তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান বলেছেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু রাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বে একটি উঠতি শক্তি হিসেবে তুরস্কের উত্থানকে সহ্য করতে পারছে না, তাই তারা আগামী ১৬ এপ্রিল তুরস্কের সাংবিধানিক রেফারেন্ডামের বিরুদ্ধে কাজ করছে।’ এরদোগান বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু রাষ্ট্র দুর্ভাগ্যজনকভাবে তুরস্কের উত্থানকে সহ্য করতে পারছে না। এর মধ্যে জার্মানি অন্যতম। জার্মানি নিরলসভাবে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।’ সোমবার স্থানীয় একটি হেবার এবং এটিভিতে সরাসরি প্রচারিত এক সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের ভূমিকার তীব্র নিন্দা করেন। এর আগে জার্মান চ্যান্সেলর  নেদারল্যান্ডসের প্রতি তার ‘পূর্ণ সমর্থন এবং সংহতি’ প্রকাশের ঘোষণা দেন। এরদোগান ডাচ এবং জার্মানির প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তাদের প্রচেষ্টাকে নাৎসিবাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

এর আগে তুর্কি সংবিধান সংশোধনে গণভোটের প্রচারাভিযানে দেশটির মন্ত্রীদের বাধা প্রদান করার জন্য ডাচ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিশোধ ব্যবস্থা ঘোষণা করেছে তুরস্ক। তুর্কি উপ-প্রধানমন্ত্রী নুমান কুরতোলমাস জানান, আঙ্কারায় ডাচ রাষ্ট্রদূতের ফিরে আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে এবং দেশটির সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের সকল রাজনৈতিক আলোচনা স্থগিত করা হয়েছে। গণভোটের জন্য তুর্কি সমাবেশের প্রচেষ্টায় জার্মানি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ড বাধা প্রদান করে। এদিকে সোমবার, ডাচ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নতুন একটি ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে। তুরস্কে থাকা দেশটির নাগরিকদের প্রতি সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন যাতে নতুন করে ‘কূটনৈতিক উত্তেজনা’ বৃদ্ধি না পায়। নেদারল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনের মাত্র দু’দিন আগে এই প্রদক্ষেপ নেয়া হল। দেশটিতে অভিবাসন ও ইসলামী চরমপন্থা নিয়ে উদ্বেগের মধ্য এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আঙ্কারায় ডাচ কূটনৈতিক ভবনের বাইরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে তুর্কি সমাবেশ ব্লক করে দেয়ার জন্য কারণ হিসেবে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা বলেছেন ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট।

প্রস্তাবিত সমাবেশ শোভাযাত্রা লক্ষ্য ছিল প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর ১৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোটের পক্ষে ইউরোপে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক তুর্কিদের উৎসাহিত করা। উদাহরণ স্বরূপ, জার্মানিতে তুর্কি বংশোদ্ভুত তিন মিলিয়নেরও বেশি মানুষ রয়েছে। তাদের মধ্যে আনুমানিক ১.৪ মিলিয়ন তুর্কি নির্বাচনে ভোট দেয়ার জন্য যোগ্য।  কার্যত, তুরস্কের প্রবাসীরা দেশটির নির্বাচনে অন্যতম বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও নেদারল্যান্ডস জানিয়েছে, এই সমাবেশকে কেন্দ্র করে উত্তেজনায় আরো ইন্ধন জোগান হতে পারে। যদিও ফ্রান্সে একটি সমাবেশ হওয়ার পর দেশটির কর্মকর্তারা জানান, এনিয়ে সেখানে কোন হুমকি ছিল না।

ডাচ শহর রোটারডামে সমাবেশে বক্তৃতা দেয়ার ওপর তুরস্কের দুই মন্ত্রীকে বাধা দেয়া হয়। তাদের একজনকে সীমান্ত দিয়ে জার্মানিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। রোটারডামে তুর্কি পতাকাবহনকারী বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ জলকামান ও কুকুর ব্যবহার করেন। এদিকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তুরস্কের ক্ষমতাসীনরা। তুরস্কের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের প্রধান মুখপাত্র কুরতোলমাস বলেন, ‘ডাচ কূটনীতিকদের বা দূতকে বহনকারী প্লেনকে আমাদের আকাশসীমা ব্যবহার কিংবা তুরস্কের ভিতরে ল্যান্ডিং করার অনুমতি দেয়া হবে না।’ ডাচ রাষ্ট্রদূত কিস করনেইলস ভ্যান রিজ বর্তমানে দেশটির বাইরে অবস্থান করছেন। তার অবর্তমানে উপরাষ্ট্রদূত দায়িত্ব পালন করছেন।

তিনি জানান, উচ্চ পর্যায়ের সব রাজনৈতিক আলোচনা স্থগিত করা হবে এবং একটি দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্ব থেকে নেদারল্যান্ডসকে প্রত্যাহার করার জন্য পার্লামেন্টকে পরামর্শ দেয়া হবে। উপ-প্রধানমন্ত্রী আরো জানান, যতক্ষণ না নেদারল্যান্ডস তার কর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ না করে ততক্ষণ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা কার্যকর থাকবে। এর আগে এরদোগান নেদারল্যান্ডকে একটি ‘ব্যানানা বা কলা প্রজাতন্ত্র বলে মন্তব্য করে দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর প্রতি আহ্বান জানান এবং ‘ইসলামফোবিয়া’ বা ইসলামভীতির জন্য পশ্চিমা এসব দেশগুলো দায়ী করেন। এদিকে নেদারল্যান্ড ও জার্মানির এমন ভূমিকার নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মহল। তারা এ ঘটনাকে ভিয়েনা কনভেনসনের লঙ্ঘন বলেও উল্লেখ করেছেন।

প্রসঙ্গত, বর্তমান বিশ্বে যে কয়টি দেশ উদীয়মান প্রভাবশালী দেশের তালিকায় রয়েছে, এর মধ্যে তুরস্ক অন্যতম। তুরস্ক ক্রমেই পরাশক্তিতে পরিণত হচ্ছে। বিশেষ করে ইসলামপন্থী বলে পরিচিত একে পার্টি রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণের একের পর এক সংস্কারে দেশটি রাজনীতি ও অর্থনীতির দিক থেকে দেশটি অভুতপূর্ব উন্নতি লাভ করে। এমন কী একাধিক বার সেনা অভ্যুত্থানের ব্যর্থ প্রচেষ্টাও দেশটি অগ্রযাত্রাকে থামাতে পারেনি। ফলে দেশটি এখন পূর্ব-পশ্চিমা বিশ্বের পরাশক্তির জন্য অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা দিয়েছে। ইউরোপ-এশিয়াসহ বিশ্বের নানা ইস্যুতে তুরস্কের নাক গলানোর বিষয়টিও তারা ভাল চোখে দেখেনি। এতে অনেকটাই নাখোশ পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। এর ফলে তারা তুরস্কের রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তনে নানাভাবে কাজ করে আসছে। এমন অভিযোগ খোদ তুরস্কের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের। গত বছরের ১৫ জুলাই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পেছনে পশ্চিমাদের যে হাত ছিল তা প্রকাশ্যে আনে ক্ষমতাসীন না।

১৫ জুলাই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর সেভাবে সহযোগিতা কিংবা সমর্থন পায়নি তুরস্কের ক্ষমতাসীনরা। তাই তারা প্রকাশ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছিল। সেই সঙ্গে তুরস্ক পশ্চিমা বিশ্ব থেকে ক্রমেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পূর্বের দিকে ঝুঁকছে। রাশিয়ার সঙ্গে নানামুখী সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে মগ্ন। এরই মধ্যে নতুন করে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে।

আনাদোলু নিউজ এজেন্সি, বিবিসি ও রয়টার্স অবলম্বনে

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn