সুনামগঞ্জ বাজার থেকে আবারো ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা লোপাট
উজ্জ্বল মেহেদী-(ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে)
’সুনামগঞ্জে জোছনার বদলে অবৈধ অস্ত্র!’ এ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোয়, সম্ভবত ২০০০ সাল। তখন নিরাপত্তার জন্য শহর ছেড়ে থাকতে হয়েছিল কিছু দিন। পাছে কান পাতা ছিল শহরে। শুনেছিলাম, তিন দফা প্রথম আলো এসেছিল শহরে এবং তিন দফা পত্রিকাগাট্টি সমেত কিনে নিয়েছিল একটি প্রভাবশালী মহল। সেদিন সংবাদপত্র পরিবেশক, বিক্রেতারা ছিলেন যারপরনাই খুশি। তাঁরা ফোন করে তাগাদা দিতেন আবার কবে এ রকম প্রতিবেদন প্রথম আলোয় ছাপা হবে। যদি হয়, আগেই যেন তাঁদেরকে জানাই। প্রায় ১৭ বছর পর আবার শুনলাম প্রিয় শহরে সেই একই স্টাইলে পত্রিকা লোপট হওয়ার কথা।
২৩ অক্টোবর থেকে কর্মস্থলছাড়া, প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমরা সারা দেশের প্রতিনিধিরা মিলিত হয়েছি সাগরপাড়ে, কক্সবাজারে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদকসহ নীতিনির্ধারকেরাও। সমুদ্রের নোনাজলে গোসল করছি, সাগরের গর্জনকে গায়ে মাখছি, ঠিক সেই সময় পেলাম আবার পত্রিকা লোপাট। তাৎক্ষনিকভাবে আমি বিকল্প কিছু পন্থা অবলম্বনের পথনকশা করে সংশ্লিষ্টদের জানালাম। বিকল্প পন্থায় অবশেষে পাঠক-বঞ্চনার ষোলকলা আর পূর্ণ হয়নি। তবে মনে খটকা থেকেই গেল। কারণ, ২৫ অক্টোবর প্রথম আলোয় ‘মহারথি’দের খবরের সঙ্গে ছিল একটি ইতিবাচক খবরও। সুনামগঞ্জের হাওরগহিনের এক কৃতী সন্তানের বিশ্বসেরা উদ্ভাবনের খবর। বিশ্বখ্যাত আমাদের এই বিজ্ঞানীকে জানান দিতে দরকার ছিল প্রথম আলোর স্বাভাবিক কেনাবেচা। সঙ্গত কারণেই মন খারাপ। সাগরের বিশালত্বের মধ্যে বসে ভাবছি, ১৭ বছর আগে তো ছাপা কাগজ তুলে নিলেই সব চুকে যেত, যেন অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ! কিন্তু এখন তো সেই যুগ আর নেই, তবে কেন অন্ধ করে প্রলয় বন্ধ করার সেই পুরনো কূট-কৌশল?
২. মনে পড়ছে সাংবাদিকতা শুরুর সমযের কথা। যদিও আমার কর্মস্থল এখন সুনামগঞ্জ নয়, আরও বিস্তৃত হয়েছে, তবু ভাবায় ফেলে আসা কিছু দুঃসময়। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ সাল। সুনামগঞ্জ শহরে প্রযুক্তি নির্ভর সাংবাদিকতার প্রসার ঘটছে মাত্র। তখন শাসকদলে দুই পক্ষে রক্তারক্তির কোনো ঘটনা ঘটলেই গোটা শহরে নেমে অাসত অন্ধ করে প্রলয় বন্ধের কোশেশ। টেলিফোন সংযোগ বন্ধ করে দিয়ে, একমাত্র টিঅ্যান্ডটি’র ইন্টারনেট অফ করে দিয়ে, ফ্যাক্স অচল করে রাখা হতো। যাতে সংবাদকর্মীরা আর তাৎক্ষনিক খবর পাঠাতে না পারেন। পরদিন অগ্রসর পাঠক যখন দৈনিক পত্রিকায় চোখ রাখতেন, প্রবঞ্চিত হতেন। বন্ধ থাকলেও টেলিফোন-ফ্যাক্স-ফোনের ব্যবসায়ীদের সারা দিনের মুজরি দেওয়া হতো। তাই তাঁরাও বিনা বিলে রোজগার হিসেবে অপেক্ষায় থাকতেন, পত্রিকা পরিবেশকদের মতোন। তখন কবিতার শহরে সন্ত্রস্ত কবিরা কবিতা লিখতেন বটে, কিন্তু ভয় কার জন্য পাচ্ছেন, তার নামও নিতেন না (যেমন একটি কবিতার লাইন : ভয়ে তড়পাচ্ছি/ কাকে বলবো না/ বললে তড়পানোর সময়ও পাবো না…)। সেই সময়েই সুনামগঞ্জের হাওরে গজিয়ে ওঠে সন্ত্রাসী বাহিনী। তাহিরপুর-ধরমপাশা-জামালগঞ্জ হচ্ছে হাওরের ভাটি, সেখানটা যেন সন্ত্রাসকবলিত। যোগাযোগ বিড়ম্বনায় সেখানে হাওরের ইজারাদারি প্রভাব থেকে একজন গডফাদারের আবির্ভাব, প্রথম আলো নাম দেয় ‘ওয়াটারলর্ড’। মনে পড়ে, প্রথম আলোর সম্পাদক তখন অামাকে সরাসরি চিঠি দিয়ে ওয়াটারলর্ডের প্রভাব ভাঙার তাগিদ দেন। সেই প্রভাব ভাঙতে গিয়ে আমার টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রেমে পড়া। ওয়াটারলর্ড একটানা ৩৪ বছর ইজারাদার থাকায় টাঙ্গুয়ার অধিকর্তা হয়ে উঠেছিলেন।একের পর এক প্রতিবেদনে টাঙ্গুয়ার হাওরের ইজারাদারি প্রথা বাতিল হয়। শেষ পর্যন্ত অপারেশন ক্লিন হার্টে ওয়াটারলর্ড আইনের জালে আটকা পড়েন। সেই সময়েও সুনামগঞ্জে পত্রিকা লোপাটের ঘটনা ঘটত প্রায় নিয়মিতই। এরপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে অবাধ তথ্যপ্রবাহের চরম উৎকর্ষের এই সময়, ২৫ অক্টোবর যেন দেখা গেল সেই সব ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
৩. পেশাগত কারণে রোজ সকালবেলা প্রথম আলোসহ জাতীয় তিনটি আর স্থানীয় দু-চারটি পত্রিকা পড়ে বাসা থেকে বের হওয়ার অভ্যাস। বৃষ্টিবাদল হলে পত্রিকা বাসায় পৌঁছাতে ব্যাঘাত ঘটে। একদিন লাগাতারভাবে কয়েক সকাল আমার ব্যাহত হলো বাসায় পত্রিকাপাঠ। বাহক পত্রিকা বাসায় দেয়নি, আমি ফোনে পরিবেশককে রাগের সঙ্গে এ কথা জানাচ্ছিলাম। আমার ওপাশে স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল কেজি-ওয়ানপড়ুয়া ছেলে। রাগারাগি দেখে সে আমার সঙ্গে উল্টো রাগ দেখাল। কথার পলকে মায়ের মুঠোফোন এনে আমার সামনে এসে বলল, ‘সার্চ দাও, আর দুনিয়ার সব পত্রিকা পড়ো, তবু রাগ করো না…!’ পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলে যদি এভাবে বিকল্প সামনে তুলে ধরতে পারে, তাহলে একদিন সুনামগঞ্জমুখী সব প্রথম আলো হাওরের একটি ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের টাকা খরচা করে কেন কিনতে হবে? কারাগারে নয়, হাসপাতালের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে বসেই যে ‘তালাশ’ ফাঁদা হয়েছিল, প্রথম আলো লোপাটের মধ্য দিয়ে ফাঁস হলো এবার।