কেন্দ্রীয় নেতাদের সারা দেশ সফর: সম্ভাব্য প্রার্থী মনোনয়ন নিয়েও আলোচনা হচ্ছে

প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গোছানো শুরু করেছে সংগঠন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের জন্য দলীয়ভাবে খোঁজখবর নেয়া শুরু হয়েছে। একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে জরিপ পরিচালিত হয়েছে। এখন পেশাদার সংগঠনের মাধ্যমে জরিপ করানোর বিষয়ে আলোচনা চলছে। দলের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) দলের সংসদ সদস্যদের নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে। দলের দফতর জেলা ও থানা নেতাদের নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর সংগ্রহ করছে। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতাকর্মীদের আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার পাশাপাশি নিজেও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণা শুরু করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোয় সমন্বয়কের ভূমিকা পালনকারী দলের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য কাজী জাফর উল্ল্যাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘গত বছরের জুলাই মাসে দলের সভাপতি নেতাকর্মীদের জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। এর পর থেকেই দলের যত কাজ তা নির্বাচনকে মাথায় রেখেই হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতারা সারা দেশ সফর করছেন। আমিসহ দলের সিনিয়র নেতারাও নিজ নিজ এলাকায় যাতায়াত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী দেশের বিভিন্ন জেলায় জনসভা করেছেন। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সম্ভাব্য প্রার্থী মনোনয়ন নিয়েও আলোচনা করছি। তা ধাপে ধাপে এগোচ্ছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের বার্তা দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে আমরা আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।’ আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন আসন নিশ্চিত এবং কোনগুলো অনিশ্চিত তা নিয়ে কাজ চলছে। দলের হাইকমান্ড সব জরিপ এবং তথ্য বিশ্লেষণ করে যেসব আসনের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী হবে, সেগুলো ছাড়া বাকিগুলো নিয়ে হিসাব-নিকাশ করা হবে। ইতিমধ্যে একটি জরিপের কাজ শেষ হয়েছে। এ জরিপে প্রতিটি আসনে জনপ্রিয়তাকে মাপকাঠি ধরে আগ্রহী প্রার্থীদের সিরিয়াল করা হয়েছে। তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বর্তমান সংসদের এমপিদের মধ্যে কারা এলাকামুখী, জনপ্রিয় ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন। কারা স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। অধিকাংশ আসনের বিপরীতেই একাধিক বিকল্প নাম বিবেচনায় রয়েছে। আর কোন কোন আসন ঝুঁকিপূর্ণ তা চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রতিটি নির্বাচনের আগে নিজস্ব দলীয় টিম নির্বাচনী এলাকাগুলোতে যে জরিপ চালায় তা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি এ নিয়ে কাজ করছে। নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক ভোটারদের অবস্থান, মানসিকতা, দলের প্রতি সমর্থনের হার, প্রার্থীদের জনপ্রিয়তার তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। কেবল নিজ দলের প্রার্থীদেরই নয়, প্রতিপক্ষ দল ও প্রার্থীদের খবরও নেয়া হচ্ছে। আর এসব তথ্য জমা হচ্ছে দলীয় সভাপতির ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে নির্বাচন পরিচালনাকারী কমিটির হাতে। কার্যালয়ের তিন তলায় সেগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে।

এছাড়া গত কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফল, কোন দলের কোন প্রার্থী ছিলেন, টানা ২ বার আওয়ামী লীগের শাসনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়েও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কাজ করছে দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি। সাবেক ৩ আমলার নেতৃত্বে এ কর্মযজ্ঞ চলছে। উচ্চপর্যায়ের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, পেশাদার জরিপ পরিচালনাকারী একটি প্রতিষ্ঠান থেকেও জরিপ চালানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। অত্যন্ত গোপনে এ জরিপের কাজ চলবে।

গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই আওয়ামী লীগে চলছে সাংগঠনিক কর্মযজ্ঞ। চলছে প্যাকেজ কার্যক্রম। শুরু হয়েছে জেলা জেলায় বর্ধিত সভা আর বিভাগীয় প্রতিনিধি সভা। দলের সাংগঠনিক ও যুগ্ম সম্পাদকরা সব নিজ বিভাগের সাংগঠনিক রিপোর্ট প্রস্তুত করছেন। জেলা-উপজেলাসহ তৃণমূলে সাংগঠনিক নানা নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তৃণমূল থেকে নানা তথ্য চেয়েও চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিভিন্ন নির্বাচনের বিদ্রোহী প্রার্থীরা সাধারণ ক্ষমা পেলেও তাদের ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান নিয়েছে দল। ইতিমধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় ৩ জেলার ৩ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের প্রায় প্রতিটি কর্মসূচিতে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নেতাকর্মীদের মানুষের কাছে যাওয়ার ও তাদের মন জয় করার নির্দেশ দিচ্ছেন। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, দেশের উন্নয়নসহ দেশের সার্বিক অগ্রগতি তুলে ধরতে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।

দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সান্তাহারের জনসভায় আগামী নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীদের ভোট দেয়ার আহ্বান জানান। যার ধারাবাহিকতা ছিল ১৪ মার্চ লক্ষ্মীপুরের জনসভাতেও। এ মাসেই তিনি আরও ২টি জেলায় জনসভা করতে যাচ্ছেন। সেগুলো হল : ২১ মার্চ মাগুরা ও ২৮ মার্চ ফরিদপুর জেলায়। আগামী এপ্রিল মাসে তিনি সভা করবেন ঠাকুরগাঁও, চুয়াডাঙ্গাসহ আরও একটি জেলায়। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড মানুষের সামনে তুলে ধরে ভোট চাইবেন বলেও মনে করা হচ্ছে।

এদিকে গত জানুয়ারি থেকেই সাংগঠনিক সফর করছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা যেখানেই যাচ্ছেন জনসভা, কর্মিসভা বা সমাবেশ করছেন। এভাবে এই ৩ মাসে প্রায় ৪০টি জেলায় কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। এ ছাড়া গত ফেব্রুয়ারিতে খুলনায় বিভাগীয় প্রতিনিধি সভা হয়। ইতিমধ্যে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগেও অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর আগামী ২২ মার্চ তা হবে সিলেটে। এর ধারাবাহিকতায় অন্যান্য বিভাগেও প্রতিনিধি সভা হবে। এ ছাড়া দলের সহযোগী সংগঠনগুলোরও সম্মেলনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে মহিলা ও যুব মহিলা লীগের সম্মেলন হয়েছে। তারিখ ঘোষণা হয়েছে তাঁতী লীগ ও আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের। নির্বাচনের বেশ আগেই বাকি তিনটি সহযোগী সংগঠনের সম্মেলনও সম্পন্ন হবে।

দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজেও ছুটছেন জেলায় জেলায়। সাংগঠনিক সম্পাদক আর যুগ্ম সম্পাদকরা যাচ্ছেন নিজ নিজ বিভাগে। ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৩০টির বেশি জেলা সফর করেছেন। নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ যুগান্তরকে বলেন, ইতিমধ্যে এমপি ও নেতাকর্মীদের গণসংযোগ বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশ অনেক দূর পিছিয়ে গিয়েছিল। গত ৮-৯ বছরে এ সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বহির্বিশ্বেও আমাদের মর্যাদা বেড়েছে। মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন হয়েছে। দেশ নিন্মমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এ উন্নয়ন অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতা রক্ষায় আওয়ামী লীগের আবারও রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা প্রয়োজন। এ বিষয়গুলো মানুষের সামনে তুলে ধরে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে আবারও নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn