সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের পরও দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বড় দুর্নীতিবাজদের সরকার সুরক্ষা করছে বলেও অভিযোগ করেছে সংস্থাটি। এছাড়া বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।রবিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে মাইডাস সেন্টারে টিআইবির সম্মেলন কক্ষে ‘টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট ১৬: দুনীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যের ওপর বাংলাদেশের প্রস্তুতি, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদ পেশ করে টিআইবি। গবেষণাটি এবছর এপ্রিল থেকে আগস্ট সময়ের মধ্যে পরিচালিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির প্রতিবেদন তুলে ধরে সংস্থাটির প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম বলেন, বাংলাদেশে নাগরিকদের মৌলিক স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান। দেশে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। ২০১৬ সালে ১৯৫ জন এবং ২০১৫ সালে ১৯২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা উদ্বেগজনক অপব্যবহার করা হচ্ছে। জাতীয় শুদ্ধাচার কাঠমোর অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর নয়। এর পেছনে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা, নির্বাহী বিভাগ ও প্রশাসনের আধিপত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশে আইনের প্রয়োগ সীমিত বা চর্চায় ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়াও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনের অপব্যবহার পরিলক্ষিত হয়েছে। দলীয় বিবেচনায় আইনের প্রয়োগ হচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, বিভিন্ন উদ্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশে দুর্নীতি ও ঘুষ, অর্থপাচার, মৌলিক স্বাধীনতার ব্যত্যয় ও মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে। জাতীয় শুদ্ধাচার কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর নয় এবং এজন্য দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা, নির্বাহী বিভাগ ও প্রশাসনের আধিপত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই জনগণের কাছে জবাবদিহিতার কোনো কাঠামো নেই এবং এসব প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা ব্যবস্থাও দুর্বল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশও পর্যাপ্ত নয়।

এছাড়া, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট অর্থপাচার এবং সম্পদ পুনরুদ্ধারসহ কয়েকটি বিষয়ে সরকারের কাছে আংশিক তথ্য থাকলেও দুর্নীতি ও ঘুষ, সরকারি সেবা ও প্রতিষ্ঠানের ওপর জনগণের সন্তুষ্টি এবং বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। সার্বিকভাবে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য ২৪১টি সূচকের মধ্যে সরকারের কাছে ৭০টি সূচকের ওপর সম্পূর্ণ এবং ১০৮টি সূচকের ওপর আংশিক তথ্য রয়েছে। ৬৩টি সূচকের ওপর সরকারি কোনো তথ্য নেই।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান অভিযোগ করেন, যারা বড় ধরনের অর্থ পাচার করেন তাদের আইনের আওতায় না এনে সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। দলীয় রাজনীতির কুপ্রভাবে অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকারিতা নয়।  এছাড়া, জনগণের মৌলিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহ তদন্ত ও ফলাফল প্রকাশে সদিচ্ছা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং ব্যাংক খাতের কেলেংকারিগুলোর দোষীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার মতো উদাহরণ সার্বিকভাবে অভীষ্ট অর্জনের অগ্রগতির সাথে সাংঘর্ষিক। এক্ষেত্রে এসডিজির মূল লক্ষ্য ‘কাউকে বাদ দিয়ে নয়’ -এর ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হতে হবে।’

টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ‘দেশে সব স্তরে বৈষম্য-বিভাজন ও অনিয়ম বিদ্যমান। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। সব জায়গায় এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের লক্ষ্যে নানামুখি পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও বিভিন্ন জরিপ ও তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে এর সুফল সকল ক্ষেত্রে জনগণ পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য সব পরিকল্পনা, কার্যক্রম ও কর্মসূচিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।’টিআইবি আইনি সংস্কারের সুপারিশে করে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল চেয়েছে। নির্বাচন কমিশনের গঠন, কমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম নিয়ে আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে। দুর্নীতি দমনে কাজ করা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের সুপারিশ করেছে।এ ছাড়াও সংস্থাটি সবধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও পুলিশি হেফাজতে মত্যুর তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে।

গবেষণায় দুর্নীতি ও ঘুষ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য না হওয়া; বিদ্যমান আইনে কয়েকটি বিভাগের কর্মচারীদের আওতামুক্ত রাখা; স্বার্থের দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত প্রদত্ত বিবরণ প্রকাশে সরকারি কর্মচারীদের বাধ্যবাধকতা না থাকা; নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদ সদস্যদের আর্থিক তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা না থাকা; জনস্বার্থ সুরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে পেশাগত বাধ্যবাধকতা, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, তথ্য প্রকাশকারী কোনো সমস্যায় পড়লে তার প্রতিকার, অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য স্বচ্ছ, কার্যকর ও সময়োপযোগী পদ্ধতির অনুপস্থিতি; দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের বেনামি মালিকানার তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা না থাকা; সরকারি ক্রয়ে গোপন আঁতাত বন্ধ করার জন্য কোনো বিধান না থাকা এবং সরকারি কর্মচারীদের জন্য অবসর গ্রহণের পর একই খাতের বেসরকারি কোনো চাকরিতে যোগদানের পূর্বে কতদিন ব্যবধান থাকতে হবে সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ না থাকা।

তবে গবেষণায় সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৬ সালে প্রাপ্ত ১২ হাজার ৫৬৮টি অভিযোগের মধ্যে এক হাজার ৫৪৩টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয় এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ে ৫৪৩টি অভিযোগ প্রেরণ করা হয়। এর আগে প্রতি বছর গড়ে এক হাজার ২০টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হতো। ২০১৬ সালে ৩৫৯টি অবৈধ উপায়ে সুবিধা লাভ সংক্রান্ত মামলা নথিভুক্ত করার পাশাপাশি ঘুষ নেয়ার জন্য ১৩ জনকে আটক ও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণসহ অবৈধ উপায়ে সুবিধা লাভ সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলায় ৩৮৮ জনকে আটক করা হয়। এছাড়া, দুর্নীতির অভিযোগ জানানোর জন্য দুদক কর্তৃক সম্প্রতি হটলাইন চালু করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ওয়াহিদ আলম এবং এ এস এম জুয়েল মিয়া।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn