বেকারত্ব: লুবনা বিনতে কিবরিয়া
লুবনা বিনতে কিবরিয়া ::
আমি হচ্ছি বিশিষ্ট চিন্তাবিদ। পৃথিবীর যত জিনিস আমার আয়ত্বে আছে, সব কিছু নিয়ে আমি চিন্তা করি। নিজের সমস্যা, পরের সমস্যা সব কিছু নিয়ে চিন্তা করি। চিন্তা করে মন খারাপ করি। মন ভালো করি। কখনো কখনো অতি চিন্তা করে অসুস্থ পর্যন্ত হয়ে যাই। মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণ হয়তো বলবেন এটা এংজাইটি ডিজঅর্ডার। সে যাই হোক, এংজাইটি নিয়ে আমার কোন এংজাইটি নাই। ইদানিং একটা চিন্তা আমাকে খুব বিচলিত করছে। সেটা হলো, আর মাত্র কয়েক মাস পরে অফিশিয়ালি বেকার তরুন সমাজের তালিকায় আমার নাম উঠে যাবে। আমার এখন কি করা উচিত? হঠাৎ মনে হলো সত্যি সত্যিই চিন্তার করার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছি। এক জন ফ্রেশ গ্রাজুয়েটের সবচেয়ে কঠিন মানসিক সংকটের সময় পাশ করার পরের কয়েকটা বছর। কঠিন সময়! বর্তমানে দেশ বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। উচ্চ শিক্ষিত তরুণ সমাজের প্রায় অর্ধেক বেকার। এই বিশাল তরুন জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের কারন কি? সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছে না? দেশে কাজের সুযোগ নাই? জনসংখ্যা বেশি? সরকার, প্রশাসনের উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া খুব সহজ। ইকোনমিক্স এর ছাত্রী হিসেবে একটু হলেও বুঝি একটা দরিদ্র দেশ চালানো সহজ কর্ম নয়। থাক, সেদিকে না গেলাম।
এখন ভেবে দেখলাম আমার বেকারত্ব ঘুচাবার জন্য আমি কি করলাম- বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, ক্লাস করেছি, মুভি দেখেছি, ফেইসবুকিং করেছি, আর এক্সামের সময় মৌসুমী তোতাপাখির মতো কিছু পড়াশোনা করে এক্সাম দিয়েছি। দৈব বলে সাত সেমিস্টার এভাবেই পাশ করেছি। এখন চানাচুর খেয়ে রাস্তায় ঠোঙ্গা ফেলতে ফেলতে সরকারকে গালাগাল দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এই হলো আমার বেকারত্ব ঘুচাবার প্রস্তুতি। আমার জেনারেশনের ৯৫% তরুনের প্রস্তুতি এমনই।আমরা সবাই কাজ করতে চাই, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও কাজ পাচ্ছি না। ইনভলান্টারি আনএমপ্লয়মেন্ট ( কাজ করার ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও কাজ না পাওয়া) খুব হতাশার তাই না? বেকারত্ব নিয়ে হতাশ হওয়ার আগে আমাদের আসলে নিজেকে নিয়ে হতাশ হওয়া উচিত। আমরা বেকার কেন জানেন? আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ডিএসইউ টাইপ গ্রুপ/ পেইজে দিনরাত পড়ে থাকে। “লিংক” খুঁজে, চিকন পিনের চার্জার সংক্রান্ত কমেন্টে রাত ভোর হয়ে যায়। কেউ কেউ ফেইসবুক সেলিব্রেটি ( এই জিনিসে যে কী মজা কখনো বোধগম্য হয় নি।) হতে মরিয়া। কেউ বিভিন্ন গ্রুপের (অবশ্যই ফেসবুক ক্লোজড গ্রুপ) রাজনীতির ব্যস্ততায় দম ফেলার ফুরসত পায় না। কেউ কেউ আমার মতো অহেতুক উচ্চমার্গীয় ভাল্লাগেনা রোগে আক্রান্ত। ৯০% তরুন-তরুনী কোন প্রোডাক্টিভ কাজের সাথে জড়িত না।
আমরা একটা ইলিউশনের জগতে বাস করছি। একটা ঘোরে পড়ে আছি। নিজেকে পৃথিবীর সুবিশাল কর্মক্ষেত্রের জন্য যোগ্য করে তুলতে আমরা কী করছি? এরজন্য আমাদের পরিবেশ- প্রতিবেশ, আমাদের বাবা-মা এর কোন দায় নেই? ১৮বছর বয়সে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে পথে বের করে দিয়ে যদি বলতো, যাও নিজে নিজে বড় হও গিয়ে। আমাদের আসলে ওইভাবে বড় করা হয় না। তাই আমরা পারিও না। এইজন্যই বোধহয় আমাদের স্বনির্ভর হওয়ার গরজ কম। আমাদের বাবা-মায়ের টাকায় বেনসন পুড়াতে, প্রেম করতে একটুও বাঁধে না। আত্মমর্যাদা টার্মটার মানে বুঝতেই আমাদের তিরিশ বছর লেগে যায়। আমাদের মায়েরা বাড়াবাড়ি রকম মা বলেই আমরাও বাড়াবাড়ি রকম ছা’ হয়েছি। ছোটবেলা থেকে বাচ্চার জুতোর ফিতেটা তাকে বাঁধতে দিলে ওর আংগুল কি ভেঙে যেতো? নিজের স্কুল ড্রেসটা ও নিজেই পরতে পারতো না? একবার উল্টা পরলেও পরের বার ঠিকই ঠিক করে পরতে পারতো। পাঁচ বছরের মেয়েটাকে দিন না মাছের কাঁটাটা বেছে খাক, এক আধ বার কাঁটা ফুটলে মানুষ মারা যায় না। বাচ্চাটা একা স্কুলে গেলে ক্ষতি কি? ওর বয়সী অনেক বাচ্চা ফুটপাথে ঘুমায়। রাস্তা পার হওয়ার নিয়মটা শিখিয়ে দিয়ে আপনি ছুটি নিলে সে কি বাড়ি ফিরতে পারতো না? খাবারটা সে নিজের হাতেই খাক না। বলতে পারেন, ফেলে ছড়িয়ে একাকার করবে; খাবে না কিছুই। দুদিন ঠিকমতো না খেলে সে মরে যাবে না। তৃতীয় দিন থেকে ঠিকঠাক খেতে পারবে। নিজের দায়িত্বটা ওকে নিতে দিলে ওরই ভালো হবে।
অনেক মাকে বড়াই করে বলতে শুনি, আমার মেয়েকে প্লেটটা ধুয়ে পর্যন্ত ভাত খেতে দিই নি। আর ছেলেটা তো স্নান করে নিজের কাপড়টা পর্যন্ত ধুতে পারে না। অমন আমড়া কাঠের ঢেঁকি বানিয়ে বড়াই করার কি আছে! আমার অনেক বন্ধু/ক্লাসমেট আছে, তারা টিউশন নিতে চাইতো, কিন্তু বাবা মা অনুমতি দেয় নি বলে নিতে পারে নি। মায়ের হাতে গড়া এই পুতুলেরা হুট করে নিজে নিজে দাঁড়াতে গিয়ে হোঁচট খাবেই। মায়ের আঁচলের ছায়াতল থেকে বের হয়ে তারা উদ্যোক্তা হওয়ার ঝুঁকি নিতে ভয় তো পাবেই। সব কিছু ছাপিয়ে বাবা মায়ের প্রত্যাশার উপরে আর কিছু নাই। ডাক্তার হও। ইঞ্জিনিয়ার হও। বিসিএস ক্যাডার হও। চাকরি ছাড়া কথা নাই। বলিহারি যাই! একবার ফেসবুকে একটা কৌতুক পড়েছিলাম– বিল গেটস যদি বাংলাদেশে জন্মাতো, বাবা বলত, এসব উইন্ডোজ ফুইন্ডোজের ভূত মাথা থেকে নামিয়ে বিসিএস দাও, যাও!
লেখিকা: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী।