বিদায় শ্যামলী নিসর্গপুত্র দ্বিজেন শর্মা
আলমগীর শাহরিয়ার-
আমাদের কৈশোরে, আমাদের প্রথম তারুণ্যে যাদের গল্পগাথা শুনে, লেখা পড়ে বড় হয়েছি তারা একে একে চলে যাচ্ছেন-না ফেরার দেশে। বিভিন্ন অঙ্গনে জাতির বাতিঘরসম এসব বরেণ্যজনদের চলে যাওয়ার বেদনাদায়ক খবর শুনলেই অপূরণীয় এক শূন্যতা দেখি চারপাশ জুড়ে, দেখি আলোর প্রস্থানে সৃষ্ট এক গভীর অন্ধকার। তখনও সদ্য বিদ্যালয়ের পাঠপর্ব চুকানো এক বালক আমি। সিলেট শহরে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ (কেমুসাস) ও শহরের স্টেডিয়াম সংলগ্ন পাবলিক লাইব্রেরিতে নিয়মিত নানা বিষয়ে পড়তে যাই। পাঠাগারে পড়তে যেয়েই একদিন পরিচয় হয় দ্বিজেন শর্মার লেখার সঙ্গে। পড়াশোনা ও ভাবনার চেনা গণ্ডি পেরিয়ে দেখি উনি লিখছেন ভিন্ন প্রসঙ্গে। টের পাই পরিবেশ, প্রকৃতি, উদ্ভিদ তাঁর মনোযোগ ও অনুরাগে, ধ্যানে ও তপস্যায়। আমার দ্বিজেন শর্মায় আগ্রহ বাড়ে। উনার লেখা হাতের কাছে পেলেই পড়ি। সিলেট শহরের শহীদ মিনার সংলগ্ন চৌহাট্টা মোড়ে ফুটপাতে খোকা নামে একজন পুরনো বই নিয়ে বসেন। ওদিকে গেলেই আমি নেড়েচেড়ে দেখি নতুন কি বই এলো। খোকা ভাইয়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে আমার, আমার বন্ধুদের সখ্যতা গড়ে উঠে। আমরা গেলেই সংগ্রহ করা পুরনো নতুন বইয়ের খবর দেন।
দ্বিজেন শর্মার ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’ সেখান থেকেই কিনে পড়া। দ্বিজেন শর্মার জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় প্রায় দুই-দশকাধিক কাল কেটেছে প্রবাসে, সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার মস্কোতে। ব্যক্তিগত স্মৃতিকথার বাইরেও রাশিয়ার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পালাবদলের অনেক কথাই লেখা আছে তাঁর ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’-বইয়ে। সেখানে পড়েছিলাম, একবার দেশে চার মাস ছুটি কাটিয়ে কর্মস্থল মস্কোয় ফিরছেন। বরিশাল থেকে ঢাকার পথে। বাম রাজনীতি করা এক তরুণের সঙ্গে পথে সাক্ষাত। উৎসাহী তরুণ তাকে প্রশ্ন করছে, ‘সোভিয়েত দেশে আপনার সবচেয়ে কী ভালো লাগে?’ উত্তরে বলেছিলেন, “মানুষে মানুষে ধনবৈষম্যের সবচেয়ে কম ফারাক। এমন আশ্চর্য সমাজ আগে পৃথিবীর কোথাও তৈরি হয় নি, এখনো সমাজতান্ত্রিক গোষ্ঠীর বাইরে কোথাও নেই।”
যা হোক, ধনবৈষম্য বিরোধী সমাজতন্ত্রে মুগ্ধ দ্বিজেন শর্মাকে প্রথম দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর একুশে গ্রন্থমেলায়। আলাপ পরিচয় সেখানেই। প্রকাশক মোস্তফা সেলিমের (সেলিম ভাই) উৎস প্রকাশনে। উৎস প্রকাশনে উনি প্রায় আসতেন। সেবার মেলায় বেরিয়েছে উনার বই ‘কুরচি তোমার লাগি’। বইটি দৈনিক ‘প্রথম আলো’ বর্ষসেরা বই নির্বাচিত হয়। বইমেলায় আলাপচারিতায় সিলেটের জল জোছনার দেশ সুনামগঞ্জে বাড়ি জেনে গল্প করেন প্রথম যৌবনে কিভাবে জলজ উদ্ভিদ, লতা, গুল্মের সঙ্গে পরিচয়ের জন্য দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছেন জলমগ্ন হাওরাঞ্চলে। শুনে শিহরিত হই। একই সঙ্গে দুঃখ করি। হাওরের সমৃদ্ধ জীব-বৈচিত্র্য অনেকটাই হারিয়ে গেছে। আগ্রাসী মানুষের নীল থাবায় অনেক কিছুই এখন বিলুপ্ত।