বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ময়মনসিংহের লোক। ময়মনসিংহের ভাষায় এবং সুরে তাঁর কিছু বক্তৃতা আমি ইউটিউবে শুনেছি এবং যথারীতি মুগ্ধ হয়েছি। আমার বাড়ি ময়মনসিংহে, সে কারণেই ময়মনসিংহের উচ্চারণে তিনি যখন কথা বলেন, তাঁকে খুব আপন মনে হয়। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ তাঁর সরলতা, সততা, স্বতঃস্ফূর্ততা।   রাষ্ট্রপতি গত শুক্রবার রাজধানীর বনানী পূজামণ্ডপে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছেন– ‘বিশ্বকে অবশ্যই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ধর্মের অপব্যাখ্যা সম্পর্কে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। অশুভ শক্তি এখনও ধর্মভিত্তিক জাতি অথবা রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টায় লিপ্ত, যা আমরা লক্ষ করি। কিন্তু বিশ্ববাসীকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অতীতে ধর্মভিত্তিকে রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে জাতিতে জাতিতে বহু সংঘাত হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে। ধর্মের নামে মনুষ্যত্ব, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনও প্রত্যক্ষ করছি, একটি অশুভ মহল ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কোনও ধর্ম নয়, বরং ধর্মনিরপেক্ষতা হবে একটি জাতি ও দেশ গঠনের ভিত্তি। কোনও একক ধর্ম নয়, বরং সব ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে গড়ে তুলতে হবে ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সৌহার্দ্যময় সমাজ ও রাষ্ট্র। যেখানে সব ধর্মের লোক পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। ধর্মীয় উৎসব উদযাপনে ভিন্নতা থাকবে; তবে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের অনুসারীদের চেতনা ও মূল সুর একই। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে সব ধর্মের লোক নিজ নিজ ধর্ম পালন করে আসছে’। প্রধানমন্ত্রীকেও এত জরুরি কথা কোনোদিন বলতে শুনিনি।

রাষ্ট্রপতির রসবোধ প্রচণ্ড। যারা ভালো কৌতুক জানেন, সম্ভবত তারা মানুষ ভালো হন। মানুষ ভালো বলেই ধর্মান্ধতা যখন চারদিকে ‘হাউমাউখাউ’ করছে, তখন তিনি ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিদেয় করতে চাইছেন। রাষ্ট্রের ভেতর-ঘরে ধর্মকে ঢুকিয়ে দিলে সমাজে ধর্মান্ধতা বাড়ে। ধর্মান্ধতা বাড়লে সন্ত্রাস বাড়ে। সন্ত্রাস বাড়লে দেশজুড়ে চরম অশান্তি বাড়ে, রাষ্ট্র অচল হয়ে পড়ে। এ নতুন কোনও তথ্য নয়। আমরা যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছি এর। এ কারণেই রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করা অত্যন্ত জরুরি। এ শুধু সব ধর্মের মানুষের, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমানের সহাবস্থানকে শান্তিপূর্ণ করার জন্য নয়, এ মানুষের মৌলিক অধিকারের জন্য অত্যন্ত জরুরি। রাষ্ট্রে ধর্ম থাকা মানে ধর্মীয় আইন বহাল থাকা। মুসলমানদের জন্য ইসলামি আইন, খ্রিস্টানদের জন্য খ্রিস্টীয় আইন, হিন্দুর জন্য শাস্ত্র, ইত্যাদি। কোনও আইনে নারীকে সমানাধিকার দেওয়া হয়নি। মুসলমান মেয়েরা পুত্র যা সম্পত্তি পায়, তার অর্ধেক পায়; হিন্দু মেয়েরা কোনও সম্পত্তিই পায় না। হাজার হাজার বছরের পুরনো শাস্ত্র আর আইন আমদের কেন এখনও অনুসরণ করতে হবে? প্রাচীন লোকেরা যে ধরনের জীবন যাপন করতো, আমরা তো সেই জীবন যাপন করছি না। আমাদের ভাবনা চিন্তাও পুরনো মানুষের চেয়ে অনেক অগ্রসর। আমরা এখন নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস করি। তবে কেন নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে এত অস্বীকৃতি? কেন পুরনো শাস্ত্র বা ধর্মে টেনে আনা হয় নারীকে বঞ্চিত করার জন্য? কিছু বিশ্বাস, যে বিশ্বাস যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না, সেগুলোকে হয় ফেলে দিতে হয়, নয়তো গড়ে পিটে  আধুনিক করতে হয়। এ না হলে তাসের ঘরের মতো যে সভ্যতা এতকাল ধরে গড়েছি আমরা, ভেঙে পড়বে। অনেকে বলছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ভোটের দরকার নেই, তিনি নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। তাই ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার কথা বলতে পারছেন। পুরো উপমহাদেশ জুড়ে এই অবস্থা। ভোটের দরকার হলে ধর্মকে ব্যবহার করতে হয়। রাষ্ট্রে, সংবিধানে, আইনে, স্কুলে, মঞ্চে, মাটিতে ধর্মকে নামাতে হয়।মাথায় বন্দুক রেখে ভোট নেওয়ার মতোই সেটি অগণতান্ত্রিক। একটি গণতন্ত্র গড়ে তোলার জন্য অগণতান্ত্রিক দর্শনের এমন যদি যথেচ্ছ ব্যবহার হয়, তখন, সংশয় জাগে, এভাবে আদৌ কি আমরা গণতন্ত্রের চর্চা করছি, নাকি গণতন্ত্রকে একটু একটু করে হত্যা করছি!

মানুষকে ভোঁতা বানিয়ে ভোট নেওয়ায় কি সত্যি তৃপ্তি জোটে? দূরদৃষ্টিহীন রাজনীতিবিদদের হয়তো জোটে। কিন্তু এভাবে আর চলতে দেওয়া উচিত নয়।  মানুষের ভেতর রাজনৈতিক সচেতনতা আনা গণতন্ত্রের জন্য খুব জরুরি।  রাজনৈতিক সচেতনতা না থাকলে ভোট দেওয়া আর না-দেওয়া আসলে সমান কথা। সম্ভবত আমাদের রাজনীতিবিদরা ভোট না দেওয়ার মতো করেই ভোট দেওয়াটা চান। মানুষ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে গেলে তারা তো রাজনীতির নামে যা খুশি তাই বলতে, যা খুশি তাই করতে পারবেন না। দেশ গড়ার নামে দেশ ধ্বংস করতে পারবেন না। জনগণকে অজ্ঞ আর অশিক্ষিত করে রাখতে চান চতুর রাজনীতিকগণ। শিক্ষিত আর সচেতন জনগণকে ভয় তাদের। কারণ শিক্ষিত আর সচেতন জনগণই দুর্নীতির, দুর্দশার, দুঃশাসনের জবাবদিহি চায়। ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার। একে নিয়ে যেন টানাটানি না হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যদি রাষ্ট্রপতির উপদেশ মেনে চলেন, তাহলে সাম্প্রদায়িক অসন্তোষ, বৈষম্যের আইন, নারী নির্যাতন ইত্যাদি থেকে সমাজ ধীরে ধীরে মুক্ত হবে। আর এটিই তো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সব মানুষের উচিত চাওয়া।

গণতন্ত্র মানে কিন্তু শুধু ভোট দেওয়া, ভোট গোনা, কেউ জেতা কেউ হারার একদিনের খেলা নয়। গণতন্ত্র সারা বছরের। নারীর সমানাধিকার কোনও আইনের মাধ্যমে বাতিল করা মানে নারীকে তার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। ভুলে গেলে চলবে না যে, গণতন্ত্রে সবার অধিকার সমান। নারী, পুরুষ, সমকামী, রূপান্তরকামী, ব্রাহ্মণ, শুদ্র, গরিব, ধনী, সুস্থ, অসুস্থ, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি, নাস্তিক – সবার অধিকার সমান। সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় যদি একটি মানুষেরও অধিকার সামান্যও লঙ্ঘন হয়। লেখক:  কলামিস্ট

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn