রাজধানীতে ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে জোড়া খুন
বার ঘণ্টার মাথায় রাজধানীতে ফের জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বাড্ডা এলাকায় বাবা ও মেয়ে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। তারা হলেন- জামিল শেখ (৩৯) ও তার মেয়ে নুসরাত জাহান (৯)। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী আরজিনা বেগমকে (২৯) আটক করেছে পুলিশ। নিহতের পরিবার ও পুলিশের ধারণা, পারিবারিক কলহ ঘিরে এ ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ নিহতদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে। সরজমিন ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বাড্ডা থানাধীন ময়নারবাগ কবরস্থান রোডের ৩০৬ নম্বর পাঠান ভিলার তৃতীয় তলায় পরিবার নিয়ে একটি কক্ষে সাবলেটে থাকতেন জামিল শেখ। গতকাল ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বাড়ির চতুর্থ তলার ভাড়াটিয়া ইউসুফ হোসেন ফজরের নামাজ পড়তে বের হলে তৃতীয় তলার ঘরের দরজার সামনে জামিল শেখের স্ত্রী আরজিনা বেগমকে কাঁদতে দেখেন। তখন আরজিনা বেগমের কোলে তার তিন বছর বয়সী ছেলে আলভি হোসেন ছিল। ইউসুফ তাকে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলে আরজিনা জানান, কে বা কারা তার স্বামী ও মেয়েক হত্যা করে পালিয়েছে। ইউসুফ তখন হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করে দেখেন বিছানায় জামিলের রক্তাক্ত দেহ পাশে মেয়ে নুশরাতের লাশ পড়ে রয়েছে। এ সময় ইউসুফ বাড়ির মালিক দুলাল পাঠান ও তার স্ত্রী নাসিমা পাঠানকে বিষয়টি জানান। বাড়ির মালিক বিষয়টি পুলিশকে জানান। ঘটনাস্থলে আসেন সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্যরা। উদ্ধার করেন আলামত। পুলিশ আরজিনা বেগমকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিহত জামিলের মাথা, গলায়, পিঠে ও চোখের ওপর ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। তাছাড়াও তার মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল। তবে নুসরাতের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। পুলিশের ধারণা, নুসরাতকে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল সকালে সরজমিনে ময়নারবাগের কবরস্থান রোডের ৩০৬, নম্বর পাঠান ভিলায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনের সরু রাস্তায় স্থানীয় লোকজনের ভিড়। বাড়ির সামনে রয়েছে মাহমুদীয়া তাহসীনুল কোরআন মাদরাসা। লোমহর্ষক ওই খুনের ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। উৎসুক মানুষের ভিড় সামলাতে পুলিশকে বেগ পেতে হয়। বাড়ির মালিক দুলাল পাঠান জানান, চারতলা বাড়ির তৃতীয় তলায় দুইটি কক্ষ রয়েছে। আর পাশের অংশটি খোলা ছাদ। দুই কক্ষে দুইটি পরিবার থাকতো। জামিল শেখ যে কক্ষে থাকতো তার পাশের কক্ষের পরিবারটি কয়েকদিন আগে গ্রামের বাড়ি বরিশালে গেছে। তিনি জানান, জামিল শেখ ৩ মাস আগে তৃতীয় তলার একটি কক্ষ ভাড়া নেন। ভাড়া নেয়ার পর প্রায় সময় স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাটি হতো। আমি তাকে ঝগড়ার বিষয়ে একাধিকবার জিজ্ঞাসা করলে তিনি বিষয়টি পারিবারিক বলে এড়িয়ে যেতেন। তিনি জানান, ঘটনাটি রাতের যে কোনো সময় ঘটতে পারে। পাশের কক্ষের ভাড়াটিয়া না থাকার কারণে ভোর হওয়ার পরে চতুর্থ তলার বাসিন্দা ইউসুফ জানতে পেরে আমাকে বিষয়টি জানায়। পরে আমি পুলিশকে খবর দিই। বাড়ির মালিকের স্ত্রী নাসিমা জানান, আরজিনা বদমেজাজি ছিল। সারাক্ষণ স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করতো। ঝগড়াঝাটির কারণে তাদের অন্য আরেকটি বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য বলা হয়েছিল।
ময়নারবাগের বাসিন্দা নিহতের দূর সম্পর্কের ভাতিজা মনির হোসেন জানান, গত ১৫ বছর ধরে ময়নারবাগ এলাকায় বসবাস করছিলেন তার চাচা জামিল। জামিল গুলশানের এক শিল্পপতির গাড়ি চালাতেন। গাড়ি চালানোর পাশাপাশি সুদে টাকা ধার দিতেন। কিছুদিন আগে তিনি ভাঙারির ব্যবসা শুরু করেন। এতে তার অনেক টাকা ক্ষতি হয়। তিনি আরো জানান, তার চাচি (আরজিনা বেগম) মাসখানেক আগে তার চাচার সঙ্গে রাগারাগি করে বাবার বাড়ি সাভারে চলে যান। গত ১ সপ্তাহ আগে আবার ফিরে আসেন। তার ধারণা পারিবারিক কলহ ঘিরে এই নৃশংস ঘটনা ঘটতে পারে। সুদের টাকা নিয়ে কারও সঙ্গে তার চাচার বিরোধ ছিল কি-না প্রশ্ন করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কিছু জানেন না বলে জানান। তিনি আরো জানান, জামিলের মেয়ে নুসরাত স্থানীয় একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তো। জামিলের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার সদর থানার বনগ্রাম এলাকায়। নিহতের সহকর্মী সারোয়ার হোসেন আজিম জানান, গত ৬ বছর ধরে জামিলের সঙ্গে তার পরিচয়। জামিল খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ ছিলেন। তবে বেশ কয়েক মাস তাকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে দেখেছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) কৃষ্ণপদ রায় সাংবাদিকদের জানান, নিহত জামিলের শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। এটি পারিবারিক কলহের জেরে ঘটনাটি ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ১২ ঘণ্টার মধ্যে দুই জোড়া খুনের বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি জানান, একটির সঙ্গে আরেকটির যোগসূত্র নেই। অপরাধের ঘটনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। পুলিশ অপরাধীকে ধরে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। বাড্ডা থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ হোসেন জানান, নিহতের স্ত্রী ও এক বাচ্চাকে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে উল্টাপাল্টা কথা বলছে। সে সুস্থ হলে তাকে ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।