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’, আহমদ ছফার ‘পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ আমাকে আলোড়িত করেছিল। বিভূতিভূষণ ও ছফার পর ‘শ্যামলী নিসর্গ’-এর লেখক দ্বিজেন শর্মা আমাকে শিখিয়েছেন বৃক্ষের জন্য, নান্দনিক পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য মানুষ বুকে কি গভীর ভালোবাসা পুষে রাখে। আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে নটরডেম কলেজে অনুজ জাহাঙ্গীর আলম নোমানকে ভর্তি করাতে যেয়ে কলেজ প্রাঙ্গণে সবুজ শ্যামলিমায় ছেয়ে থাকা অনেক পুরনো বৃক্ষ দেখে আমার দ্বিজেন শর্মার কথা মনে পড়ে। প্রথম কর্মজীবনে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে ৪-৫ বছর শিক্ষকতা করে তিনি যোগ দিয়েছিলেন নটরডেম কলেজে। সে সময় তিনি নিজ হাতে এই কলেজ প্রাঙ্গণে সৌন্দর্যায়নের অংশ হিসেবে পরিকল্পনামাফিক অনেক গাছ লাগান। সেসব তাঁর স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়।
বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলার জন্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের উদ্যোগে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের আন্তরিক সদিচ্ছা ও সহযোগিতায় শুরু হওয়া বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের “সবুজ ঢাকা কর্মসূচি”র এক অনুষ্ঠানে গেল বছর আগস্টে উত্তরায় আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দ্বিজেন শর্মা। সায়ীদ স্যার সে অনুষ্ঠানে এদেশের প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষা ও সচেতনতায় দ্বিজেন শর্মার অবদান স্মরণ করে কিছুটা আনন্দছলে তাকে “বাবায়ে বৃক্ষ” বলে সম্বোধন করেছিলেন। অনুষ্ঠান শেষ হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা বিষয়ক জাতীয় কমিটির নির্ধারিত এক মিটিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য দ্বিজেন স্যার আমাদের সঙ্গে একই গাড়িতে ফিরেন। সায়ীদ স্যার সামনের সিটে বসায় আমি ও দ্বিজেন স্যার পেছনে পাশাপাশি সিটে বসি। ট্রাফিক জ্যামের বদান্যতায় উত্তরা থেকে সচিবালয়ের পথ সুদীর্ঘ হয়। ফেরার পথে সেদিন বিস্তর কথা হয়। যানজটও কখনো ভালো লাগার কারণ হয়।
মনে পড়ে, বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি রোডে সড়ক বিভাজনকে সিটি কর্পোরেশনের সবুজায়ন প্রকল্পে লাগানো গাছ দেখে তিনি আক্ষেপ ও দুঃখ করেন ঢাকা শহরে এমন অসংখ্য জায়গায় ভুল নির্বাচন ও অপরিকল্পিত বৃক্ষায়নের জন্য। কথা ছিল মেয়র আনিসুল হকের সঙ্গে সায়ীদ স্যারসহ রুক্ষ প্রাণহীন ঢাকা শহরে সবুজায়ন নিয়ে কথা বলবেন। কিভাবে শহরে আরও পরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো যায়। বাসযোগ্য, দৃষ্টিনন্দন সবুজ একটি শহর গড়ে তোলা যায়। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য এ বছরের প্রথম দিকে সায়ীদ স্যার এক দুর্ঘটনায় আহত হন। বেশ কিছুদিন চিকিৎসা নেয়ার পর সুস্থ হলেন কিন্তু এরই মধ্যে মেয়র আনিসুল হককে বিরল এক রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ চিকিৎসা নিতে লন্ডনের এক হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। আর অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা দেশে চিকিৎসারত অবস্থায় চিরনিদ্রায় চলে গেলেন।
দ্বিজেন শর্মা শুধু একজন নিসর্গবিদ, জীববিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন একজন সুসাহিত্যিকও। বরিশাল থেকে লঞ্চে ঢাকায় ফেরার পথে স্মৃতিচারণের এক বর্ণনায় পাই, “এ পথে অন্তত হাজারবার যাতায়াত করেছি। তবু সবকিছু নতুন মনে হয়। নদী তীরের নিসর্গ কখনো পুরনো হয় না। বর্ষাকাল। পদ্মা প্রমত্তা। চাঁদনি রাত। দূরের ঘুমন্ত গ্রাম, ধানক্ষেত ও পাটের সবুজ আবছা আলোয় রহস্যময়। আমি দেশ থেকে চলে যাচ্ছি। কতদিন পর আবার আসবো কে জানে! তাই বুভুক্ষুর মতো যতটুকু পারি স্বদেশের ভূদৃশ্য আত্মসাৎ করছি। পরদেশে এই স্মৃতিজারণ থেকে পাওয়া স্মৃতিটুকু খরচা করেই সজীব থাকার চেষ্টা করবো।”
জীবনানন্দের দেশ বাংলার রূপে মুগ্ধ এ নিসর্গপ্রেমী নিশ্চয়ই আর ফিরে আসবেন না- ‘বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এই সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।’ তবু তাঁর নিসর্গপ্রেম, প্রকৃতিনুরাগ আমাদের চেতনায় চিরজাগরুক থাকবে।
১৯২৯ সালে শ্রীভূমি সিলেটের মৌলভীবাজারের শিমুলিয়া গ্রামে দ্বিজেন শর্মার জন্ম। সেখানকার পাথারিয়া বনের নিসর্গে কেটেছে দ্বিজেন শর্মার সোনালি শৈশব। পড়াশোনা করেছেন তৎকালীন সিলেটের সাব ডিভিশন শহর করিমগঞ্জ (বর্তমান ভারতের আসাম অঙ্গ-রাজ্যের একটি জেলা), পরে কলকাতায়। শিক্ষকতা করেছেন জীবনের উল্লেখযোগ্য এক সময়। বিশ্ববিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রগতি’র অনুবাদক হিসেবে ছিলেন রাশিয়ার মস্কোতে দীর্ঘদিন। সেসব স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন “সমাজতন্ত্রে বসবাস”। এদেশের প্রাণ প্রকৃতি, বন ও বৃক্ষ নিয়ে তিনি জীবনভর নিরলস কাজ করেছেন। লিখেছেন, “শ্যামলী নিসর্গ”, সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণী বিন্যাস,’নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা’, ‘বাংলার বৃক্ষ’। তাঁর স্বচ্ছ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে ‘ডারউইন ও প্রজাতির উত্পজত্তি’ নামক মূল্যবান গ্রন্থটি। ‘গহন কোন বনের ধারে’, ‘গাছের কথা’, ‘ফুলের কথা’, “কুরচি তোমার লাগি”সহ প্রকাশিত গ্রন্থ কুঁড়ির কাছাকাছি।
সবুজ বাসযোগ্য এক পৃথিবীর জন্য নব্বই ছুঁই ছুঁই বয়সেও তিনি ছিলেন এক অক্লান্ত যোদ্ধা। তাঁর চলে যাওয়া বন পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংস করা আমাদের উন্নয়ন আগ্রাসী সময়ে অপূরণীয় ক্ষতির। এই মহার্ঘ্য প্রস্থান কখনো পূরণ হওয়ার নয়। মাটির মমতা রসে মিশে, করচ, জারুল, শ্রীভূমির শিমুলিয়া গ্রামের শিমুল তলে অলক্ষ্যে-বাংলার সুশীতল বৃক্ষের ছায়ায় ভালো থাকুন নিসর্গপুত্র।
আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক