ঢাকাঃদেশের উচ্চশিক্ষার প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হয় না দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল বাকি সব সংগঠনের নির্বাচন নিয়মিতই হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নির্বাচন হয়; কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বাচন হয়। সিনেট, সিন্ডিকেট এবং একাডেমিক কাউন্সিলের নির্বাচন হয়। কিন্তু যে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, তাদের নির্দলীয় ও সাধারণ মঞ্চটির নির্বাচনই হয় না। ডাকসু কার্যকর না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ফোরাম সিনেটেও শিক্ষার্থীদের কোনো প্রতিনিধি নেই। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি ও আন্দোলনের পরও ২৭ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে না। যখনই বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কোনো ভিসি পদ গ্রহণ করেন তখনই তিনি বলেন, পরিবেশ তৈরি করে ডাকসু নির্বাচন দেওয়া হবে। কিন্তু সেই নির্বাচনের আর দেখা মিলে না। শিক্ষার্থীরা বলছেন, যখন যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, ক্ষমতাসীন দলগুলোর ছাত্রসংগঠনের ক্ষমতা খর্ব হওয়ার ভয়ে নির্বাচনের আয়োজন করা হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের সাহসী ও দায়িত্বশীল ভূমিকার মাধ্যমেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। তারা বলছেন, পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক সরকারের শাসনামলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদের সরকারের সময়ে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু ১৯৯০ সালে দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরুর পর থেকে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং মাঝে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, কেউই ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করেনি। ছাত্ররা আন্দোলন করে দেশে গণতন্ত্র এনেছেন, কিন্তু তাদের গণতন্ত্র চর্চার সবচেয়ে বড় প্লাটফর্মটিই হারিয়ে ফেলেছেন। গণতান্ত্রিকভাবে সর্বজনীন নেতা নির্বাচনের সুযোগ হারিয়েছেন। বর্তমানে ছাত্ররা ডাকসু ও হল সংসদ বাবদ ফি পরিশোধ করছেন কিন্তু তাতে অংশগ্রহণ থেকেই বঞ্চিত রয়েছেন। এখন তাদের প্রশ্ন- অনেক বছরতো গেলো, অনেক দল-জোটের সরকারও গেলো। বিশ্ববিদ্যালয়েও এসেছে অনেক পরিবর্তন। এমনকি দোতলা ডাকসু ভবনটি ভেঙ্গে বহুতল ভবন করার পরিকল্পনাও রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। শুধু ডাকসু নির্বাচন কি আর অনুষ্ঠিত হবে না? ডাকসু ভবনটি কি শুধুই স্মৃতির কঙ্কাল হিসেবেই দাঁড়িয়ে থাকবে? সর্বশেষ ১৯৯০ সালের ৬ জুন ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ডাকসু থেকে নির্বাচিত ৫ জন প্রতিনিধি সিনেটে থাকার কথা। কিন্তু দীর্ঘ দিন নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়াই সিনেট সভা হচ্ছে।

সম্ভাবনা তৈরি হয়েও অনুষ্ঠিত হচ্ছে না নির্বাচনঃ
১৯৯০ সালের ৬ জুনের নির্বাচনের এক বছর পর ১৯৯১ সালের ১২ জুন তখনকার ভিসি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। তখন ছাত্রনেতারা ছাত্রত্ব ঠিক এবং প্রার্থী হওয়ার জন্য বিশেষ ভর্তির দাবি করে। এ নিয়ে সৃষ্ট সহিংসতায় তখন নির্বাচন ভণ্ডুল হয়ে যায়। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদও ডাকসুর তফসিল ঘোষণা করেন। কিন্তু পরিবেশ না থাকার অভিযোগ এনে সে সময়ে বিরোধী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বাধার মুখে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। একইভাবে ১৯৯৫ সালেও ডাকসুর তফসিল ঘোষনা করা হয়। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৯৬ সালে অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী ভিসির দায়িত্ব নেয়ার পর একাধিকবার ডাকসু নির্বাচনের সময়সীমার কথা জানান। কিন্তু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় ব্যর্থ হন। ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু হলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ছাত্রদল নেতা আরিফ হোসেন তাজ খুন হন। ঐ ঘটনা তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিটি ১৯৯৮ সালের ২৩ মে রিপোর্ট দেয়। রিপোর্টে তখনকার মেয়াদোত্তীর্ণ ডাকসু ভেঙ্গে দেয়া এবং পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করে। সে অনুযায়ী ২৭ মে সিন্ডিকেট সভায় ডাকসু ভেঙ্গে দেয়া হয়। এরপরও অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী দু’বার নির্বাচনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু তত্কালীন বিরোধী ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের অসহযোগিতার কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি বলে ভিসির অভিযোগ রয়েছে। সে সময় ডাকসুর জন্য গঠিত নতুন (সংশোধিত) গঠনতন্ত্রে ডাকসু ভাঙার চার মাসের মধ্যে পুনরায় নির্বাচনের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত ডাকসুর তফসিল ঘোষণা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ এবং হল সংসদ নির্বাচনের স্বপ্ন ছাত্রদের কাছে স্বপ্নই রয়ে গেছে।
২০০৫ সালের মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ভিসি অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ ওই বছরের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ভিসির ওই ঘোষণার পর ছাত্র সংগঠনগুলো নড়েচড়ে বসে। ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে একাধিকবার মিছিল সমাবেশ এবং ভিসির কাছে স্মারকলিপিও দেয়। তবে ছাত্রলীগসহ বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো এগিয়ে আসেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পরও ডাকসু নির্বাচনের জোর দাবি ওঠে। এ নিয়ে আদালত পর্যন্ত দাবি গড়ায়। শিক্ষার্থীরা পৃথক মঞ্চ করে আন্দোলনও গড়ে তোলে। ২০১৫ সালে ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি গঠন হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটিও ভিসির কাছে ডাকসু নির্বাচনসহ ১৯ দফা দাবি জানিয়েছিলো। সর্বশেষ গত মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ ডাকসু নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন ইজ মাস্ট। এটা না হলে ভবিষ্যতে নেতৃত্বে শূন্যতা সৃষ্টি হবে।’ রাষ্ট্রপতির এমন বক্তব্যের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র ডাকসু নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সবাই ভেবে ছিলেন এবার হয়তো নির্বাচন হবেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ভিসি অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিকও গণমাধ্যমকে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ না করেই ২৯ জুলাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নির্বাচনের জন্য সিনেটের বিশেষ সভা ডাকেন। এসময় ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করলে শিক্ষকদের বাধার মুখে দুই পক্ষের হাতাহাতি হয়। পরে হাইকোর্ট ওই বিশেষ সভাকে অবৈধ ঘোষণা করে। এ প্রসঙ্গে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন অছাত্রদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে এবং সার্বিক পরিবেশ অনুকূলে না থাকার কারণে ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করা যায়নি।

আছে প্রশ্ন, আছে স্বপ্ন
দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে কথা বললেও সব ছাত্র সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে কখনো আলোচনায় বসেনি। ডাকসুর দাবিতে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীরাই গত ১০ আগস্ট ডাকসু নিয়ে এক উন্মুক্ত আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে সব ছাত্র সংগঠনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র মৈত্রীসহ অধিকাংশ ছাত্র সংগঠন এই আলোচনায় অংশ নেয়। ছাত্রলীগ তাদেরকে আলোচনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি দাবি করে অংশ নেয়নি। তারা উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিতে আসা ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করে আহত করে। শিক্ষার্থীরা নির্বাচন দেওয়ার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানকে গত ২৫ সেপ্টেম্বর স্মারকলিপি দেয়। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলে ডাকসু নির্বাচন করার ব্যাপারে আন্দোলনরতদের আশ্বাস দেন।
ছাত্রনেতাদের বক্তব্য
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, আমরা সব সময়ই ডাকসু নির্বাচন চাই। বর্তমান ভিসি আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, তারা সব ছাত্র সংগঠনের তালিকা করছেন। উপযুক্ত সময়ে তারা সবাইকে ডেকে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করবেন। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিব আহসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরকারের লেজুড়বৃত্তি করে। সরকার ভিন্ন মতের সুযোগ সঙ্কুচিত করে এমন একটা জায়গায় এসেছে যে ভিন্ন মত প্রকাশের জায়গা একেবারে তারা বন্ধ করে দিতে চায়। ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি তুহিন কান্তি দাস বলেন, স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্যই ডাকসু নির্বাচন। এই স্বাধীন মত প্রকাশকে সরকার তাদের জন্য সুবিধাজনক মনে করে না দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতায় থাকার জন্য। যে কারণে এ ব্যাপার সরকারের আগ্রহ নেই। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও তা চায় না। বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, ডাকসুর ছাত্র রাজনীতির মধ্যে দিয়ে দেশের ভবিষ্যত্ নেতৃত্ব তৈরি হবে। কিন্তু বিদ্যমান শাসকগোষ্ঠী এটা চান না ডাকসুর মাধ্যমে রাজনীতিতে তাদের পরিবারের বাইরে অন্য নেতৃত্ব আসুক। ছাত্রফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাঈমা খালেদ মনিকা বলেন, ডাকসু নির্বাচন দেওয়ার জন্য একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জরুরি, যেটা নেই। সরকারের আনুকূল্য পেয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে শীর্ষব্যক্তিরা আসে। ফলে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারেই তারা কাজ করে। সরকার চায় না বলেই কর্তৃপক্ষ ডাকসু নির্বাচন দিতে চায় না।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বক্তব্য
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ডাকসু নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে। এই নির্বাচন দেওয়ার জন্য কিছু অনুসঙ্গ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে ডাকসু নির্বাচনের জন্য আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করবো।

ফিরে দেখা ডাকসু

১৯২১ সালে উপমহাদেশের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) সৃষ্টি হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এক টাকা চাঁদা দিয়ে এর সদস্য হতে হত। এভাবেই যাত্রা শুরু হয় দেশের স্বাধিকার, ভাষার সংগ্রাম ও স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার ডাকসুর। মোট ৩৬ বার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ডাকসুর প্রথম ভিপি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। ডাকসু’র সর্বশেষ ভিপি ও জিএস ছিলেন আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn