের ও পরিবারের কর্মসংস্থান করে। সে জন্য তাদের নির্বাহী ও কর্মীরা করপোরেট হাউজের পছন্দের দলকে ভোট দেয়। তাদের হাতে ভোটব্যাংকও আছে।

অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও রাজনীতিতে অর্থসংস্থান একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ যতই শিল্পোনত ও উন্নত দেশের পর্যায়ে যাবে, ততই রাজনীতিতে অর্থসংস্থান বা ফিন্যান্সের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো করপোরেট হাউজগুলোই দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থসংস্থান করবে। রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য ফিন্যান্সের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আলোচনায় আসা উচিত। তাহলেই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সম্প্রতি ফ্রান্সের নির্বাচনে দেখা গেছে রথচাইল্ড গ্রুপের সহযোগিতা নিয়ে ইমানুয়েল ম্যাক্রো নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। অন্য দিকে, লিজার্ড গ্রুপ কোনো প্রার্থীকে সমর্থন না দেয়ায় নির্বাচনের শেষ পর্বে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি।

ম্যাক্রো ফিন্যান্স ক্যাপিটালের প্রতিনিধি। নির্বাচনে পছন্দের দলটিকে জিতিয়ে আনতে পারলে বড় বড় নির্মাণকাজ ও প্রকল্পের কাজ পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তিগুলোয় অংশ নেয়া যাবে। বড় বড় চুক্তিতে ভালো ‘পার্সেন্টেজ’ পাওয়া যাবে। বড় বড় প্রকল্পের কাজ ভাগিয়ে নেয়ার মাধ্যমে নিজেদের বাণিজ্যিক অবস্থানকে পোক্ত করা যাবে। বহুজাতিক কোম্পানির সাথে চুক্তি সম্পাদনে দেশী অংশীদার হিসেবে ভালো কমিশন পাওয়া যাবে। তাই রাজনীতিতে বিনিয়োগ ও অর্থসংস্থান লাভজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া এনজিও, বহুজাতিক কোম্পানি, দাতা সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশী-বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা গোপনে সহযোগিতা দিতে থাকে বলে অভিযোগ আছে। মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে।
লেখক : সাংবাদিক

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn