বিশ্বফুটবল বনাম আমাদের ফুটবল: উন্নতি কোথায়?
একটা দুর্ভাগ্যজনক গল্প শোনাতে যাচ্ছি। যে দেশের অনলাইন, অফলাইন, টিভি মিডিয়া হতে শুরু করে চায়ের আড্ডাতে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা নিয়ে কথার লড়াই চলে, যেখানে একদল ভাবে আরেকদলকে পচাতে না পারলে আসলে মজা নাই আর দিনের শেষে বলে “ব্রো, ইটস জাস্ট এ গেইম” সেই দেশের বর্তমান ফুটবলের অবস্থাটা কি? আমাদের দেশের উন্নতির গ্রাফটা দেখার জন্যে একটু তুলনা মেলাচ্ছিলাম প্রতিবেশি ভারত, আফ্রিকার কেনিয়া আর এবারই প্রথম বিশ্বকাপে টিকেট পাওয়া উত্তর আমেরিকা জোনের পানামার সাথে।
- ১৯৯৩: বাংলাদেশের ফিফা র্যাঙ্কিং ১২০, ভারতের ১২৯, কেনিয়ার ৮৮, পানামা ১২৫
- ১৯৯৮: বাংলাদেশের ফিফা র্যাঙ্কিং ১৪৯, ভারতের ১১৫, কেনিয়ার ৯৩, পানামা ১২৭
- ২০০৩: বাংলাদেশের ফিফা র্যাঙ্কিং ১৪৬, ভারতের ১৩১, কেনিয়ার ৭৫, পানামা ১১৮
- ২০০৮: বাংলাদেশের ফিফা র্যাঙ্কিং ১৮১, ভারতের ১৫৩, কেনিয়ার ৯১, পানামা ৯২
- ২০১৩: বাংলাদেশের ফিফা র্যাঙ্কিং ১৬৬, ভারতের ১৫৫, কেনিয়ার ১১৮, পানামা ৩৫
- ২০১৬: বাংলাদেশের ফিফা র্যাঙ্কিং ১৮৫, ভারতের ১৪৮, কেনিয়ার ৯১, পানামা ৬২
- ২০১৭: বাংলাদেশের ফিফা র্যাঙ্কিং ১৯৬, ভারতের ১০৭, কেনিয়ার ৮৮, পানামা ৬০
পানামার মোট জনসংখ্যা ৩,৩২০,০০০ (ডিসেম্বর ২০০৬ এর ওদের আদমশুমারি অনুযায়ী, কেনিয়ার মোট জনসংখ্যা ৪১,০৭০,৯৩৪ জন (২০১১ সালের শুমারি অনুযায়ী) বাংলাদেশ ও ভারতের টা প্রায় সবাই জানে।
যে পানামা ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের চেয়ে র্যাঙ্কিং এ পিছিয়ে ছিলো সেই পানামা এবার বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করলো। পিছিয়ে থাকা ভারতও ফুটবলে নিজেদের এগিয়ে নিয়েছে অনেক যার ফলাফল ওদের বর্তমান অবস্থান। আর ভারতের মতন আর্থিক ভাবে শক্তিশালী না হলেও কেনিয়ার মতন দেশ সেই ১৯৯৩ থেকে এখন পর্যন্ত নিজেদের একটা অবস্থা ধরে রেখেছে বিশ্ব ফুটবলে যেটার মানে গিয়ে দাঁড়ায় শুধু টাকা পয়সা থাকলেই হয় না, থাকতে হয় সদিচ্ছাও। এবার আসি নিজের দেশের সেই সদিচ্ছা নিয়ে কথা বলতে যেখানে সবাই ‘চার ছক্কা হই চই’ বলতেই পাগল কিন্তু ফুটবল প্রসঙ্গ আসলেই কেমন যেনো চুপ হয়ে আর তখনই শুরু হয় বিভিন্ন দিকে আঙুল তোলা। মাঠ নাই, মাঠে খেলা নাই,ফুটবল লিগ শুরু হলে তার শেষ নাই আর অবস্থা তো বছরখানেক আগে এমন গেলো যে আবাহনী লিমিটেড জর্জ কোটানকে কোচ হিসেবে এক সিজনের জন্যে আনলেও উনি লিগ শেষ করে যেতে পারেন নাই কারণ লিগের টাইম সেই সিজনের টাইমের চাইতেও বেশী গেছে। সেই সময় ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব চালালেন আবাহনীর বিপদের বন্ধু সদ্য প্রয়াত অমলেশ সেন।
১৯৭২ সালে শেখ কামাল যখন আবাহনীর যাত্রা শুরু করেন তখন থেকে অনেক কিছু পালটে গেলেও পালটায় নি যা তা হলো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দলের ড্রেসিং রুমে কাটানো অমলেশ সেন যিনি শেখ জামালের বিপক্ষে ম্যাচের পূর্বে ক্রোয়েশিয় কোচ দ্রাগো মামিচের সঙ্গে অনুশীলনে থেকে খারাপ লাগার পরে বিরতি নেন ও এর পরে মারা যান। মারা যাওয়ার পরে উনার সম্মানে ক্লাবের পক্ষ থেকে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছিলো আর একজন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য হিসেবে অন্য কোন সম্মান উনাকে দেয়া হয়েছে বলে আমার নজরে পড়ে নাই। ঠিক এই একই ব্যাপার যদি হতো কোন এক ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে তবে কি হতো? দেশের বর্তমান ফুটবল ফেডারেশনের দায়িত্বে আছে এককালের মাঠ কাঁপানো খেলোয়াড় হতে শুরু করে অনেক বড় বড় সংগঠক। উনারা কেউ কি ফিফা র্যাঙ্কিং এর এই অবনতির সংবাদে কোন দুঃখ প্রকাশ করেছেন?
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রায় প্রতিটা রাজ্যের নিজস্ব লিগগুলি কিন্তু ঠিকই চলছে, কোলকাতার ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মোহামেডান বাদেও গোয়ার ক্লাবগুলাও ধরে রেখেছে নিজেদের ঐতিহ্য। সেখানে তুমুল জনপ্রিয় ক্রিকেটের আইপিএল স্টাইলে চলছে ফুটবল লিগ যেখানে খেলতে আসে রবার্তো কার্লোস, মাতারাজ্জি, আলেসান্দ্রো ডেল পিয়েরো, জন আর্নে রিসে, ডেভিড ত্রেজেঘে, ডেভিড জেমস, বার্বাতভ আর কোচ হিসেবে আসে জিকু, মলিনাদের মতন বড় বড় নাম। যে দলগুলার মালিকানাতে আছে শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলী এর মতন ক্রিকেটার থেকে শুরু করে রনবীর কাপুর, অভিষেক বচ্চন এর মতন শোবিজ তারকা আর আম্বানি গ্রুপ তো আছেই। সেখানে যে যুব বিশ্বকাপ আয়োজন করা হচ্ছে তার ব্রান্ড এম্বাসেডর হিসেবে আছে শচীন টেন্ডুলকার। যদি বাফুফে চাইতো তো আমাদের আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আকরাম খান, খালেদ মাসুদ পাইলট থেকে শুরু করে হালের সাকিব আল হাসান কেউই মনে হয় পিছাতো না বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ফুটবলে নিজের দেশকে এগিয়ে নেয়ার প্রয়াসে কিছুটা সাহায্য করার জন্যে। মার্কেটিং প্রসঙ্গ শেষ।
এবার আসি কোচিং স্টাফ প্রসঙ্গে।
ভারতের কোচ হিসেবে ২০০২ থেকে এখন পর্যন্ত কাজ করেছেন দেশি বিদেশি মিলিয়ে ৭ জন। ২০০২-২০০৫ পর্যন্ত ছিলেন স্টিফেন কনস্ট্যানটাইন, এর পর স্বল্প মেয়াদে ২০০৫-০৬ এ ছিলেন ভারতের সুখবিন্দার সিং ও সৈয়দ নাইমুদ্দিন। ২০০৬-২০০১ পর্যন্ত ছিলেন ইংল্যান্ডের বব হাউটন। ২০১১-২০১২-তে স্বল্প মেয়াদে ছিলো ভারতে আর্মান্দো কোলাচো এবং সাভিও মেদেইরা। ২০১২-২০১৫ পর্যন্ত হল্যান্ডের কোভারম্যান ছিলেন আর ২০১৫ থেকে এখন পর্যন্ত আছেন স্টিফেন কনস্ট্যানটাইন ২য় পর্বে। এবার আসি বাংলাদেশের কোচ প্রসঙ্গে। ২০০২ থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোচ পাল্টেছে ১৯ জন যার মাঝে
- জর্জ কোটান — ২০০০–২০০৩ পর্যন্ত
- আর্জেন্টিনার আন্দ্রেস ক্রুসিয়ানি — আগস্ট ২০০৫–২০০৭ পর্যন্ত
- ভারতের সৈয়দ নাঈমুদ্দিন — জুলাই ২০০৭–নভেম্বর ২০০৭ পর্যন্ত
- বাংলাদেশের আবু ইউসুফ মোহাম্মদ — মার্চ ২০০৮–জুন ২০০৮ পর্যন্ত
- বাংলাদেশের শফিকুল ইসলাম মানিক — আগস্ট ২০০৮–নভেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত
- ব্রাজিলের ডিডো — জানুয়ারি ২০০৯–নভেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত
- বাংলাদেশের শহীদুর রহমান শান্ত — নভেম্বর ২০০৯–ডিসেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত
- সার্বিয়ার জোরান জর্জেভিচ — জানুয়ারি ২০১০–ফেব্রুয়ারি ২০১০পর্যন্ত
- বাংলাদেশের শফিউল বারী টিটু — ফেব্রুয়ারি ২০১০
- ক্রোয়েশিয়ার রবার্ট রুবচিচ — সেপ্টেম্বর ২০১০–জুন ২০১১ পর্যন্ত
- ম্যাসেডোনিয়ার জর্জ ইভানোভস্কি — জুন ২০১১ পর্যন্ত
- ম্যাসেডোনিয়ারই নিকোলা ইলিয়েভস্কি — জুন ২০১১–ডিসেম্বর ২০১১ পর্যন্ত
- বাংলাদেশের শফিউল বারী টিটু — সেপ্টেম্বর ২০১২–ডিসেম্বর ২০১২
- নেদারল্যান্ডস এর লডউইক ডি ক্রুইফ — জানুয়ারি ২০১৩– সেপ্টেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত
- ইতালির ফাবিও লোপেজ — সেপ্টেম্বর ২০১৫- নভেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত
- বাংলাদেশের মারুফুল হক — নভেম্বর ২০১৫ – জানুয়ারি ২০১৬ পর্যন্ত
- স্পেনের গঞ্জালো সানচেজ মরেনো — ফেব্রুয়ারি ২০১৬– মে ২০১৬ পর্যন্ত
- নেদারল্যান্ডস এর লুডউইক ডি ক্রুইফ — মে ২০১৬ – জুন ২০১৬ পর্যন্ত (২য় মেয়াদে)
- বেলজিয়ামের টম সেইনফিট — জুন ২০১৬ – অক্টোবর ২০১৬ পর্যন্ত
- অস্ট্রেলিয়ার এন্ড্রু ওর্ড (মে ২০১৭ – বর্তমান)
বাংলাদেশের স্থানীয় কোচদের ছাড়া ২০১০ এর পর থেকে আসা বিদেশি কোচেরা কয়দিন লিগের খেলা দেখেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন আর নাই বা তুলি। একেক কোচের স্টাইল থাকে একেক রকম আর সেখানে যদি ১৭ বছরে ১৯ জন কোচ পালটানো হয় সেখানে কোচ তো আসলে দল সামলানোর আগে ভেবে নিবে নিজের গদি সামলানোটাও বড় দায় হিসেবে। এবার আসি স্পন্সর হিসেবে যার কথা প্রায় বলে থাকে বাফুফে সভাপতি। আর ওই একটা কথা শুনে হাসি পেয়ে যায় কারণ যে প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনের প্রস্তুতি হয় ৫ তারকা হোটেল থেকে সেখানে স্পন্সরের অভাব? আর আমরা বিশ্বকাপ আসলে যেভাবে মেতে উঠি অন্যান্য দল নিয়ে তার সিকিভাগ যদি বছর জুড়ে নিজের দেশের ফুটবল নিয়ে কথা বলতাম তবে মনে হয় না এমন পরিণতি আমাদের হতো। এজন্যেই হয়তো আমাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ‘চার ছক্কা হই চই’ বলেই কাটাতে হবে আর কখনো ফুটবল বিশ্বকাপে বা এশিয়ারও কোন টুর্নামেন্টে নিজেদের পক্ষে গলা ফাটিয়ে বলতে পারবো না “গোল গোল গোল, ওলে ওলে ওলে”